somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আপসহীন এক সংগ্রামীর নাম বাদশা মিয়া চৌধুরী

০২ রা আগস্ট, ২০১৫ বিকাল ৩:৩৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে জাতীয় প্রেক্ষাপটকে ঘিরে এবং কক্সবাজার অঞ্চলে যত ধরনের যে রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে সবকটি আন্দোলনের এক নিবেদিত প্রাণ তিনি। উখিয়া উপজেলার হলদিয়া পালং ইউনিয়নের নলবনিয়া গ্রামের জমিদার আবদুল হাকিম সিকদার ও গুলমেহের বেগমের সন্তান তিনি। ১৯৩২ সালে জন্মগ্রহণকারী বাদশা মিয়া চৌধুরী ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় পালং আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে ১০ম শ্রেণিতে অধ্যয়ন করলেও পারিবারিক ও অসুস্থতার কারণে পটিয়া এ এস রাহাত আলী বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন। ১০ম শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে বাংলার আকাশে প্রবাহিত হয় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের হাওয়া। পালং আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে তার নেতৃত্বে একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ভাষার দাবির মিছিলে গুলি করে ছাত্রহত্যার প্রতিবাদে মিছিল হয়। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাজধানী ঢাকায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে মিছিলে গুলিতে ছাত্র হত্যার খবরটি ওই দিন রাত্রেই রেডিও এর মাধ্যমে খবর পায় পালং উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্ররা। ২২ ফেব্রুয়ারি উখিয়ায় ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশের আয়োজন করে তৎকালীন উখিয়া টেকনাফের একমাত্র উচ্চ বিদ্যালয় পালং আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা|
রাজধানী ঢাকায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবির মিছিলে খুনী নুরুল আমিন সরকারের নির্দেশে গুলি করে ছাত্র হত্যার খবরটি ওই দিন রাত্রে পেয়ে যান দশম শ্রেণির ছাত্র বাদশা মিযা চৌধুরী। ২২ ফেব্রুয়ারি প্রতিদিনের মতো পালং উচ্চ বিদ্যালয়ে এসে স্কুলের সহপাঠী বন্ধুদের সাথে আলাপ তৎক্ষনাৎ ক্লাস বর্জন করে ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে মিছিল ও উখিয়া থানা ঘেরাও করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সিদ্ধান্ত মোতাবেক বাদশা মিয়া চৌধুরী এর নেতৃত্বে পালং হাই স্কুলের শতাধিক শিক্ষার্থী নিয়ে মিছিল সহকারে আরাকান সড়ক হয়ে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ সেøাগান দিতে দিতে পায়ে হেঁটে উখিয়া থানা স্টেশনে যায়। এ সম্পর্কে বলতে বাদশা মিয়া চৌধুরী বলেন, এক পর্যায়ে উখিয়া থানায় কর্মরত পুলিশ সদস্যদেরকে বলা হয় যে, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলার সমর্থনে আপনারা আপনাদের কার্যক্রম বন্ধ করে আমাদের আন্দোলনকে সমর্থন করুন। নতুবা থানা উড়িয়ে দেয়া হবে’।পরক্ষণে থানায় কর্মরত পুলিশ সদস্যরা আমাদের সমর্থন জানালেও উখিয়া স্টেশন ঘুরে এসে দেখি থানার পুলিশ তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে। এ অবস্থায় আমরা থানায় গিয়ে লাঠি মেরে দরজা বন্ধ করি। অসংখ্য লাঠির আঘাতে থানার দরজা ফাটল হয়ে যায়।’ দীর্ঘদিন যাবৎ উক্ত ফাটল দরজা ভাষা আন্দোলনের আলামত হিসেবে বহাল ছিলো। তখন উখিয়া স্টেশনে জনতার উদ্দেশ্যে বাংলার ভাষার গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে ধারণা এবং রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানিয়ে বক্তব্য রাখেন বাদশা মিয়া চৌধুরী, মোহাম্মদ জাকারিয়া, নিরোধবরণ বড়–য়া, প্রিয়দর্শী বড়ুয়া, ললিত বড়–য়া প্রমুখ। ওই সমাবেশে ছাত্র হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং রাষ্ট্রভাষা বাংলা আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা করা হয়।

