মা বলতেন, নোলা, নোলা, নোলা। এত্ত খায় তবুও নোলা কমে না, দুই চক্ষে যা পড়বে তাই খাওয়া চাই...কুটি ভেঙ্গে দুটি করার ক্ষমতা নেই অথচ সাতবেলা রাশ রাশ খাওয়া। রাক্ষসী খাই খাই স্বভাব। বাবারে বাবা, অবাক হয়ে যাই! মনে হয় পেটে রাক্ষস ঢুকেছে! যত্তসব! এই বয়সে এত খাই! এক পা কবরে দিয়ে রয়েছেন তবুও খাই খাই স্বভাব যায় না। সেই রাত থাকতে উঠেই মুড়ি চাবাচ্ছেন, ছোলা চাবাচ্ছেন, পান্তা থেকে শুরু করে পোলাও কোর্মা কালিয়া কোপ্তা কিচ্ছুতেই অরুচি নেই। সর্ব সংসার গিলে খাবেন উনি। বিশ্ব বঞ্মান্ড গিলে খাবেন, সবার আগে খাবেন এই আমাকেই। হাড় জ্বালিয়ে খাবেন আমার। রক্ত, মাংস হাড্ডি চুষে খাবেন....
কি সর্বনাশ! মাকেই খেয়ে ফেলবেন! চমকে উঠতাম আমি! অনর্গল বকে চলতেন মা। কোনো রকম দাঁড়ি, কমা, যতি চিহ্নের ধার না ধেরেই অনর্গল বকে যেতেন তিনি। কাকে শুনাতেন তা বুঝতাম না আমি। আশে পাশে ধারে কাছে নিজেকে ছাড়া আর কাউকেই দেখতে পেতাম না সে সব সময়ে। সকাল ৮ টায় বের হয়ে সেই রাত ১০টায় বাড়ি ফিরতেন বাবা। বোনেদেরও সব বিয়ে হয়ে গেছে। মধ্যবিত্ত কম বেতনের সরকারী চাকুরে বাবার সংসারে মাকে সাহায্য করবার মত কোনো কাজের লোকজনও ছিলো না। মায়ের গয়না আর সঞ্চয় যা ছিলো বড় ২ বোনকে বিয়ে দিতে গিয়ে প্রায় সবই নিঃশেষ হয়ে শূন্যের কোঠায় ঠেকেছিলো। বড় ভাইয়া তার বিয়ের এক বছরের মাথায় আলাদা সংসার তুলেছে ভিন্ন শহরে। সংসারে সেই সূর্য্যদ্যয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত মা একাই সব দিক সামলাতেন। বাঁতের ব্যাথা আর ক্রনিক শ্বাসকষ্টে প্রায়ই হাঁপিয়ে উঠতেন তিনি তবে কর্মবহুল দিনগুলোতে প্রায় সকাল থেকে রাত অব্দি যখন তখন চলতো তার শাপ শাপান্ত, চেপে রাখা রাগের বহিঃপ্রকাশ।
-আমারও কপাল। সোনা দিয়ে বান্ধানো কপাল আমার! ওরে হীরা দিয়ে বান্ধানো! সাতকূল গিয়ে এক কূলে ঠেকা এই আপদ এসে জুটেছে আমার ঘাড়ে। কেন এত যে তোর পেয়ারের তিন কন্যা আছেন তাদের কাছে থাকতে পারিস না!! যত দরদ তো কথায় কথায় উথলে ওঠে তাদের জন্য! থাকতে পারিস না কেন তাইলে তাদের কাছেই! থাকবি কেমন করে ! এই হাতীর খোরাক যোগাবে কে? দেবে দু'দিনের মাঝেই লাত্থি দিয়ে বের করে.... কেনো? গেছিলি না ? তেজ দেখায় যে লম্ফ দিয়ে গেলি সেবার, সাত দিন না পেরুতেই তো ফিরে আসলি? নাহ উনার স্বামীর ভিটা ছাড়া মন টিকে না, নিজের পালঙ্কে না শুলে ঘুম আসে না। আসল খবর তো জানাই আছে, কাক চিল বসতে না পারা কুরুক্ষেত্রের সে সংসারে দু'দিনও টিকতে পারিস নাই। জানি জানি সবই জানি। জানতে কিছুই আর বাকী নাই আমার। সবাইকে চেনা আছে। যেমন মা তেমনি কন্যারাও....
