
সনাতন ধর্মে পুরাণে উল্লিখিত ৩৩ কোটি দেবতার মানে কি ৩৩,০০,০০,০০০ জন দেবতা?
কোটি শব্দের একটি বিশেষ অর্থ হইলো উচ্চ শ্রেণি। সে হিসাবে ৩৩ কোটি দেবতা বলতে বোঝাচ্ছে ৩৩ জন উচ্চ শ্রেণির দেবতা। সংস্কৃত ভাষায় ত্রয়োত্রিংশ কোটি বলতে "তেত্রিশ গুণ সম্পন্ন বা তেত্রিশ প্রকার"-কে বোঝাচ্ছে। সম্প্রতি একটা লেখায় কিঞ্চিত আভাস পেয়ে গুগলের সহায়ে কিছুটা ঘাঁটাঘাঁটি করে এটা জানতে পারলাম।
এই ৩৩ প্রকার বা ৩৩ জন দেবতার হলেন-
ক. অষ্ট বসু বা ৮ জন বসু (ধরা, অপ, অনল, অনিল, প্রত্যুষ, প্রভাস, সোম ও ধ্রুব)
খ. বারো আদিত্য বা ১২ জন আদিত্য (বিষ্ণু, বরুণ, মিত্র, ইন্দ্র, অংশুমান প্রমূখ)
গ. এগারো রুদ্র বা ১১ জন মরুত (মনু, মহীন, হর, শম্ভু, কাল, বামদেব প্রমূখ)
ঘ. দুই অশ্বিন (নসত ও দস্র)
[বিঃদ্রঃ ত্রুটি মার্জনীয়, ভুল সংশোধনীয়]
এই যে ৩৩ কোটি দেবতা, এগুলা কিন্তু মিথিক্যাল চরিত্র একেকটা। সনাতনী পুরাণগুলোর একেকটায় তাদের নামেরও ভিন্নতা আছে বটে।
মাইথোলজি একটা বেশ আগ্রহ জাগানিয়া বিষয়। মাইথোলজি খালি অতিপ্রাকৃত অস্তিত্বের কথা কয় না, মানবসভ্যতার সামাজিক বিবর্তনের আখ্যানটাও ব্যাখ্যা করে। মাইথোলজিস্ট জোসেফ ক্যাম্পবেলের এক আলাপচারিতা পড়ে চমকে উঠেছিলাম এটা জেনে যে প্রত্যেকটা মিথের পেছনে মানুষের সামাজিক-সাংস্কৃতিক-ভোগলিক-অর্থনৈতিক কার্যকারণ বিদ্যমান।
এই যে মিথ বা মিথিক্যাল চরিত্রগুলা অতিপ্রাকৃত অনেকাংশে। যদিও রাহুল সংকৃতায়ন মনে করেছেন, এসব চরিত্র আদতে কোনো রক্ত মাংসের মানুষ যারা কালক্রমে বিবর্তিত ও অতিরঞ্জিত হয়ে উত্তরসূরী মানুষের শ্রদ্ধা-কল্পনায় অতিপ্রাকৃত রূপ ধারণ করে মিথে পরিণত হয়েছে।
অনেকাংশে একেকটা চরিত্রের আরও কয়েকটা রূপ-নাম-ডাকও আছে। কালক্রমে বিবর্তিত হইতে হইতে একেকটা রূপভেদও আবার একেকটা স্বতন্ত্র চরিত্রে পরিণত হয়ে গেছে।
আরও অবাক হতে হয় যে, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে এই মিথ বা মিথিক্যাল চরিত্রগুলায় অদ্ভুত মিল। অঞ্চলভেদে এসব চরিত্র বা মিথকে ভিন্ন নামে বা সংশ্রয়ে ডাকা হইলেও তাদের গড়ে ওঠা ও কার্যকলাপেও ব্যাপক মিল পাওয়া যায়।
এই ধরেন, পারস্য বা প্রাচীন ইরানীয় ধর্ম জরথ্রুস্টবাদে দেয়া একেশ্বরবাদী স্রষ্টা সম্পর্কিত মৌলিক ধারণার সাথে কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের তিন প্রধান ধর্মের (ইহুদীবাদ, খ্রিষ্টান ও ইসলাম) ব্যাপক মিল পাওয়া যায়।
আবার ভারতীয় সনাতনী ধর্মের মাইথোলজির সাথে গ্রীক মাইথোলজির অনেক মিল পাওয়া যায়। যেমন- গ্রীক দেবতা জিউস ও ভারতীয় দেবতা ইন্দ্রের ঐশ্বরিক শক্তি ও নারী আসক্তিতে মিল। কিউপিড/ইরোস আর কামদেব দুজনেই শারীরিক প্রেমের দেবতা। তেমনি আফরোদিতি আর রতি দুজনেই প্রেম, কাম ও ভালোবাসার দেবী। গ্রীক পাতাললোকের শাসক হেডিসের ভারতীয় রূপ যমদেব। ট্রয় নগরী ধ্বংসলীলায় পরম বীর একিলিস যেন মহাভারতের বীর কর্ণেরই পশ্চিমা রূপ!
প্রশ্ন জাগে, পৃথিবীজুড়ে নানা প্রান্তে মিথোলজির এমন অদ্ভুত মিল কেন? উত্তরখানা জটিল নয় বোধ হয়। বলাবাহুল্য বর্তমান বিশ্বে যাবতীয় মিথোলজির মূলে আছে আর্যরা আর তাদের ক্রিয়াধারা। এই আর্যদের একটা অংশ যারা ভারতে এসেছে, তাদের হাত ধরে সৃষ্টি হয়েছে ভারতীয় মাইথোলজি। তেমনি আর্যদের যারা মধ্যপ্রাচ্যের মরূ অঞ্চলে থেকেছে তারা জরথ্রুস্টবাদী মিথোলজি সৃষ্টি করেছে। আবার আর্যদের যে অংশটা তুরষ্কের পথ দিয়ে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে বসবাস শুরু করে তারা গ্রীক মাইথোলজির স্রষ্টা।
জেবস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের ছবি যেমন মহাবিশ্ব সৃষ্টিরহস্য উদঘাটনে এক অন্যন্য পদক্ষেপ, তেমনি পৃথিবীতে সামাজিক বিবর্তন, জ্ঞানীয় সভ্যতার উন্নয়ন, ধর্মের উৎপত্তি ও বিবর্তন- মোদ্দাকথা মানবসভ্যতার বিবর্তনের ব্যাখ্যার সহায়হ একটা ব্যাপার স্যাপার হতে পারে মাইথোলজিগুলো। জোসেফ ক্যাম্পবেলের মত মাইথোলজিস্টরা সেই ব্যাপারটাই তুলে ধরেছেন তার দীর্ঘ গবেষক-জীবনে।
মাইথোলজি, ধর্ম, সমাজ আর মানুষের সভ্যতার বিবর্তনের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক-কার্যকারণ আরও ভালো করে বোঝার জন্যে আমিনুল ইসলাম ভুইয়া অনূদিত 'মিথের পথ' বইটা পড়তে পারেন। পাশাপাশি সহজ করে গল্পোচ্ছলে মানবসভ্যতা, সমাজ ও ধর্মের বিবর্তন বোঝার জন্যে রাহুল সংকৃত্যায়নের 'ভোলগা থেকে গঙ্গা' পড়ে নিতে পারেন।
খুর্শিদ রাজীব
২১ জুলাই ২০২২
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জুলাই, ২০২২ রাত ১১:৫৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



