অগ্নিযুগের বিপ্লবী কমরেড সুরেশ সেন
চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখল করার ব্রিটিশ পুলিশ বিপ্লবীদের গ্রেফতার করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে। বিপ্লবী দলের অনেকেই চট্টগ্রামের অনন্ত সিং, গনেশ ঘোষ (১৯০০-১৯৯২), আনন্দ গুহ, মাখম ঘোষালসহ কয়েক জন বিপ্লবী কলকাতায়, সুরেশচন্দ্র সেন, ময়মনসিংহের ক্ষিতিশ চন্দ্র দেব রায়, নেলীসেন গুপ্তসহ অনেকেই বিপ্লবী মহেশখালী, রামু, কুতুবদিয়া এবং উখিয়ায় আত্মগোপন করেন। সশস্ত্র যুদ্ধকে আরো বৃহত্তর পর্যায়ে সংগঠিত করার দায়ে ১৯৩১ সালের জুলাই মাসে মহেশখালী আত্মগোপনকালে তিনি বৃটিশদের হাতে বন্দি হন। আটকের পর প্রহসনমূলক বিচারে ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত একটানা দীর্ঘ নয় বছর কারাভোগ করেন। আলীপুর জেল, বকসাদুয়ারা ক্যাম্প, বহরমপুর জেলসহ ভারতের বিভিন্ন কারাগারে তার কারাজীবন কাটে। কারান্তরীন থাকা অবস্থায় রেকর্ড পরিমাণ নাম্বার নিয়ে কলকাতা প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে তিনি প্রথম শ্রেণিতে বি.এ এবং ‘ল’ (আইন) পাশ করেন। জেল থেকে বের হয়ে এসে তিনি আইন পেশা এবং রাজনীতির সাথে ভালোভাবেই সম্পৃক্ত হন। মাস্টারদা সূর্যসেনের ফাঁসির পর অনেক বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। কমিউনিস্ট পার্টি যে পথে দেশের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করছে, সেই পথই ঠিক মনে হওয়ায় অন্য অনেকের সাথে তিনিও কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী হিসেবে ১৯৪৩ সালের মহামারী বাংলার দুর্ভিক্ষের সময় চট্টগ্রাম খাদ্য কমিটির সম্পাদক পূর্ণেন্দু দস্তিদারের সহায়তায় কক্সবাজারে তিনি কাজ করেছেন। ইতিহাসে মন্বান্তরের সন হিসেবে পরিচিত এ দুর্ভিক্ষের সময় কমিউনিস্ট পার্টি সারা দেশব্যাপী লঙ্গরখানা খুলে বুভুক্ষ মানুষকে বাঁচানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করে। এই দুর্ভিক্ষ থেকে মানুষকে বাঁচাতে চট্টগ্রামের পূর্ণেন্দু দস্তিদারের সাথে পুরো চট্টগ্রাম জেলা জুড়ে বিশেষ করে কক্সবাজারে অমানুষিক পরিশ্রম করে দুর্ভিক্ষ লাঘবে কাজ করেন।
১৯৪৭ এর দেশভাগের সময় সুরেশ চন্দ্র সেনের ত্যাগ এবং অসাধারণ মেধার কারণে তৎকালীন ভারতের কেন্দ্রীয় নীতি নির্ধারকরা তাঁকে ভারতে এসে গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব নিতে অনুরোধ জানান। কিন্তু বাংলাদেশের মাটির টানে সুরেশ চন্দ্র সেন ভারতে যেতে এবং দায়িত্ব নিতে অস্বীকৃতি প্রকাশ করে। ’৪৭ এর দেশভাগের পর তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে থেকে যান। ১৯৪৫ সাল থেকে সুরেশ চন্দ্র সেনের শুরু হয়েছিলো কক্সবাজারে স্থায়ীভাবে বসবাস। কক্সবাজারে বসবাস করলেও তিনি জাতীয় পর্যায়ে কৃষক-শ্রমিকদের অধিকারসহ নানান গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সবসময় সম্পৃক্ত ছিলেন।
১৯৪৮ সালে কক্সবাজার বার-এ আইন পেশায় যোগদেন। ভাষা আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করেন। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের সময় বাংলা ভাষার দাবিতে ছাত্রদের মিছিল সমাবেশে যোগদান করাতে সহায়তা করেছেন এবং নিজেও নেতৃত্ব দিয়েছেন।