অবাক হয়ে শুনতাম আমি ! কখনও মেঝের উপর উপুড় হয়ে দুগালে হাত দিয়ে, কখনও বা পড়ার টেবিলে বসে বসে পেন্সিল মুখে। কখনও বা দুপুরের খাবারের পর বাধ্যতামূলক ঘুম দুপুরের বিছানায় ঘুমুতে যাবার আগে ঘুম ঘুম অথবা নির্ঘুম চোখে। মা যখন বলতেন, রাক্ষসী খাই খাই স্বভাবের কমতি নেই বা মনে হয় পেটে রাক্ষস ঢুকেছে, চমকে উঠতাম আমি! মনে মনে কল্পনায় ভয় পেয়ে যেতাম যে আমার অশীতিপর বৃদ্ধা দাদীমার চিমশে পড়া পেটের মাঝে তিন/চারটা রাক্ষস লাফালাফি করছে। অথবা মা যখন বলতেন, দাদীমা নাকি এক পা কবরে দিয়ে আছেন, কল্পনায় দেখতে পেতাম একটি খোলা কবরের মাঝে হাড় জিরজিরে লিকলিকে পা ডুবিয়ে মিটমিটে চোখে বসে আছেন দাদীমা! ভয়ে শিউরে উঠতাম আমি। মাঝে মাঝে ভাবতাম এমন লিকলিকে দাদীমাকে মা হাতীর খোরাক যোগান বলেন কেনো? দাদীমা কি হাতী? হাতীরা তো কলাগাছ খায়। দাদীমাকে তো কখনও কলাগাছ খেতে দেখিনি।
কতই বা বয়স ছিলো তখন আমার? ১০/১২ হবে। সকালে স্কুল যাবার সময় দেখতাম, দাদীমা তার নিজের বিছানায় বসে জুলজুল চোখে তাকিয়ে আছে। স্কুলব্যাগটা কাঁধে নিলেই মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে হাত ইশারায় কাছে ডাকতো দাদীমা। মুখে লেগে থাকতো ফোঁকলা দাঁতের এক মুখ মন ভোলানো হাসি। আমি এমনিতে তাকে বেশ পছন্দই করতাম তবে ভুলেও সেই মন ভুলানো হাসির ফাঁদে পড়তাম না আমি কারণ কাছে গেলেই দাদীমা তার শীর্ণ হাতে খপ করে টিফিন বক্স খুলে যা পাবেন তাই তুলে নেবেনই এ কথা ততদিনে জানা হয়ে গিয়েছিলো আমার। আর এ দৃশ্য মা যেদিন প্রথম দেখেছিলেন সেদিন তো পুরাই রণচন্ডিনী মূর্তী ধারণ করেছিলেন উনি। সেদিন থেকেই কড়া নিষেধ ছিলো স্কুল টাইমে দাদীমার আশে পাশে না ভেড়ার।
দাদীমাকে ঠিক বুঝতাম না আমি। জন্ম থেকেই একই রকম দেখে এসেছি দাদীমাকে। লিকলিকে শরীর, খনখনে গলা। হাত, পা, মুখের চামড়া কুঁচকে ঝুলে পড়েছে। উঠে দাঁড়ালেও হাঁটতো ঝুঁকে ঝুঁকে। কিছু পরে পরেই খাবারের সন্ধানে রান্নাঘরে ঢুকতো বা খাবার ঘরের আশে পাশে ঘুর ঘুর করতো। তাকের উপর তুলে রাখা মুড়ির টিন, টোস্ট বিস্কিটের শূন্য টিন হাতড়াতো। সংসারে তেমন স্বচ্ছলতা না থাকায় প্রায় দিনই বিস্কিট বা মুড়ির টিন ফাঁকা থাকতো। তারপরও দাদীমা ক্লান্তিহীন ভাবে একের পর এক খুঁজে চলতেন একটু বা একমুঠো খাবার। সম্ভাব্য সকল স্থানে খোঁজা শেষ হলেই মায়ের নানা কটুক্তি স্বত্বেও বা শত অবহেলার পরেও তারই স্মরনাপন্ন হতেন।
