somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

"অসমাপ্ত আত্নজীবনী" ও কিছু কথা______

২১ শে জুন, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:৪৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


অযৌক্তিক কিছু প্রশ্ন তুলে অযথা বিতর্ক করা আমাদের খুবই পছন্দের কাজ। যেমন এই বইটা সম্বন্ধে যে বিতর্ক বই প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে শুনে আসছি সেটা হল, বইটা শেখ মুজিবের লেখা না, সরকার কাউকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে। এই বিষয়ে একটূ পরে কথা বলছি, আগে বইটা সম্পর্কে কিছু কথা…।

এই গ্রন্থে বর্ণিত সময়কাল হচ্ছে ১৯৫৫ পর্যন্ত। মানে তখনো শেখ মুজিব 'বঙ্গবন্ধু' হয়ে উঠেন নি। বইটাকে আমরা তিন ভাগে ভাগ করতে পারি। বইয়ের শুরুতে তাঁর পরিবার, বংশের কথা খোলামেলা ভাবেই বলা হয়েছে। কিছুদূর এগোতেই স্বভাবতই চলে আসে সমকালীন রাজনীতি। সে রাজনীতির প্রথম ভাগ হচ্ছে স্বপ্নের 'পাকিস্তান আন্দোলন'। সে আন্দোলন সফল হওয়ার পরই আসে স্বপ্নের পাকিস্তানে স্বপ্ন ভঙ্গের অধ্যায়। সে স্বপ্ন ভঙ্গের সাথে শুরু হয় তার নিজের উপর জেল – জুলুম। জেলের এবং জেল জীবনের বিস্তারিত বিবরণ আছে শেষ ভাগ টা জুড়ে। সাথে আছে ৪৩ এর দূর্ভিক্ষ এবং কলকাতার ভয়াবহ দাঙ্গার স্মৃতিচারণ। বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে আছে ভাষা আন্দোলন এর ইতিহাস। শেষের দিকে আছে লেখকের চীন সফর নিয়ে বিশাল বর্ণনা। সে বর্ণনায় তখনকার ঘুরে দাঁড়ানো 'নয়া চীন' এর প্রতি মুগ্ধতাও ঝরে পড়ে লেখকের কলমে।

১৯৪৩ এর দূর্ভিক্ষের ভয়াবহতার চিত্র লেখক অনেকটা এভাবেই তুলে ধরেছেন,
"… সেই বাংলাদেশের এই দুরবস্থা চোখে দেখেছি যে, মা মরে পড়ে আছে, ছোট বাচ্চা সেই মরা মার দুধ চাটছে। কুকুর ও মানুষ একসাথে ডাস্টবিন থেকে কিছু খাবার জন্যে কাড়াকাড়ি করছে। ছেলেমেয়েদের রাস্তায় ফেলে দিয়ে মা কোথায় পালিয়ে গেছে। পেটের দায়ে নিজের ছেলেমেয়েকে বিক্রি করতে চেষ্টা করছে। কেউ কিনতেও রাজি হয় নাই। বাড়ির দুয়ারে এসে চিৎকার করছে, 'মা বাঁচাও, কিছু খেতে দাও, মরে তো গেলাম, আর পারি না, একটু ফেন দাও।"

কলকাতার ভয়াবহ দাঙ্গা নিয়ে অনেক কথাই শুনেছি। অনেক জায়গাতেই শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। তবে লেখক ছিলেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর খুব পাশের মানুষ, আশে পাশেই ছিলেন সর্বদা। লেখকের বর্ণনা পড়ে সোহরাওয়ার্দীকে নিয়ে তোলা সেই প্রশ্ন গুলো অবান্তর হয়ে যায়। সেই দাঙ্গার দিনটার কথাও লেখকের স্মৃতিতে উঠে আসছে," আর যদি আধা ঘন্টা দেরি করে আমরা বউ বাজার হয়ে আসতাম তবে আমার ও নূরুদ্দিনের লাশও আর কেউ খুঁজে পেত না।"

পাকিস্তান আন্দোলনের একনিষ্ঠ কর্মী হয়েও কেন 'মুসলিম লীগ' ত্যাগ করে 'আওয়ামী মুসলিম লীগ' গঠন করলেন? এর প্রয়োজনই বা কি ছিল? এই প্রশ্নের উত্তর মিলে এই গ্রন্থে।

পাকিস্তান আন্দোলনের একনিষ্ঠ কর্মী হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পরই অনেকের ওপর নেমে এসেছিল জেলজুলুমের অত্যাচার। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের প্রথম সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক তো কারাগারে থাকতে থাকতে মানসিক অসুস্থই হয়ে পড়েন। স্বাধীনতার মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই লেখককেও তাই যেতে হয়েছে জেলে, বিনা বিচারে দিনের পর দিন কাটাতে হয়েছে জেলের ভিতর। বের হওয়ার জন্যে করেছেন আমরণ অনশন। তাঁর মত নিষ্ঠাবান ' পাকিস্তান আন্দোলন' এর কর্মীকে জেলে দেখে এক বেলুচি সুবেদার অবাক হয়ে বলেছিল, "ইয়ে কেয়া বাত হ্যায়, আপ জেলখানা ম্যায়!!"

