somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভাষা ও সংস্কৃতি (পর্ব দুই): পঞ্চগড়ের রাজবংশী ভাষা ও সাহিত্য

১৪ ই এপ্রিল, ২০২৩ সকাল ৭:৪৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


সবাইকে শিরুয়া বিশুয়া’র শুভেচ্ছা।

শিরুয়া বিশুয়া অর্থ শুভ নববর্ষ। পৃথিবীর আর কোনো অঞ্চলে এই নববর্ষের প্রতিশব্দ হিসেবে এই শব্দযুগল ব্যবহৃত হয় কি না জানা নেই। পঞ্চগড়ে আমার মাতৃভাষায় এটি বহুল প্রচলিত। এখনকার তরুণদের মধ্যে খুব একটা প্রচলিত না হলেও প্রবীণরা এখনও পহেলা বৈশাখ বা নববর্ষ বোঝাতে ’শিরুয়া বিশুয়া’ শব্দ দুটি ব্যবহার করেন। তবে ঠিক বলতে পারবো না, ’শিরুয়া বিশুয়া’র অর্থ পহেলা বৈশাখ, নাকি নববর্ষ। এটাও বরা মুশকিল এটি পঞ্চগড়ে প্রচলিত রাজবংশী, সূর্যাপুরী, কুরুখ, মুণ্ডারী নাকি সাঁওতালি ভাষার শব্দ। তবে এটি যে বাংলা শব্দ নয় তা এক প্রকার নিশ্চিত।

এই শিরুয়া বিশুয়া পঞ্চগড়ের সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ দিন। হালখাতা আর মেলা তো বটে, এই দিনটির বিশেষ আকর্ষণ চাল-কলাই-ছোলা’র একটি পদ। পান্তা ভাত খাওয়াটা শহুরে মানুষের একদিনের ’শখের বাঙালি’ সাজার প্রয়াস হতে পারে। কিন্তু চৈত্র-বৈশাখের গরমে পান্তা ভাত এই অঞ্চলের কৃষিজীবী মানুষের নিত্যদিনকার খাবার। তাই শিরুয়া বিশুয়ার সকালে বিশেষ আকর্ষণ এই চাল-কলাই-ছোলা’র তৈরী বিশেষ পদ। আমার জন্মস্থান পঞ্চগড়ের মানুষেরা এই খাবার খেয়েই বছরের প্রথম দিনটি শুরু করত, ছোটবেলায় দেখেছি। এখন তো সব সোনালী অতীত!

এই লেখায় ‘শিরুয়া বিশুয়া’র সংস্কৃতি যে অঞ্চলটি পালন করে/করত, সে-ই অঞ্চলের ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে। গত পর্বে মূলত পঞ্চগড়ে প্রচলিত কুরুখ ও সূর্যাপুরী ভাষা নিয়ে আলাপ তুলেছিলাম, রাজবংশী ভাষার আলাপটাও শুরু হয়েছিলো (নিচে লিংক দেয়া থাকলো)। এই লেখায় কথা হবে পঞ্চগড়ের পূর্বাঞ্চলের মানুষদের প্রকৃত মাতৃভাষা, রাজবংশী ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে।

রাজবংশী ভাষাটি মূলতঃ আমার জন্মভূমি পঞ্চগড় জেলার মধ্য ও পূর্বাঞ্চলের ভাষা। গ্লটোলগ বা ভাষার শ্রেণিবিন্যাসগুলোতে একে রংপুরী বা অম্পুরী, কামতা বা কামতাপুরী, কোচ-রাজবংশী ভাষা নামেও ডাকা হয়েছে। গ্লটোলগ অনুযায়ী, যে গৌড়ীয়-বাংলা একটি শাখা থেকে দুই বোন- অসমীয়া ও বাংলা ভাষার জন্য, সেই গৌড়ীয়-বাংলারই একটি শাখা থেকে দুই বোন- রাজবংশী ও সূর্যাপুরীর জন্ম। পঞ্চগড়সহ রংপুর বিভাগের অন্য জেলাগুলো উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল, ভারতের উত্তর দিনাজপুর ও জলপাইগুঁড়ির কিছু অংশে সূর্যাপুরী ভাষার বিস্তার। (এ নিয়ে গত পর্বে কিছুটা আলাপ হয়েছে, লিংকে প্রবেশ করে পড়ে ফেলতে পাড়েন।) আর রাজবংশী ভাষার বিস্তার মূলতঃ তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্রের উত্তর-পূর্ব পারের অঞ্চল অর্থাৎ আমার জন্মভূমি পঞ্চগড়সহ রংপুর বিভাগের জেলাগুলোর পূর্বাংশে এবং ভারতের কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি, আলিপুরদুয়ার ও আসামের গোয়ালপাড়া পর্যন্ত। এমনকি নেপালেও এই ভাষা প্রচলিত।

