আমার বিদেশ ভ্রমন - ১ - পূর্বকথা
...সে প্রায় ১৬-১৭ বছর আগেকার কথা। লেখি লেখি করেও আর লেখা হয়নি। তো আজ ভাবলাম - লেখা শুরু করি, দেখি কতদূর যাওয়া যায়...
বাবা হুট করে কুয়েত চলে গেলেন। ২ বছরের কন্ট্রাক্ট কাজ। সেখানে কুয়েত প্রতিরক্ষা বাহিনীর সাথে কাজ করবেন। একা একা ছোট একটি ফ্লাট নিয়ে থাকেন। আর প্রতিদিন একবার ফোন দেন। তখন তো আর স্কাইপ, ভাইবার - ছিল না। ফোন কার্ড কিনে কিনে কথা বলতেন। নতুন দেশ, নতুন মানুষজন, নতুন চাকুরী - তারপর দেশটা হলো মরুভূমি, যেদিকে উনি তাকান বালু আর পাথরের রাজ্য।
এদিকে আমার এসএসসি পরীক্ষা শেষ হলো। খুব একটা খারাপ হয়নি, বায়োলজি নিয়ে যদিও ভয় ছিল, আমি আবার ভালো বায়োলজি বুঝতাম তো তাই! তো পরীক্ষা শেষ হবার সাথে সাথেই বাবা একদিন বললেন "আমি তোমার মামার সাথে কথা বলেছি, টিকেট পাঠাচ্ছি কিছুদিনের মধ্যে"। পাসপোর্ট করানো ছিল সবার। কিছুদিন পর ভিসাও হয়ে গেল। দেখতে দেখতে একদিন বিমানে উঠার দিন চলে এল।
যেদিন ফ্লাইট তার আগের রাতে, সবাই চলে এলাম নানুবাড়ী। রাতে সব খালাতো ভাইবোনরা মিলে গল্প আর আড্ডা। সবাই দেখলাম আমার থেকেও উত্তেজিত - যেন আমার লটারী লেগে গেছে। আমিও একসময় খুব উত্তেজিত ছিলাম, কিন্তু অপেক্ষা করতে করতে উত্তেজনা কিছুটা প্রশমিত যাই হোক প্রায় ভোর ৪টার দিকে ২/৩ টা গাড়ীতে করে এয়ারপোর্টের দিকে রওনা দিলাম। দেশী সংস্কৃতি রক্ষা করার জন্য আমরা ছিলাম যাত্রী ৩ জন, কিন্তু বিদায় দিতে এসেছে ১১-১২ জন
এয়ারপোর্টের বাইরে অনেক মানুষের ভিড়, ভেতরে দেখি মানুষের সংখ্যা অনেক কম। কারন সবাই আমাদের মতো - যাত্রী কম, শুভাকাংখী বেশী। এটাই তো হবার কথা। যাই হোক ইমিগ্রেশন শেষে, মামা বললেন "চলো আমার একজন বন্ধু এখানে কাজ করেন, ওর সাথে দেখা করে আসি"। গেলাম ঐ বন্ধুর সাথে দেখা করতে। কুশল বিনিময়ের পর উনি বললেন "সকালে তো নাস্তা করা হয়নি তোমাদের?", আমি মাথা নাড়লাম। এরপর উনি আমাদের নিয়ে গেলেন এয়ারপোর্টের দুইতলায় - লাউন্জে। সেখানে গিয়ে দেখি বিশাল ব্যাপার। টেবিল পর টেবিল খাওয়া-দাওয়ায় সাজানো। ফল-মূল, পাউরুটি, জেলী, মাখন, চা, কফি - কি ছিল না সেখানে। আমাদের বলা একদিক থেকে শুরু করতে - কিন্তু আমি আর আমার ভাই কিছুই খাইনি। কারন প্রথমত আমরা বাংগালীরা অনেক মুখচোরা। দ্বিতীয়ত দেশের বাইরে যাচ্ছিলাম, কিছুটা নার্ভাস ছিলাম, ক্ষুধা-টুধা সব গায়েব হয়ে গেছে। কিছুক্ষন ঘুরাঘুরি করে নিচে চলে এলাম।
সময় মতো গেট খুলে দেয়া হলে, আমরা প্লেনের উদ্দেশ্যে হাটা দিলাম। আমি কিছুটা মনক্ষুন্ন ছিলাম - আমার ইচ্ছা ছিল পুরানো দিনের মতো খোলা আকাশের নিচ দিয়ে হেটে হেটে প্লেন গিয়ে উঠব - কিন্তু এখন তো আর তেমনটি নেই। আমাদের একটি টানেলের মধ্যে দিয়ে হাটিয়ে নেয়া হলো।
