somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ডিজিটাল আব্বা

১৩ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ৮:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ডিপার্টমেন্টের হেডস্যার বললেন, ‘নেক্সট সেমিস্টারে তোমার আর কন্টিনিউ করার দরকার নাই। তুমি অন্য কোথাও দেখো।’

আমি বললাম, ‘স্যার, আর কোথায় দেখব! এত ভালো একটা ইউনিভার্সিটি আমি ছাড়ব না। আর আপনার মতো টিচার! আমাকে লাস্ট চান্স দেন, স্যার।’

‘গতবার আমি তোমাকে লাস্ট চান্স দিয়েছি। লাস্ট চান্স কয়বার হয়?’ স্যারের মুখে মৃদু হাসি।

‘এবিসি স্যার (মানে আবুল বাশার চৌধুরী) তো স্যার, আমাকে তিনবার লাস্ট চান্স দিয়েছেন।’

হেডস্যার হাসলেন, ‘তুমি টার্ম ফি দাও নাই। অ্যাবসেন্ট ছিলা প্রায় সব দিন। ফাইন দিয়ে এডমিশন নেওয়ার ডেটও পার হয়ে গেছে।’

‘ব্যাক ডেটে নেন, স্যার।’

‘তুমি এক কাজ করো। তোমার আব্বাকে ডেকে আনো। উনি এসে যদি বন্ড দেন, তাহলেই তোমাকে আমরা পরের সেমিস্টারে অ্যালাউ করব। যাও।’ স্যারের হাসি মিলিয়ে গেল। তাঁর মুখটা কঠিন মনে হচ্ছে। আমি ঘামছি। অথচ স্যারের রুমে এয়ারকন্ডিশনার। মাথার ওপরে ফ্যানও ঘুরছে।

আব্বা আসলে নিয়মিত টাকা দিয়েছেন। টার্ম ফি, সেশন ফি। আমি সেসব ভার্সিটিতে জমা দিইনি। এখন আব্বাকে কীভাবে বলব, আপনাকে স্যারের সঙ্গে দেখা করতে হবে। এটা অসম্ভব। এর আগে আব্বা আমার কাছে টাকা জমা দেওয়ার রসিদ চেয়েছেন। সেটা বানিয়েছি। রসিদ বানানো খুব সোজা। কম্পিউটারে বানিয়ে লাল-হলুদ কাগজে প্রিন্ট নিলেই হলো। পরীক্ষার প্রগ্রেসিভ রিপোর্ট চেয়েছেন। সেটাও বানিয়ে নিয়ে গেছি। আব্বা জানে আমার ফিফথ সেমিস্টার চলছে। আসলে আমার অবস্থা খুবই খারাপ। থার্ড সেমিস্টার পার হতে পারছি না।

আচ্ছা, এত কিছু যখন নকল করতে পেরেছি, একটা আব্বাও নকল করতে পারব। আমাদের বন্ধুদের মধ্যে আছে মোস্তফা কামাল, তাকে দেখতে লাগে বাবা-বাবা। সে একটা গ্রুপ থিয়েটারে নাটক করার চেষ্টা করছে। কাজেই সে পেশাদার অভিনেতা। আপাতত আমার আব্বার চরিত্রে তাকে অভিনয় করতে হবে।

কামালকে নিয়ে গেলাম স্যারের কাছে। ‘স্যার, আব্বা এসেছেন, স্যার।’

‘আপনার ছেলে যে ক্লাস করে না আপনি জানেন?’ স্যার বললেন।

মোস্তফা কামাল বিব্রত হওয়ার ভঙ্গি করে বলল, ‘হারামজাদা! তুমি বাপের নাম ডুবাবা। ক্লাস করো না, রোজ বাইর হও সাইজা-গুইজা, কই যাও?’