আগ্রার তাজমহল দেখতে গিয়েছিলেন একবার; তাজের প্রতি তার মুগ্ধতাও ফুটে উঠে এখানে, "চাঁদ অন্ধকার ভেদ করে এগিয়ে আসছে আর সাথে সাথে তাজ যেন ঘোমটা ফেলে নতুন রূপ ধারণ করেছে। কি অপূর্ব দেখতে! আজও একুশ বছর পর লিখতে বসে তাজের রূপকে আমি ভূলি নাই, আর ভূলতেও পারব না।"

এবার একটু আসি অভিযোগটার দিকে। সাধারণত আত্নজীবনীতে নিজেকে একটু বেশি তুলে ধরা হয়। কিন্তু এখানে আপনি শেখ মুজিবকে যতটা পাবেন তার চেয়ে বেশী পাবেন সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা ভাসানী ও শেরে বাংলা কে। শেখ মুজিব শুধু ঘটনা প্রবাহ বলে গিয়েছেন। প্রতিটা মানুষ সম্পর্কে তিনি করেছেন উচ্চকিত প্রশংসা। যেমন, সোহরাওয়ার্দীকে নিয়ে লিখেছেন, "শহীদ সাহেব ছিলেন সাগরের মত উদার। যে কোন লোক তাঁর কাছে একবার যেয়ে হাজির হয়েছে, সে যত বড়ই অন্যায় করুক না কেন, তাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন"।
কারো সম্পর্কে নেতিবাচক কিছু থাকলে যেমন উল্লেখ করেছেন ঠিক তেমনি তার প্রশংসার জায়গায় প্রশংসাও করেছেন। ভাসানী সম্পর্কে এক জায়গায় বলেন, "এই দিন আমি বুঝতে পারলাম মাওলনা ভাসানীর উদারতার অভাব, তবুও তাকে আমি শ্রদ্ধা ও ভক্তি করতাম। কারণ, তিনি জনগণের জন্য ত্যাগ করতে প্রস্তুত।"

এই বই যদি বর্তমান সরকার কাউকে দিয়ে লিখিয়ে নিত তাহলে সেটা অসমাপ্ত হত না, সমাপ্ত ই হত। আর শেখ মুজিবকে পুরো বই জুড়ে অনেক বৃহদাকারে ই উপস্থাপন করা হত।

বইয়ে এক জায়গায় লেখকের হালকা তথ্যগত ভূল হয়েছিল, প্রকাশক পরে টীকা তে তা সংশোধন করে দিয়েছেন (৮)। এতে বুঝা যায় লেখকের মূল কপিতে পরিবর্তনের চেষ্টা করা হয় নাই। যাদের মনে এখনো খুত খত আছে তাদের বলছি দয়া করা বইটা একবার পড়া শুরু করেন, তাহলে আপনি বুঝে নিবেন বইটা কার লেখা?

এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি। ২৫ শে মার্চ রাতে শেখ মুজিবের গ্রেফতার হওয়া নিয়ে অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খায় আমাদের মনে। শারমিন আহমদ "তাজউদ্দিন আহমদঃ নেতা ও পিতা" গ্রন্থে স্বেচ্ছায় কারাবরণ এর কথা উল্লেখ করেছেন, "এদিকে বেগম মুজিব ঐ শোবার ঘরেই সুটকেসে মুজিব কাকুর জামাকাপড় ভাঁজ করে রাখতে শুরু করলেন"। অনেকেই প্রশ্ন করেন, শেখ মুজিব কেন আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গেলেন না? আন্ডারগ্রাউন্ডে গিয়েও তো তিনি যুদ্ধ পরিচালনা করতে পারতেন!কেউ কেউ আবার অভিযোগ ও তুলে ফেলেন মুজিবের নামে যে তিনি ইচ্ছা করেই গ্রেফতার হয়ে জেলে চলে যান নিরাপদে থাকার জন্যে(!!)

এ নিয়ে অনেক তাত্ত্বিক কথা হয়েছে। পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি-পাল্টা যুক্তি শুনে আসছি বহু দিন ধরে। 'অসমাপ্ত আত্নজীবনী' পড়ার সময় মনে হল "গ্রেফতার, জেল –জুলুম" এসব নিয়ে শেখ মুজিবের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন ছিল তা জানতে পারলে উপরের প্রশ্নটার একটা উত্তর পেতেও পারি, "কেন তিনি ধরা দিলেন পাকিস্তানিদের হাতে?"