ভেতরে খুব ছিমছাম। সমস্ত প্লেন জুড়ে "বিদেশ-বিদেশ গন্ধ" (যখন কেউ বিদেশ থেকে আসে, তখন তাদের লাগেজ খুললে একটা সুন্দর গন্ধ পাওয়া যায় - আমি এটা নাম দিয়েছি "বিদেশ-বিদেশ গন্ধ" ) । প্লেনের ভেতর এসি চলছিল পুরোদমে। আমাদের টিকেট ইকোনমি ক্লাসের। কিন্তু এরপরও বসতে কোন অসুবিধা হচ্ছিল না। আর সিটগুলো ছিল একদম সামনের দিকে - তো পা রাখারও কোন সমস্যা ছিল না। প্লেন ছাড়ার আরো ৩০ মিনিট বাকী, কিন্তু সাবধানের মার নাই তাই আমি সিটবেল্ট বেধেই বসে পড়লাম
প্লেন ছাড়ার ১৫-২০ মিনিট আগে দেখি মামার সেই বন্ধু এসে উপস্থিত! ঘটনা কি? উনিও কি আমাদের সাথে কুয়েত যাবেন নাকি ! উনি এসে সব ঠিকঠাক আছে নাকি জানতে চাইলেন, তারপর বললেন "সামনে অনেকগুলো সিটে খালি আছে, আপনারা সামনে এসে বসেন"। আমরা ৩ জন সামনে গিয়ে বসলাম। গিয়ে দেখি আরেক এলাহী কারবার - বিজনেস ক্লাসে আপগ্রড করায়ে দিয়েছেন। বিশাল চেয়ার, রীতিমত পা উঠায়ে বসা যাবে। বিজনেস ক্লাস বলতে গেলে পুরোটাই ফাকা। সিট ছিল ১৮-২০ টা, আমরা মানুষ বড়জোড় ৬-৭ জন। আমার ছোট ভাইতো উঠে গিয়ে জানালার পাশে বসল। ৫ মিনিট পর দেখি উঠে গিয়ে অপর পাশের জানালায় বসে - বুঝলাম সে এই কাজ পুরো রাস্তাতেই করবে।
একটু পর পাইলটের কন্ঠ শুনলাম। শুনে মনে হলো, যেন কুয়েত চলে আসছি অলরেডী । তার প্রায় ১০ মিনিট প্লেন নড়া শুরু করল। কিছুটা অধৈর্য্য হয়ে যাচ্ছিলাম বসে থাকতে থাকতে। এয়ার হোস্টেসরা খালি একবার এদিকে যায়, আবার ওদিকে যায়। তারপর রানওয়েতে গিয়েও আবার অপেক্ষা। ঠায় দাড়িয়ে আছে প্লেন - নড়েও না আর চড়বেতো নাইই! বোর হতে হতে শেষ হব হব - তখন দেখি প্লেন চলা শুরু করল। আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম - খুব খুব আস্তে আস্তে দৃশ্যপট বদলাচ্ছে। মনে হচ্ছে রিকশায় উঠেছি ।
তারপর প্লেনের গতি আরো একটু বেড়ে গেল, আমি ভাবলাম ব্যাপার না, যেন জীবনে আরো কতবার প্লেন চড়েছি শয়তান ছোট ভাইয়ের জন্য ঠিক মতো জানালা দিয়ে কিছু দেখতেও পারছিলাম না, সামনের দিকে হেলে হেলে দেখতে হচ্ছিল। হঠাৎ করে প্লেনের গতি পুরোপুরি বেড়ে গেল - আমি ঝপাৎ করে চেয়ারে মাঝে ঢুকে গেলাম। চেষ্টা করেও সামনের দিকে আসতে পারছিলাম না। জানালার দিকে তাকিয়ে দেখি দুনিয়া ছোট হয়ে আসছে। যেন লেগো দিয়ে বানানো খেলাঘর।
(চলবে)
ছবি: গুগল
******************************************
আমার বিদেশ ভ্রমন - ১ - পূর্বকথা
******************************************
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই জুন, ২০১৪ দুপুর ১:২৬