আমি বলি, ‘আব্বা, গালি দিচ্ছেন কেন? এটা আমার ভার্সিটি, উনি আমাদের হেডস্যার। ভদ্রতা বজায় রাখেন।’

‘হারামজাদা, তোকে আজ মাইরাই ফেলব। তুমি ক্লাস করো না!’ মোস্তফা পায়ের স্যান্ডেল তুলছে। (হারামজাদা, এইটা ওভারঅ্যাক্টিং হইতেছে। তুই খালি বাইরা, তোরে আজকা খাইছি।)

স্যার ভীষণ বিব্রত। বললেন, ‘না, না। আপনি শান্ত হোন। আপনার ছেলে তো টার্ম ফিও দেয় না!’

‘টার্ম ফি দেয় না! হারামজাদা পড়াশোনা করে না, এইটার মানে বুঝলাম। কিন্তু টাকা তো আমি অরে নিয়মিত দেই। টার্ম ফি দেস নাই ক্যান, ওই …’

আমি কাঁচুমাচু হয়ে বলি, ‘খরচ আছে না!’

মোস্তফা আমার কান ধরে বসে। (হারামজাদা বাইরে আয়। তোর কান যদি আমি টেনে লম্বা না করছি!)

এই সময় স্যারের কাছে ফোন আসে। স্যার ধরেন, ‘হ্যালো। জি, জামান সাহেব, একটু ব্যস্ত। আপনার প্রিয় ছাত্রকে নিয়েই বসেছি। আসবেন? আসেন।’

জামান সাহেব আসছেন। স্যার ফোন রেখে মোস্তফার দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘আপনার সঙ্গে নাকি জামান সাহেবের পরিচয় আছে। আপনার সঙ্গে দেখা করার জন্যই আসছেন।’

আমি প্রমাদ গুনি। মোস্তফার সঙ্গে জামান স্যারের পরিচয় আছে, নাকি আব্বার সাথে! দুটোই সমান বিপদ ডেকে আনবে।

‘স্যার, আমরা আসি। আব্বার কাজ আছে। আব্বা, তোমার না কাজ?’

মোস্তফাটা একটা গাধা। বলে, ‘না তো, কাজ আবার কী। তোরটা এস্পার-ওস্পার না কইরা ছাড়তেছি না। প্রফেসর সাব, আমার ছেলেরে আপনার হাতে তুইলা দিলাম, আপনি মারেন-কাটেন, খালি নামটা কাইটেন না।’

ততক্ষণে জামান স্যার এসে হাজির। ‘কই, হাশেম সাহেব কই?’

‘এই যে হাশেম সাহেব।’

জামান স্যার বলেন, ‘উনি তো হাশেম সাহেব নন!’

আমি বলি, ‘স্যার। ইনিই হাশেম সাহেব। আমার আব্বা।’

জামান স্যার বলেন, ‘তোমার আব্বাকে আমি খুব ভালো করে চিনি। তার সঙ্গে আমি একসঙ্গে মালয়েশিয়া গিয়েছিলাম।’

আমি বলি, ‘স্যার, আমার আব্বাকে আপনি কী করে চিনবেন! হাশেম সাহেব নামে তো কত লোকই আছে ঢাকায়। আর তার ছেলের নাম হাসনাত হতেই পারে।’

‘কিন্তু তোমার আব্বা সঙ্গে যে মুভি ক্যামেরাটা নিয়ে গিয়েছিলেন, সেখানে তোমাদের পারিবারিক ভিডিও অনেক দেখেছি। হাসনাহেনা তোমার বোন তো? তার সঙ্গে আমার ছেলের বিয়ের কথাও অনেক দূর এগিয়েছে।’ (ইস, আমি ফ্যামিলির খবর কিছুই কেন রাখি নাই!)

মোস্তফা উঠে পড়েছে। সে কি পালাতে চায়!

আমি ছাড়ার পাত্র না। খড়কুটো আটকে ধরার মতো করে বলি, ‘না, হাসনাহেনা বলে আমার কোনো বোন নাই। আপনি, স্যার, ভুল করছেন।’

স্যার বলেন, ‘হাশেম সাহেব, আপনার স্ত্রীর নামটা বলুন তো। আমাদের ফরমে ছেলের পিতা-মাতা দুটো নামই লিখতে হয়। আমার সামনে কম্পিউটারের পর্দায় ওর বাবা-মা সব নামই আছে। নিজের স্ত্রীর নাম বলতে পারেন না?’