সহসা এই রাজবংশী বা রংপুরী ভাষাটি অনেকটা বাংলার মত শোনালেও মোটেও তা বাংলা কিংবা বাংলার আঞ্চলিক রূপ নয়। রাজবংশী বা রংপুরী ভাষাটি মূলত তা বাংলা (৪৮-৫৫%), মৈথিলী (৪৩-৪৯%) ও নেপালী ভাষার শব্দের সমন্বয়ে গঠিত। বলতে গেলে বাংলা নয়, বরই এটিই আমার এবং পঞ্চগড়ে আমার মা-চাচী, বাপ-দাদা, পাড়া-প্রতিবেশির ভাষা। কারণ বাংলাদেশের যে প্রমিত বাংলা, সে-তো আমরা স্কুলে গিয়েই শিখেছি। সুতরাং এই অঞ্চলের আদি মানুষদের প্রকৃত মাতৃভাষা বাংলা নয়, বরং রাজবংশী বা রংপুরী ভাষা।

উচ্চারণ ও শব্দগত প্রয়োগে এই ভাষাটি চারভাগে বিভক্ত- পূর্ব, মধ্য, পশ্চিম এবং পাহাড়ী (কোচ)। (তথ্য সংগ্রহের সীমাবদ্ধতায় এখনও জানা হয়ে ওঠেনি এই চারটি ভাগের অবস্থান ঠিক কোন কোন অঞ্চলে এবং পঞ্চগড়ে রাজবংশীর কোন ভাগটি প্রচলিত।)

কোচ-বিহার আমাদের বাড়ি থেকে একদম কাছে হওয়ায়, আমার বাড়ির মানুষরা যে ভাষাটি ব্যবহার করেন তা অনেকটাই কোচবিহারের রাজবংশীর সঙ্গে মেলে। অন্য ভাগগুলো বাদবাকি অঞ্চলগুলোতে মানুষ ব্যবহার করে। লেখার ক্ষেত্রে ভারতে এই ভাষাভাষীদের অনেকেই অসমীয়া বর্ণমালা ব্যবহার করেন। যেমন-

বাংলায় যদি বলি- ‘আমার সবগুলো লেখা পড়ার জন্য নিচের লিংকে ক্লিক করলে দেখতে পারবেন।

এটাকে বাংলা লিপিতে পঞ্চগড়ের ভাষায় হবে- 'মোর তামান/গটা লেখালা পড়হিবার তানে তলের লিংকডাত ক্লিক করিলে দেখিবা পারিবেন।'

আর সেটা রাজবংশী ভাষায় অসমীয়া লিপিতে সেটা হবে- 'মোর গটা লেখালা পড়হিবাৰ তানে তলেৰ লিংকটাত ক্লিক কৰিলে দেখিৰ পাবেন।'

এবার কোচ-রাজবংশী ভাষায় লেখা একটি কবিতা পড়ুন। কবি অতুল চন্দ্র বর্মণের "আ-হৈয়া"। (যতটা সম্ভব আক্ষরিক অনুবাদ করার চেষ্টা করেছি, তবুও দুই একটি শব্দ পাঠোদ্ধার করতে পারি নি।)

আ-হৈয়া আ-হৈয়া আ-হৈয়া!

সমবাৰে জন্ম তোৰ,
(সোমবারে জন্ম তোমার,)
সমবাৰু থুলুং তোৰ নাম।
(সোমবারু রাখলাম তোমার নাম।)

কিবা কাৰণত গোসা হলু?
(কী কারণে রাগ করলি)

হাম্বা হাম্বা হাম্বায়া,,,,,
মাৰ ডাকোতো সাৰা নাদিলু।
(মায়ের ডাকে তো সাড়া দিলে না।)

কোঠাই জায়া নুকালু,
(কোথায় গিয়ে লুকোলে)
আ-হৈয়া আ-হৈয়া আ-হৈয়া

কতো জাগাত ডাকানু,
(কতো জায়গায় ডাকলাম,)
নাদিস কোনোসাৰা।
(দিলে না কোনো সাড়া।)