- ও বউ দে না দু' টুকরো শশা কুঁচিয়ে ... অধিকাংশ দিন মা তার কথায় কান দিতেন না। দাদীমা ঘ্যান ঘ্যান করতেন, " দে না এক মুঠো মুড়ি তেল হাত বুলিয়ে? " সংসারের বহুমুখী কাজের মাঝে হেঁসেল নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন মা। সংসারের বেহাল অবস্থায় বা কোনো এক অজ্ঞাত কারণে এ সংসার নিয়ে খুব একটা সুখী ছিলেন না তিনি। তবুও আমার মনে হয় তার সকল অশান্তির মাঝে বিরাট বড় অংশ জুড়েই ছিলো দাদীমার এই খাই খাই বিরক্তিটা। মুখ ঝামটে উঠতেন মা, " আচ্ছা দেখছেন না? এখন আমি মাছ কুঁটছি? এই ছাই মাখা হাতে এক রাশ কুঁচো মাছ ছেড়ে আমি মুড়ি মাখতে বসবো! আপনি কি আপনার আক্কেলের মাথা মুন্ডু খেয়েছেন? যান ঘরে গিয়ে শুয়ে থাকেন..." মায়ের বাক্যবাণে তিষ্ঠতে না পেরে দাদীমা উঁকি দিতেন আমার ঘরে। সেই ভূবন ভোলানো হাসি দিয়ে আমাকে ভুলাবার চেষ্টা করতেন, খুব সন্তর্পণে আঁচলের তলা থেকে ২টাকা বা পাঁচ টাকার নোট বের করে এদিক ওদিক তাকিয়ে লুকিয়ে বলতেন,
- দাদুভাই, যা না এক দৌড়ে মোড়ের দোকান থেকে দুটি জিলাপি নিয়ে আয় না.... ঘাড় নাড়তাম আমি, পারবোনা যে সেই অপরাগতা জানিয়ে দিতাম,
- মা বকবে। আমি পারবোনা দাদীমা।
- আরে কিচ্ছু হবেনা। মা জানতেই পারবেনা । যা না ?
আমি কোনোমতেই রাজী হতাম না যখন তখন দাদী শাপ শাপান্ত করতে বসতেন,
- হাড়ে হারামজাদী হয়েছে একটা। যেমন মা তেমনি ছা। বিছুটি পাতার ঝাঁড়ে কি আর মাধবীলতা গজাবে? জাঁত হারামী। সব ধ্বংশ হয়ে যাবে। পটপট করে মরবি তোরা একের পর এক বুঝলি?? হাড় পটপটি রোগে মরবি। মুখে রক্ত উঠে মরবি...
আমি মন দিয়ে শুনতাম দাদীমার বাক্যগুলোও। মায়ের বাক্যবাণে আমি ভীত হয়ে পড়তাম কিন্তু দাদীমার ফোকলা দাঁতের আজব সব শাপ শাপান্ত শুনে ভীষন হাসি পেতো আমার। আমি খিলখিল করে হাসতাম। আমার হাসি দেখে দাদীমা আরও খেপে উঠতেন। মারতে যেতেন আমাকে। আমি দৌড়ে পালাতাম। দূরে গিয়ে হাসতাম। সবখানে ব্যর্থ হয়ে দাদীমা তার কুঁচকানো চাদর পাতা চৌকিটায় গিয়ে কাঁদতে বসতেন।
মাঝে মাঝে আমার দয়াও হত। খাবার দেখে তার লোভী চোখের চকচকে চাউনি আর আনন্দিত মুখের হাসি দেখবার জন্যই বুঝি আমি মায়ের হাতে বানানো, খুব উঁচুতে তুলে রাখা মুড়ির মোয়া বা নারকেলের নাড়ু লুকিয়ে পেড়ে এনে মাঝে মাঝেই দাদীমার হাতে তুলে দিতাম । দাদীমার নিস্প্রভ হয়ে আসা চোখের মনি দুটো জ্বলজ্বল করে উঠতো। ভীষন আনন্দিত হয়ে উনি হাত বাড়াতেন। তারপর দাঁতহীন মুখে তারিয়ে তারিয়ে খেতেন সেই অমূল্য খাবার। মাঝে মাঝে স্কুল থেকে ফিরে আমি বাঁচিয়ে রাখা টিফিনের অংশটুকু মায়ের চোখ বাঁচিয়ে তার হাতে তুলে দিতাম। ভীষন খুশি হয়ে আমার মাথায় হাত বুলাতেন দাদীমা।