এছাড়া মিছিলে ছিলেন, মোহাম্মদ জাকারিয়া, ছালেহ আহমদ চৌধুরী (পরবর্তীতে কৃষক লীগ নেতা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন চৌধুরীর পিতা), প্রিয়দর্শী বড়ুয়া, এ কে আহমদ হোসেন (পরবর্তীতে এডভোকেট, বর্তমানে কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি), আয়ুব আলী, রশিদ আহমদ, আজিজুর রহমান প্রকাশ আজিরান মিয়া (পরবর্তীতে এডভোকেট), তোফায়েল আহমদ চৌধুরী (পরবর্তীতে এডভোকেট), ফরিদ আহমদ খোন্দকার (পরবর্তীতে ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন), আবদুল হক চৌধুরী (পরবর্তীতে উখিয়া আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক এবং উখিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক)সহ অনেকেই। সে সময় স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন চট্টগ্রাম জেলার বোয়ালখালী উপজেলার কাননুগোপাড়া নিবাসী লোকনাথ দে। ছাত্রদের ক্লাশ বর্জন, বিক্ষোভ মিছিল সমাবেশে শিক্ষকদের মৌন সম্মতি ছিলো।

১৯৫৬ সালে ম্যাট্রিক পাশ করার পর বড় ভাই আবদুল বারী সিকদার মারা যাওয়ায় পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারেন নি। মন দেন সমাজসেবায়। ১৯৫৭ সালে বৃহত্তর রত্মাপালং ইউনিয়ন বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে ১৯৬৩ হলদিয়া পালং ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন এবং স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ছিলেন এবং তার বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি করা হয়েছিলো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একজন সহচর হিসেবে ১৯৬৮ সালের দিকে উখিয়া আওয়ামী লীগের সংগঠিত করেন শমসের আলম চৌধুরী, আবদুল হক চৌধুরীসহ অন্যান্যদের সহায়তায়। ১৯৬৪ সালের কপ ও ৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, অসহযোগ আন্দোলনে একজন একনিষ্ট কর্মী ও সংগঠক হিসেবে দেশকে পাকিস্তান থেকে মুক্ত করার কাজে ঝাপিয়ে পড়েন এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ঝুঁকি নিয়ে গ্রামেগঞ্জে ঘুরে বেড়িয়েছেন। একাত্তরে কক্সবাজার মহকুমা সংগ্রাম কমিটির অন্যতম সদস্য হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের নয়টি মাস মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করেছেন। মাঝে ৫ মে কক্সবাজারের পরিস্থিতি অনুকূল দেখে আফসার কামাল চৌধুরী, মনিরুল হক চৌধুরী, এমএনএ নুর আহমদ প্রমুখের সাথে মিয়ানমারের টেকিবনিয়ায় আশ্রয় নেন। ওখানেই মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করার কাজ করেন এবং যুদ্ধের জন্য বাংলাদেশে আসা গ্রুপকে নিজের অস্ত্র তুলে দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতার ডাকে অন্যান্যকে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান। স্বাধীনতার পর ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন এবং পর পর পাঁচ বার হলদিয়া পালং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। দীর্ঘদিন উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। তিনি এখনো কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা কমিটির একজন সদস্য হিসেবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধরে রেখেছেন। জীবনের ক্রান্তিকালে এসেও তার আদর্শ থেকে এক চুল পরিমাণ চ্যুত হননি এখনো।
বিংশ শতাব্দীর আশির দশকের দিকে শুরু হওয়া কক্সবাজার জেলা বাস্তবায়ন আন্দোলনেও তিনি শরীক হন। তিনি কক্সবাজার জেলা বাস্তবায়ন কমিটির অন্যতম সদস্য হিসেবে কক্সবাজারকে জেলা হিসেবে রুপান্তরিত করেছেন অন্য অনেকের সঙ্গে। ১৯৮৪ সালের ১ মার্চ কক্সবাজার জেলা বাস্তবায়ন হয়।
১৯৮৯ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে উখিয়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নেন। কিন্তু ওই সময় স্বৈরাচার এরশাদ ক্ষমতায় থাকায় তার রাজনৈতিক সংগঠন জাতীয় পার্টি মনোনীত প্রার্থী নুরুল ইসলাম চৌধুরী প্রকাশ ঠান্ডা মিয়ার কাছে হেরে যান।
মরিচ্যা পালং উচ্চ বিদ্যালয়, নলবনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ ২টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পাতাবারী ইয়াহিয়া সুন্নিয়া মাদ্রাসা, হলদিয়া পালং ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্র নির্মাণ, হলদিয়া ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্স সহ সমাজসেবা ও উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে অবদান রাখেন।
দীর্ঘদিন মরিচ্যা পালং উচ্চ বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি ছিলেন এবং তার সময়েই ওই বিদ্যালয়ের অবকাঠামো উন্নয়ন সাধিত হয়। জনগণের দুর্দশা লাঘবে পাতাবারী নামক এলাকায় একটি বাজারও প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।