লাল দেয়ালের কারাগারের সাথে পাকিস্তান তৈরির পরপরই তার যে সখ্য গড়ে ঊঠে তা আগেই উল্লেখ করেছি।তবে এটা ঠিক যে তিনি কখনো পালিয়ে বেড়ানোর চেষ্টা করেন নি। 'অসমাপ্ত আত্নজীবনী' তে এমন অনেক ঘটনারই বিবরণ আছে। মাওলানা ভাসানী একবার শেখ মুজিবকে গ্রেফতার হতে বারণ করলে শেখ মুজিব লিখেন, "তাঁকে জিজ্ঞেস করা দরকার, তিনি কেন আমাকে গ্রেফতার হতে নিষেধ করেছেন? আমি পালিয়ে থাকার রাজনীতিতে বিশ্বাস করি না। কারণ, আমি গোপন রাজনীতি পছন্দ করি না, আর বিশ্বাস ও করি না।"

একবার পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করতে তাঁর বাসায় এসে দেখে যে তিনি বাসায় নাই। পরে বাসায় ফিরে এসে শেখ মুজিব তা জানতে পেরে ফোন করেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে, "আমার বাড়িতে পুলিশ এসেছিল, বোধহয় আমাকে গ্রেফতার করার জন্য। আমি এখন ঘরেই আছি গাড়ি পাঠিয়ে দিন।" প্রশ্নটার উপর কিছুটা আলো মনে হয় পড়ছে...!

এটা ঠিক যে এই বইয়ে ব্যাক্তি মুজিবকে খুব একটা পাওয়া যায় নি, বরং পাওয়া যায় উত্তাল সেই সময়টাকে, যে সময়টাকে তিনি শুধু ধরার চেষ্টা করেছেন বইতে। অবশ্য বইয়ে এটা খালি চোখেই ধরা পড়ে কিভাবে সেই শেখ মুজিব ধীরে ধীরে "বঙ্গবন্ধু" হওয়ার পথে অগ্রসর হচ্ছিলেন। এই দিকটা বিরাট শিক্ষণীয়। এবার একটা নিজস্ব মতামত দেই। ব্যাক্তিগত ভাবে আমি মনে করি, বঙ্গবন্ধুর পুরো রাজনৈতিক জীবনটাকে (সেটা ভূল হোক আর শুদ্ধ হোক) আমাদের 'বিএনপি – আ'লীগ' মানসিকতার উর্ধ্বে উঠে আলোচনা করা উচিত। এই মানুষটা সম্পর্কে হুমায়ূন আজাদ যথার্থই বলেছিলেন, " তিনি শুধু রাজনীতিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করেন নি, তিনি যুগান্তর ঘটিয়েছিলেন রাজনীতিক ধারার, যেমন কবিতায় যুগান্তর ঘটিয়েছিলেন মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ বা ত্রিশের কবিরা।"
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জুন, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:৪৬
৫টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:০২



ইউটিউব হুজুর বললেন, মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে। তখন নাকি নিজ যোগ্যতায় ঈমান রক্ষা করতে হয়। আল্লাহ নাকি তখন মুমিনের সহায়তায় এগিয়ে আসেন না। তাই শুনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মহিলা আম্পায়ার, কিছু খেলোয়ারদের নারী বিদ্বেষী মনোভাব লুকানো যায় নি

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯



গত বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল প্রাইম ব্যাংক ও মোহামেডানের ম্যাচে আম্পায়ার হিসেবে ছিলেন সাথিরা জাকির জেসি। অভিযোগ উঠেছে, লিগে দুইয়ে থাকা মোহামেডান ও পাঁচে থাকা প্রাইমের মধ্যকার ম্যাচে নারী আম্পায়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

জানা আপুর আপডেট

লিখেছেন আরাফআহনাফ, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৭

জানা আপুর কোন আপডেট পাচ্ছি না অনেকদিন!
কেমন আছেন তিনি - জানলে কেউ কী জানবেন -প্লিজ?
প্রিয় আপুর জন্য অজস্র শুভ কামনা।



বি:দ্র:
নেটে খুঁজে পেলাম এই লিন্ক টা - সবার প্রোফাইল... ...বাকিটুকু পড়ুন

বন্ধুর বউ কে শাড়ি উপহার দিলেন ব্যারিস্টার সুমন। বাটার প্লাই এফেক্ট এর সুন্দর উদাহারন।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:০৭



এক দেশে ছিলো এক ছেলে। তিনি ছিলেন ব্যারিস্টার। তার নাম ব্যারিস্টার সুমন। তিনি একজন সম্মানিত আইনসভার সদস্য। তিনি সরকার কতৃক কিছু শাড়ি পায়, তার জনগণের মাঝে বিলি করার জন্য।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×