আমি বলি, ‘গুলশানারা। আব্বা বলো। আব্বাদের আমলে স্বামীর নাম, স্ত্রীর নাম মুখে আনতে মানা ছিল।’

মোস্তফা কামাল ধপাস করে পড়ে যায়। চোখ থেকে তার চশমা ছিটকে পড়ে। এই হারামজাদার আরেকটা সমস্যা আছে। সে চশমা ছাড়া দেখতে পায় না।

আমি দিলাম এক দৌড়। থাক হারামজাদা, অভিনয় পারিস না, স্ক্রিপ্ট মুখস্থ নাই, তোর ঠেলা তুই সামলা!

এবার আরেকজনকে আব্বা বানাতে হবে। তার আগে জামান স্যারকে সরাতে হবে অকুস্থল থেকে। আমার বোন হাসনাহেনাই সেটা পারবে। আমি বলি, ‘আপুসোনা, একটা কাজ করে দাও না। তোমার হবু শ্বশুর জামান স্যারকে একটু এনগেজড রাখো।’

ব্যবস্থা পাকা। জামান স্যার এখন গেছেন ইউনাইটেড হাসপাতালে পুরো শরীর চেকআপ করাতে। হাসনাহেনা দাঁড়িয়ে থেকে নিজে থেকে তাঁকে সবগুলো টেস্ট করাচ্ছে।

এবার আমাদের বন্ধুর মামা নাট্যশিল্পী মশিউল আলম গেছেন আমার আব্বা সেজে। মশিউল বললেন, “জামান সাহেবের কাছে আমি সব শুনেছি। আমার মাথা কাটা যাচ্ছে। গুলশানারাও তো লজ্জায় মুখ দেখাতে পারছে না। বলছে, ‘তোমার কী ছেলে পেটে ধরেছি।’ এই হাসনাত, আর কোনো দিন এই রকম করবি?”

আমি বললাম, ‘না আব্বা। আরও? যা শিক্ষা হবার হয়ে গেছে।’

‘মনে থাকে যেন …’

বলার সঙ্গে সঙ্গে আমার অরিজিনাল আব্বা হাশেম সাহেব ও আমার অরিজিনাল আম্মা গুলশানারা পাশের ঘর থেকে এসে উঁকি দিলেন। স্যার নিজেই ফোন করে তাদের আগে থেকে ডেকে এনে পাশের রুমে বসিয়ে রেখেছিলেন। আজকালকার টিচারগুলান এই রকম ফাজিল প্রকৃতির হয়ে থাকে! বলেন, এই দেশ কীভাবে ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করবে, যদি শিক্ষক ও অভিভাবকেরা ছাত্রদের সহযোগিতা না করে?

মশিউল টের পায়নি, বলেই চলেছে, ‘ওর মা তো সারা দিনরাত কাঁদছে। নকল আব্বা বানিয়েছে ছেলে …।’

কান্নার শব্দ উঠল। আমি তাকিয়ে দেখলাম আমার সত্যিকারের আম্মার চোখে সত্যিকারের জল।



ভাল লাগলে কমেন্টাইয়েন।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ৮:০৩
১১টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৪৪



বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

কেন বিএনপি–জামায়াত–তুরস্ক প্রসঙ্গ এখন এত তপ্ত?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে একটি পরিচিত ভয়–সংস্কৃতি কাজ করেছে—
“র”—ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে রাজনীতিতে গুজব,... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিশ্চিত থাকেন জামায়েত ইসলাম এবার সরকার গঠন করবে

লিখেছেন সূচরিতা সেন, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৪২


আমাদের বুঝ হওয়ার পর থেকেই শুনে এসেছি জামায়েত ইসলাম,রাজাকার আলবদর ছিল,এবং সেই সূত্র ধরে বিগত সরকারদের আমলে
জামায়েত ইসলামের উপরে নানান ধরনের বিচার কার্য এমন কি জামায়েতের অনেক নেতা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×