১৯৫৭ সালের ২৬ জুলাই মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠিত হলে তিনি ন্যাপের রাজনীতিতে যুক্ত হন। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর দেশে সামরিক আইন জারি করা হলে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি জটিল হয়ে পড়ে। কিছু দিন আত্মগোপন থাকেন তিনি। ১৯৬০ সালে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির কক্সবাজার মহকুমার সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে ন্যাপ দু ভাগ হয়ে গেলে তিনি মস্কোপন্থী বলে ইতিহাসখ্যাত কমরেড অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের নেতৃত্বাধীন ন্যাপে যোগ দেন এবং ১৯৭২ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন ( এ সময় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হিসেবে ন্যাপের হয়ে কাজ করতো)। মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী কক্সবাজারে এলেই বিপ্লবী সুরেশ সেনের বাড়িতে থাকতেন বলে সুরেশ সেনের দ্বিতীয় পুত্র কলামিস্ট এবং সাংবাদিক বিশ্বজিত সেন জানিয়েছেন আমাকে।
তিনি ১৯৬৫-১৯৭৬ পর্যন্ত পাক-রুশ মৈত্রী ও বাংলাদেশ-রুশ মৈত্রী সমিতির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৬ সালে জেলে সমবায় সমিতি ও দোকান কর্মচারী ইউনিয়ন গঠন করেন। ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গণ-অভূত্থানেও অংশ নেন তিনি। “তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পূর্ব পাকিস্তান মৈত্রী সম্পর্কের ক্ষেত্রে তাঁর যথেষ্ট অবদান ছিল।
১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর প্রলঙ্করী ঘূূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস কক্সবাজার উপকূলে আচড় লাগে। এডভোকেট সুরেশ সেনের নেতৃত্বে সর্বদলীয় ত্রাণ সহযোগিতা উপকূলীয় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে দেয়া হয়েছিলো। ’৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের সমন্বয়ে যে সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয় তার অন্যতম নেতা ছিলেন। এ সময় তিনি জেলা এবং জাতীয় পর্যায়ে কৃতী সংগঠক হিসেবে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। ’৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী সেনাবাহিনী দুবার সুরেশ চন্দ্র সেনের বাড়িঘর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ধ্বংস করে দেয়। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের বিভিন্ন জায়গায় আত্মগোপন করে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন দিক নির্দেশনামূলক কার্যক্রমসহ স্বাধীনতার লড়াইয়ে তিনি সরাসরি জড়িত ছিলেন। ১৯৭৩ সালে সরাসরি কমিউনিস্ট পার্টি যোগ দেন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কক্সবাজারে কমিউনিস্ট পার্টির আন্দোলন সংগঠিত করেছেন।
১৯৭৩ সালে কক্সবাজার-টেকনাফ আরাকান সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন ও কক্সবাজার জেলা কৃষক সমিতি গঠন করেন। ৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার পর হুলিয়া নির্যাতনসহ নানান দমন-পীড়ন তিনি এবং তাঁর পরিবারের উপর নেমে আসে। রুদ্ধশ্বাস কঠোর সামরিক শাসনের মধ্যে তিনি মাথা নত করেননি। মুক্তিযুদ্ধের শাণিত চেতনায় সামরিক শাসন বিরোধী লড়াইসহ নানান গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বিপ্লবী সুরেশ সেন অংশগ্রহণ করেন। এছাড়া বহু সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংস্থার সাথেও জড়িত ছিলেন।