সর্বশেষ এডিট : ০২ রা আগস্ট, ২০১৫ বিকাল ৩:৩৫
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পেচ্ছাপ করি আপনাদের মূর্খ চেতনায়

লিখেছেন সত্যপথিক শাইয়্যান, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:৩৮

আপনারা হাদি হতে চেয়েছিলেন, অথচ হয়ে গেলেন নিরীহ হিন্দু গার্মেন্টস কর্মীর হত্যাকারী।
আপনারা আবাবিল হয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাড়াতে চেয়েছিলেন, অথচ রাক্ষস হয়ে বিএনপি নেতার ফুটফুটে মেয়েটাকে পুড়িয়ে মারলেন!
আপনারা ভারতীয় আধিপত্যের বিরুদ্ধে... ...বাকিটুকু পড়ুন

নজরুল পরিবারের প্রশ্ন: উগ্রবাদী হাদির কবর নজরুলের পাশে কেন?

লিখেছেন মাথা পাগলা, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৩:০১



প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে কাজী নজরুল ইসলামের দেহ সমাধিস্থ করা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশে। শনিবার বাংলাদেশের স্থানীয় সময় বিকেল ৪টে নাগাদ সেখানেই দাফন করা হল ভারতবিদ্বেষী বলে পরিচিত ইনকিলাব মঞ্চের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির আসল হত্যাকারি জামাত শিবির কেন আলোচনার বাহিরে?

লিখেছেন এ আর ১৫, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:৫৪


গত মাসের শেষের দিকে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পারওয়ারের ছেলে সালমান, উসমান হাদির সঙ্গে খু*নি ফয়সালের পরিচয় করিয়ে দেন। সেই সময় হাদিকে আশ্বস্ত করা হয়—নির্বাচন পরিচালনা ও ক্যাম্পেইনে তারা... ...বাকিটুকু পড়ুন

দিপুকে হত্যা ও পোড়ানো বনাম তৌহিদী জনতা!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:০৫


পাইওনিয়ার নিটওয়্যারস বিডি লিমিটেড (Pioneer Knitwears (BD) Ltd.) হলো বাদশা গ্রুপের (Badsha Group) একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। বাদশা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান কর্ণধার হলেন জনাব বাদশা মিয়া, যিনি একইসাথে এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

সাজানো ভোটে বিএনপিকে সেনাবাহিনী আর আমলারা ক্ষমতায় আনতেছে। ভোট তো কেবল লোক দেখানো আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।

লিখেছেন তানভির জুমার, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:২২



১০০% নিশ্চিত বিএনপি ক্ষমতায় আসছে, এবং আওয়ামী স্টাইলে ক্ষমতা চালাবে। সন্ত্রাসী লীগকে এই বিএনপিই আবার ফিরিয়ে আনবে।সেনাবাহিনী আর আমলাদের সাথে ডিল কমপ্লিট। সহসাই এই দেশে ন্যায়-ইনসাফ ফিরবে না। লুটপাট... ...বাকিটুকু পড়ুন

×