এই খাবারের প্রতি অপরিসীম লোভের কারণেই একদিন মৃত্যু হলো তার। বারান্দায় রোদে দেওয়া কুলের আঁচারের বোয়াম খুলে প্রায় আধা বোতল শেষ করে ফেললেন তিনি একদিনেই। এরপর এই বয়সী শরীরে এই ধকল আর নিতে পারলেন না। সন্ধ্যা থেকেই শুরু হলো ডায়েরিয়া। শিওরে সারারাত জেগে রইলেন বাবা। আঁচারের বয়ামের এই বিধ্বংসী কান্ড দেখবার পরেও দাদীমার এ অবস্থা দেখে সেবা শুশ্রুসার ত্রুটি করেননি মাও। তবুও ভোরের দিকে দাদীমা এই পৃথিবীর সকল লোভ লালসা, আশা ভরসা ত্যাগ করে, তার এত বছরের স্বামীর ভিটে, কুঁচকানো চাদরের চৌকি, এক ছেলে ও তিন মেয়ে এবং কিছু নাতি নাতকূড় রেখে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেলেন।
দাদীমার মৃত্যুর পর হঠাৎ এক আশ্চর্য্য রকম নীরবতা নেমে আসলো পুরো বাড়িটা জুড়ে। অষ্টপ্রহর সংসার ও দাদীমাকে নিয়ে অভিযোগ করা মায়ের চারিপাশ জুড়ে নেমে আসলো এক আশ্চর্য্য শীতলতা। দাদীমা বেঁচে থাকতে প্রায়ই মা বলতেন, এ আপদ মরলে বাঁচি। আমার হাড় জুড়োয়। কিন্তু দাদীমার মৃত্যুর পর সত্যিই কি তার হাড় জুড়িয়েছিলো? মায়ের কাছে এ প্রশ্নের উত্তর আমার আর জানা হয় না। দাদীমার শূন্য চৌকিটার দিকে তাকিয়ে মাঝে মাঝে আমার ভীষন মন খারাপ হয়ে উঠতো। বেঁচে থাকতে যে ছিলো একজন মূল্যহীন মানুষ, তার অমুল্য অন্তর্ধান পুরো বাড়িটাকেই যেন শূন্য করে দিয়ে গিয়েছিলো।
দাদীমা নিয়ে যে কোনো স্মৃতিতেই আমার এই দৃশ্যগুলিই মনে পড়ে। এভাবেই দাদীমার মৃত্যুর পর ও বাড়িতেই আরও কয়েক বছর কেটে গেলো বেশ নিরুপদ্রপেই। এস.এস. সি এর ঠিক আগ দিয়ে বাবা আমার বিয়ে ঠিক করে আনলেন হঠাৎ একদিন। কনে দেখা আলোর এক অদ্ভুত সুন্দর বিকেলে আমার বিয়ে হয়ে গেলো আমার চাইতে পনেরো বছরের বড়ো সৌদী প্রবাসী এক যুবকের সাথে। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের আমি এরপর বেশ সুখেই ছিলাম। সুখে থাকা যাকে বলে আর কি। ইচ্ছে মত শখ মেটাতে পারা। ভালো খেতে পাওয়া। পরতে পারা। ইচ্ছে হলে শপিং এ ঘুরে আসা এবং শুধু হাতে নয়, শখের বা প্রয়োজনীয় জিনিসগুলি হাতে নিয়ে ফিরতে পারাটাও।
বিয়ের পরও আমি বছর খানেক বাবার বাড়িতেই ছিলাম। আমার প্রবাসী স্বামী আমাকে পাঁকাপাকিভাবে সৌদীতে নিতে একটু ঝামেলা হওয়াতেই এই বিলম্ব। তবে সেই বছর খানেক সময়ে বাবার বাড়িতে আমার সমাদর বেড়ে গিয়েছিলো কয়েক শত গুন বেশি। এর কারণ আমার আরও বড় দুই বিবাহিত বোন বা বিবাহিত ভাই যা বাবা মাকে কখনও দিতে পারেনি আমার দুদিনের প্রবাসী স্বামী তাই দিয়েছিলো তাদেরকে। অপরিসীম শ্রদ্ধা, ভালোবাসা এবং মমতা। বাবা মায়ের জন্যই উনি এ বাড়ির প্রথম রঙ্গিন টিভিটি কিনে আনেন। আমার স্বামীর সৌজন্যবোধ, দায়িত্বজ্ঞান, শ্রদ্ধা বা মমতায় আমি নিজেও অভিভূত হয়েছিলাম। তাই আমার সাথে আমার স্বামীর বয়সের এই বিস্তর ফারাকটা আমার কাছে কোনো সমস্যার কারণই মনে হয়নি।
এই প্রবাসে পাকাপাকিভাবে আসার আগ দিয়ে যে বছরখানেক সময়টা আমি সেখানে ছিলাম বাবা মাসহ আমাদের খাবার, পোশাক হতে শুরু করে সংসারের অনেক খরচই উনি মিটিয়ে দিতেন। আমার বাবা লজ্জা পেতেন, কিন্তু আমার স্বামী শুনতেন না। উনি এতিম ছিলেন এবং আমার মা বাবাকে নিজের বাবা মাই মনে করতেন। বছর খানেক পর আমি যখন ও বাড়ি ছেড়ে চলে এলাম এই সুদূর পরবাসে, আমার কেনো যেন সেদিন হঠাৎ দাদীমাকে খুব মনে পড়ছিলো। আসলে শুধু সেদিনই না বিশেষ যে কোনো আনন্দ বেদনার দিনেই আমার দাদীমাকে মনে পড়তো। আমার বিয়ের পর আমার স্বচ্ছল দিনগুলোতে প্রায়ই আমার মনে হত আজ যদি দাদীমা বেঁচে থাকতেন...
প্রথমদিনে এই প্রবাস জীবন আমার দূর্বিসহ লাগতো। সকাল হতে সন্ধ্যা পর্যন্ত ব্যবসায়িক কাজে আমার স্বামীর ভীষন ব্যাস্ততায় কেটে যেত। ধীরে ধীরে আমি এই চার দেওয়ালের বদ্ধ পরিবেশে অভ্যস্ত হয়ে পড়ি। আমার কোল জুড়ে আসে আমার সন্তান। তাকে নিয়ে ব্যাস্ততায় কাঁটে আমার দিনগুলোও। এখানে আসার মাস ছয়েকের মাথায় খবর পাই বাবা চলে গেছেন না ফেরার দেশে। আমার বিধবা মা নিরুপায় হয়ে উঠেছেন আমার একমাত্র বড় ভায়ের বাড়িতে। আমাদের ও বাড়ি এখন তালাবন্ধ পড়ে রয়েছে। আমার ভীষন কষ্ট হয়। পলেস্তারা ওঠা, শেওলা ছাওয়া আমাদের ছাই ছাই দেওয়ালের সারাজীবনের সেই এক টুকরো বাড়ির মমতা আমাকে ভীষন টানে। ভালো লাগে না আমার এই বিলাসী জীবন, মখমলের সোফা, দামী জাজিম বসানো খাঁট- পালঙ্ক, আসবাব। কিচ্ছু ভালো লাগে না আমার। মনে হয় সব ছেড়ে ছুড়ে এক ছুটে চলে যাই আমার বালিকা বেলায় ফেলে আসা সেই সোনা রঙ দিনগুলোতে..