সুরেশ চন্দ্র সেন তাঁর সারাজীবনের রাজনীতিতে কোনদিন আপস করেন নি। নীতি আদর্শকে সামনে রেখে তিনি সবসময় রাজনীতি করতেন। সামাজিক সাংস্কৃতিক এবং পেশাগত জীবনে তিনি অতুলনীয় সততা এবং সাহস দেখিয়ে দেশবাসীর ভালোবাসা অর্জন করেন। কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নানান কৃতি-প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল দেখার মতো। রাজনীতির বাইরে দেশের শিক্ষা, সামাজিক, সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে তিনি জড়িত থেকে প্রগতিশীল চিন্তার আলোর ধারাকে সবার মধ্যে ছড়িয়েছেন। যেটা এখনো সবার মধ্যে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক, পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্য মন্ত্রী ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়, কমরেড মোজাফফর আহমদ, মজলুম জননেতা মৌলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, কমরেড মণি সিংহ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দিন আহমদ, কমরেড জ্যোতি বসু, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, মৌলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ,সহ দেশ-বিদেশের কৃতী রাজনীতিবিদদের সাথে তার ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঙ্গনের কৃতী মানুষেরা সুরেশ চন্দ্র সেনকে ভালোবাসতো এবং কক্সবাজারের দলমত নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ তাঁকে আন্তরিকভাবে শ্রদ্ধা করতো। বিপ্লবী দেশপ্রেমের সারাজীবন পরীক্ষা দিয়ে ১৯৮১ সালের ১ মে স্ত্রী অর্চনা সেন, পুত্র বিশ্বজিত সেনসহ অংশ গুনগ্রাহী রেখে লোকান্তরিত হন। তাঁর স্ত্রী অর্চনা সেন ৩ ফেব্রুয়ারি ২০০৮ পরলোক গমন করেন। দুই পুত্র কক্সবাজার পৌরসভার সাবেক কমিশনার সত্যজিত সেন বাচ্চু (৬৬-৭১ পর্যন্ত প্রতিটি আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ছাত্র ইউনিয়ন নেতা) সাংবাদিক গবেষক বিশ্বজিত সেন, দুই কন্যা শিক্ষিকা দেবী সেন ও গোপা সেন পরিবার পরিজন নিয়ে কক্সবাজারের স্থায়ীভাবে বসবাস করছে।
ঋণী
১। বিনোদ বিহারী চৌধুরী, অগ্নিঝরা দিনগুলো, জানুয়ারি ২০১০, চট্টগ্রাম : শব্দচাষ।
২। পূর্ণেন্দু দস্তিদার, স্বাধীনতা সংগ্রামে চট্টগ্রাম:, প্রকাশকাল ১৩৭৪, চট্টগ্রাম: বই ঘর।
২। সুধাংশু দাশগুপ্ত, স্বাধীনতা সংগ্রামে সশস্ত্র বিপ্লবীদের ভূমিকা.,১৯৯০, কলকাতা।
৩। মালিক সোবহান, কক্সবাজার চরিত কোষ, জুলাই ২০০৭, কক্সবাজার সাহিত্য একাডেমী।
৪। প্রফেসর মোশতাক আহমদ, দেশের মুক্তিসংগ্রামের অগ্নিযুগের বিপ্লবী এডভোকেট সুরেশ সেন, বিজয় স্মারক ২০১২, জেলা প্রশাসন।
৫। কালাম আজাদ, মুক্তিযুদ্ধে কক্সবাজার: জানা-অজানা তথ্য, বিজয় স্মারক ২০১২, জেলা প্রশাসন, কক্সবাজার।
৬। বিশ্বজিত সেন, ‘৭১‘র মহান মুক্তিযুদ্ধ : শেকড়ের বাতিঘর, বিজয় স্মারক ২০১৪, জেলা প্রশাসন, কক্সবাজার।
৭। কালাম আজাদ, মুক্তিসংগ্রামে কক্সবাজার : প্রসঙ্গ রাজনীতি, বিজয় স্মারক ২০১৪, জেলা প্রশাসন, কক্সবাজার।
৮। কালাম আজাদ, ‘ভাষা আন্দোলনে কক্সবাজার’, ফেব্রুয়ারি ২০১৫, তৃতীয় চোখ।
এডভোকেট সুরেশ সেন এর ৪৫তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্য সবুজ বাংলা সংসদ কর্তৃক আয়োজিত স্মরণ ও আলোচনায় পঠিত মূল প্রবন্ধ।
যে ভ্রমণটি ইতিহাস হয়ে আছে
ঘটনাটি বেশ পুরনো। কোরিয়া থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছি খুব বেশী দিন হয়নি! আমি অবিবাহিত থেকে উজ্জীবিত (বিবাহিত) হয়েছি সবে, দেশে থিতু হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেশ কিছুক্ষণ... ...বাকিটুকু পড়ুন
আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন
মসজিদ না কী মার্কেট!
চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷
আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন
আকুতি
দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন
স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু
২-১ : আলিফ-লাম-মীম
আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন