কাল বাবুর জন্মদিন হবে। কত যে আয়োজন। ঘর সাজানো হচ্ছে রঙ্গিন বেলুনে, ফিতেয় নানা রকম সজ্জায়। সারাবাড়ি গম গম উৎসব মুখর আনন্দে। বিকেলের দিকে আসলো বিশাল তিন তলা কেক। সেই কেক গাড়ি থেকে নামিয়ে ভেতরে ধরে আনতেও লাগলো তিন জন মানুষ। কেক দেখে আমি মুগ্ধ। গোলাপী সাদা মিশেলের বিশাল গোলাকার কেকের ওপরটা। তার উপরে আবার কলাম করে করে আরও দুইটা গোলাকৃতি কেক বসানো। একদম উপরেরটায় এক ঘোড়ার গাড়িতে বসে আছেন অচিন দেশের কোনো অজানা প্রিন্সেস। আমি মুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম সেই কেকটার সামনে। আমি যতদিন আমার বাবার বাড়িতে ছিলাম প্রতি জন্মদিনেই দাদু কেক আনতেন। সাথে জামা এবং উপহারও থাকতো তবে এমন বিশাল কেক আমি আমার জীবনে এই প্রথমই দেখলাম। আমার জন্মদিনগুলো নিয়ে সবচাইতে বেশি মেতে উঠতেন দাদু। এত আত্মীয় অভ্যাগতদেরকে দাওয়াৎ করাটা তার পছন্দ ছিলো না বটে তবে সবচেয়ে এক মজার ব্যাপার ছিলো আমার জন্মদিনে দাদু আমাকে নিয়ে যেতেন এক আজব জায়গায়। সেখানে আমার থেকেও ছোট ছোট বাচ্চারা ছিলো। ওদের বাবা মা কেউ নেই। কয়েকজন মহিলা যারা কিনা ওদের সাথে রক্তের বাঁধনে বাঁধা নয় তারাই দেখা শোনা করতেন তাদের। সেই বাড়িটাতে ঢোকার গেটের মুখে লেখা থাকতো করিমুন্নেসা এতিমখানা। আমি আর দাদু ওদের জন্য নিয়ে যেতাম বিরিয়ানী আর মিষ্টি।
এই জন্মদিন উপলক্ষ্যে বাবুর জন্য সেই জামাটা বানানো হয়েছিলো সেটাও ছিলো ঐ কেকের প্রিন্সেসের জামার হুবুহু একই ডিজাইন। বাবুটাকে যখন মুকুট পরিয়ে ঐ জামায় সাজিয়ে আনা হলো মনে হচ্ছিলো যেন স্বর্গ থেকে নেমে আসা এক দেবশিশুই। কিন্তু এত লোক জন অতিথি অভ্যাগতদেরকে দেখে তার শুরু হলো কান্না! এমনই কান্না যে সকলের কান ফাটে আর একটু হলে। সে কিছুতেই কেক কাটবেনা, ছুরি ধরবেনা। যতই মা কোলে নিয়ে ওকে দিয়ে কেক কাটাতে চায় সে ছুরি ফেলে উলটা দিকে মুখ ফিরিয়ে হাত পা ছুড়তে থাকে। শেষ পর্যন্ত কোনো রকমে মায়ের হাত দিয়েই কেক কাটার পালা সাঙ্গ করতে হলো। কেক কাটা, ডিনার এসবের পরেও ছিলো একজন বিশেষ অতিথি শিল্পীর সঙ্গীতের আয়োজন।
অনুষ্ঠান শেষ হতে বেশ রাত হলো। ড্রইংরুমের এক কোন ভরে উঠলো নানা রকম উপহারে। অতিথিরা চলে যেতেই বাবা, মা এবং নতুন বাবার মা সবাই মিলে বসলো সে সব উপহার দেখতে। নানা রকম ব্যাটারী চালিত হাতী ঘোড়া, বাঘ ভালুক ও নানা রকম খেলনার মাঝে অবাক হয়ে দেখলাম আমি এক প্রমান সাইজ ডল পুতুল। পুতুলটা কি সুন্দর। সবুজ চোখের মনি ঢাকা পাপড়ি একটু নাড়া দিলেই বুঁজে ফেলে। হালকা গোলাপি রঙ তার ঠোঁট। আমি অবাক হয়ে সেটাই দেখছিলাম। হঠাৎ নতুন বাবার মা আমার হাত থেকে নিয়ে নিলেন পুতুলটা। বললেন প্যাকেটে তুলে রাখো। নষ্ট হয়ে যাবে। হঠাৎ ভীষন অপমান আর অভিমানে লাল হয়ে উঠলাম আমি। সেই অপমানটা মনে পড়লে আজও গা শির শির করে। বুকের ভেতর বয়ে যায় জ্বলে যাওয়া উষ্ণ প্রস্রবন!
এর দেড় মাস পরেই আসলো আমার জন্মদিন। আশা করেছিলাম প্রতিবারের মত মা রাত ১২ টায় উইশ করবে কিন্তু মা মনে হয় সেবারে ভুলেই গেলেন আমার জন্মদিনের দিনটা। বাড়ি ফিরতে সেদিন মা বাবার অনেক রাত হলো । আমি অন্যান্য দিনের মতই মা বাবার ফেরার অপেক্ষায় জেগে ছিলাম তবে সেদিন বেরিয়ে আসলাম আমার নিজের শোবার ঘর থেকে। অত রাতেও আমাকে জেগে থাকতে দেখে মা ভুত দেখার মত চমকে উঠলেন। তারপর ভীষন বিরক্ত হয়ে তার টকটকে লাল রক্ত চক্ষু নিয়ে চিৎকার করে উঠলেন, এত রাতেও ঘুমাওনি কেনো? কাল সকালে স্কুল আছে না! যাও ঘুমাতে এখুনি। আমি ভয় পেয়ে দৌড়ে পালালাম। সারারাত আমি সেদিন দু'চোখের পাতা এক করিনি। ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়লাম। স্কুল যাবার সময় পার হয়ে যেতেও উঠছিনা দেখে শিউলি আমাকে ডেকে উঠালো। মা বাবা এবং বাবু সকলেই মনে হয় তখনও ঘুমিয়ে । কোথাও তাদেরর কোনো সাড়া পেলাম না। যখন বের হবো ওবাড়ি থেকে দাদু ফোন করলেন। ফোন কানে দিতেই উনি বললেন, শুভ জন্মদিন দাদুভাই। আজ বিকালে তোমাকে এ বাড়িতে নিয়ে আসবো । রেডি থেকো কিন্তু। আমি কোনো কথার উত্তর দিতে পারলাম না। ফুঁপিয়ে উঠলাম। স্কুল যাবার পথে গাড়িতে আমার কান্না দেখে ড্রাইভারচাচু বললেন, কাইন্দো না মা । পৃথিবীতে চক্ষের জলের কুনো দাম নাই। শক্ত হও। লোহার মত শক্ত। পাষানের মত কঠিন। আমার মনে পড়লো করিমুন্নেসা এতিমখানার শিশুদের কথা। দাদু বলেছিলেন ওদের বাবা মা নেই। আমার তো সবই আছে। বাবা, মা, দাদু, দীদা তবুও...
স্কুলে এসে জানতে পাই আন্তঃ জেলা সাংস্ক্বতিক প্রতিযোগীতার কথা। আমাদের স্কুলের কিছু মেয়েদেরকে সিলেক্ট করা হয়েছে। সিলেক্ট করেছেন মুনমুন আপা তার দলীয় নৃত্যের একজন অংশগ্রহনকারী হিসাবে আমাকেও। তিন মাস তালিম দেওয়া হবে। সেই প্রথম ওমন নুপুর নিক্কনের ছমছম গা শিউরে ওঠা ধ্বনীর সাথে পরিচয়। ভারী ছোট ছোট ধাতব পাতের মাঝে ছোট ছোট বলগুলো কি করে ওমন মন কাঁড়া আওয়াজ তোলে ভেবেই পাইনি আমি। আমি মন দিয়ে মুনমুন আপার কথা শুনি। তার শিখিয়ে দেওয়া তাল মুখস্ত করি।
ধা ধিন ধিন ধা, না তিন তিন না, তে টে ধিন ধিন তা....সোম, ফাঁক, তবলা, বোল এসবের মাঝে আমি নতুন এক জগতের সন্ধান পেয়ে যাই। ঘুমের মাঝেও আমি বিড় বিড় করি, ধা ধিন ধিন ধা, না তিন তিন না..........
বেহালা পড়ে থাকে ঘরের কোনে আমি তখন নতুন নেশায় মত্ত। মাকে জানাই আমি পাকাপাকি ভাবেই নাচ শিখতে চাই। মা রাজী হন না। আমি হাল ছাড়িনা। একদিন ছুটির দিনে চুপি চুপি ফোনে যোগাযোগ করি ঝুমকি ফুপুর সাথে। ঝুমকি ফুপুর কথার অবাধ্য হবে এ বাড়ির কেউ? কার ঘাড়ে কয়টা মাথা? এরপর আমি মুনমুন আপার বাসায় যেতে শুরু করি প্রতি সপ্তাহে দু'দিন নিয়ম করে। বাকী দিনগুলোতে নিজে নিজেই চলে চর্চা। মুগ্ধ হয়ে দেখি আমি উনাকে। কি কঠিন ছন্দে নেচে চলেন উনি। প্রতিটা মুদ্রা, তাল, লয়, ছন্দের এক অদ্ভুত ধ্বনি ওঠে। আমার কিছুতেই ওমন হয় না। কিন্তু নিরলস প্রচেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখি না আমি। ১৩ বছর বয়সে মুনমুন আপার কাছে আমার যে হাতে খড়ি তা চলে আরও প্রায় বছর তিনেক। আমার আগ্রহ আর অধ্যবসায় দেখে উনি আমাকে বলেন বিশ্ব ভারতীতে এডমিশন নিতে। উনার কাছে আমি মুগ্ধ হয়ে শুনি বিশ্বভারতীর কথা। বিশ্বভারতীর পাঠ ভবন, শিক্ষা ভবন, বিদ্যা ভবন, আম্র কুঞ্জ, ছাতিমতলা আমার অদেখা চোখেও স্বপ্ন হয়ে ঘোরে আর আমি ঘুরে ঘুরে বেড়াই সেই অনাবিল শান্তির শান্তি নিকেতনের সবুজ ঘাসে ঘাসে।
...............
এই স্বপ্ন পূরণ হতে খুব বেশি কাঁঠ খড় পোড়াতে হলো না। তবে আমার এই স্বপ্নের দেশে যে স্বপ্ন পূরণে আমি এসেছিলাম সেই স্বপ্ন পূরণের আগেই আমার সাথে দেখা হলো হয়তো বা নিজের মনের অজান্তেই স্বপ্নে দেখা কোনো স্বপনকুমারের। সেই পরিচয়, সেই প্রথম দেখার ক্ষন, সেই প্রথম ভালো লাগা, ভালোবাসা মনে পড়লেই আজও নিজের দুগালে ছড়ানো আবীর দর্পন ছাড়াও দেখতে পাই আমি। সেই গল্পটা না হয় পরের লেখাতেই বলি....