মা প্রায়ই ফোনে কান্নাকাটি করেন। আমাকে দেখার জন্য, জামাইকে দেখার জন্য তার মন কাঁদে। অভিযোগ করেন আমার সন্তান, তার নাতীকে একবারের জন্যও কেনো দেখাতে আনলাম না আমরা। অভিযোগে অভিযোগে কেঁটে যায় আরও কয়েক বছর। ভায়ের কাছে শুনি, মা নানা রকম শাররিক সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। চোখে দেখছেন না আজকাল। কানেও শুনতে পান না ঠিকঠাক। কথাবার্তাও ঠিক মত বুঝতে পারেনা আজকাল ইত্যাদি, ইত্যাদি ও ইত্যাদি। মাঝে মাঝে উনি টাকা চেয়ে বসেন। আমার ভীষণ লজ্জা করে। আমি ভাইকে বলে দিয়েছি যা লাগে যেন আমার কাছে চান। জামাইকে না বলেন। আমি বুঝি ভায়ের সংসারেও স্বচ্ছলতা নেই। সেখানেও অভাব। এই অভাবের সংসারে মায়ের চিকিৎসাসহ অন্যান্য খরচ মিটাতে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি।
নাবিল, আমার সন্তানের বয়স এখন দু বছর। দেশে এসেছি আমি। ও বাড়ি তালাবদ্ধ। উঠেছি ভায়ের বাড়িতে । আমাকে দেখে ভাই ভাবী, ভায়ের বাচ্চারা মহা খুশি। ওদের জন্য স্যুটকেস ভরে উপহার এনেছি আমি। তাছাড়াও তারা কে কি চায়, কার কি প্রয়োজন আছে তা মিটাবার যথাসাধ্য চেষ্টা করবো বলে নিজেই ঠিক করে এসেছি আমি। মা যেন আমাকে দেখে আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছেন। এ ক'বছরে ভীষন বুড়িয়ে গেছেন উনি। চোখের ছানি কাটাতে হবে। ডায়াবেটিকস ধরা পড়েছে। কানে প্রায় শুনতে পান না বললেই চলে। ভাই ভাবী, তাদের ছেলে মেয়েরা আমাকে যত্ন আত্তির ত্রুটি করছে না। ওদের অবস্থা স্বচ্ছল নয় জানতাম তাই বলে এতটা হত দরিদ্র আগে বুঝিনি। মনে মনে ঠিক করি এবার থেকে নিয়মিত ওদের জন্য কিছু পাঠাবো। তা' ছাড়া মা রয়েছেন। তার জন্যও তো কিছু খরচা আছেই। আমার আগমন উপলক্ষে আজ পোলাও, মুরগীর ভূনা, খাসীর মাংস রান্না করা হয়েছে। আমার ভীষন লজ্জা করছিলো। নিশ্চয় এসব বাজার করতে ভায়ের ভীষন কষ্ট হয়েছে।
রাতের বেলা বেশ এতদিন বাদে এত সব দেশী খাবার খেয়ে তৃপ্তি করে শুয়েছি। ভাবী রান্নাঘরে বাসন পত্তর সামলাচ্ছেন। হঠাৎ ভাবীর বড় মেয়েটার গলা শুনতে পাই-
- মা দাদী বলছেন, আজ ঠিক মত খেতে পারেন নি, জীবটা কেমন কষ কষ করছে। একটু পায়েস আছে নাকি?
ভাবী রাগত গলা চেপে ভেংচে ওঠেন,
- এহ জীবটা কষ কষ কচ্ছেন। ঠিক মত খেতে পান নি। গবাগব এক রাশ গিলে এখন আল্লাদী নেকামী কচ্ছেন। ঢং দেখলে গা জ্বলে যায়। নোলা, নোলা, বুঝলি এসব বলে নোলা, এক রাশ গিলেও নোলা থামে না। যতক্ষন আছে সামনে ততক্ষন সমানে চালাবেন। বাবারে বাবা এই বয়সে এত খাওয়া কেনো? দুই চোখে যা পড়বে তাই খাওয়া চাই, সাতবেলা রাশ রাশ খাওয়ারও কমতি নেই। রাক্ষসী খাই খাই স্বভাব। অবাক হয়ে যাই! এই বয়সে এত খাই! এক পা কবরে দিয়ে রয়েছেন তবুও খাই খাই স্বভাব যায় না....মনে হয় পেটে রাক্ষস ঢুকেছে .......
চমকে উঠি আমি!
ফিরে যাই বহুদিন আগের বালিকাবেলায়....
প্রকৃতি কাউকে ছাড় দেয় না....
কাউকেই না.......
দীর্ঘশ্বাস পড়ে আমার। চোখ বুজে দেখতে পাই সেই ভূবন ভুলানো তোবড়ানো মুখের হাসি...
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা আগস্ট, ২০১৮ রাত ১১:৫৭