মহা বিপদত পৰি আজি
(মহা বিপদে পড়ে আজ)
গোন্নাত ঠাকুৰক মানিলুং।
(*** ঠাকুরকে মানত করলাম)

দুই ঢাকি খৈ দিম এক ঢাকি মুড়ি,
(দুই ঝুড়ি খৈ দিব এক ঝুড়ি মুড়ি,)
মোলাদিম এক ঢাকি কলা ঝুকি ঝুকি।
(*** এক ঝুড়ি কলা ঝুঁকে ঝুঁকে।)

দশজনক ডাকে পুজা দিম
(দশজনকে ডেকে পূজা দেব)
সিগ্গীৰ সমবাৰুক দে বেৰ কৰি ।
(শিগগিরই সোমবারুকে বের করে দিন।)

অল্পো খানিক পৰে ডাকে থাকোং তোক,
(অল্পক্ষণ পরপর ডাকতে থাকি তোকে)
আ-হৈয়া সমবাৰু সমবাৰু সমবাৰ...
(ওরে ও সোমবারু সোমবারু সোমবারু)

জঙল ঝাৰ ভাঙালু হিৰিৎ কৰি বিৰি আসলু
(জঙ্গল ঝাড় ভেঙ্গে হঠাঠ করে বের হয়ে আসলি)
কোঠাই জায়া মৰাৰ ঘুম ঘুমিয়াছিলু?
(কোথায় গিয়ে মরার ঘুম ঘুমিয়েছিলি?)

জিউটাৰ মোৰ ধ্ক্-ধ্কী তোলালু,
(প্রাণটাতে আমার ধক-ধক তুললি)
বাঃ সমবাৰু বাঃ সমবাৰু!!
(বাবা সোমবারু বাবা সোমবারু)

কবিতাটির দুই একটি বাদে প্রায় সবগুলো শব্দই পঞ্চগড়ের পূর্বাঞ্চলের মানুষ প্রতিদিনের যোগাযোগে ব্যবহার করে। সুতরাং কবিতাটি এই এলাকার মানুষের বুঝতে একদম কষ্ট হবে না। মূলতঃ এই কবিতায় সোমবারে জন্ম নেয়া সোমবারু নামের এক গরুর জঙ্গলে হারিয়ে যাওয়া ও খুঁজে পাওয়ার বর্ণণা উঠে এসেছে। আহা! কি চমৎকার।

এই যে জন্মবারের নামেই নাম রাখা, এটি যে কেবল গৃহপালিত পশুর ক্ষেত্রে চলে তা নয়। পঞ্চগড় ও আশপাশের এলাকায় প্রায়শই কিছু লোক পাওয়া যাবে যাদের নাম জন্মবার দিয়েই হয়েছে। যেমন- মঙ্গলবারের মোংগোলু, বুধবারে বুধারু, বিষুধবারের (বৃহস্পতিবার) বিষু; শুক্রবারের শুকুরু, সোমবারের সোমারু ইত্যাদি।

চলবে…

প্রথম পর্বের লিংক
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই এপ্রিল, ২০২৩ সকাল ৮:০০
৬টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ইন্দিরা গান্ধীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক: ওরিয়ানা ফলাচির সাক্ষাৎকার

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৫


১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইতালীয় সাংবাদিক ওরিয়ানা ফলাচি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকার নেন। এই সাক্ষাৎকারে মুক্তিযুদ্ধ, শরনার্থী সমস্যা, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক, আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী পররাষ্ট্রনীতি এবং পাকিস্তানে তাদের সামরিক... ...বাকিটুকু পড়ুন

=যাচ্ছি হেঁটে, সঙ্গে যাবি?=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:০৬


যাচ্ছি হেঁটে দূরের বনে
তুই কি আমার সঙ্গি হবি?
পাশাপাশি হেঁটে কি তুই
দুঃখ সুখের কথা ক'বি?

যাচ্ছি একা অন্য কোথাও,
যেখানটাতে সবুজ আলো
এই শহরে পেরেশানি
আর লাগে না আমার ভালো!

যাবি কি তুই সঙ্গে আমার
যেথায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

আগামী নির্বাচন কি জাতিকে সাহায্য করবে, নাকি আরো বিপদের দিকে ঠেলে দিবে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:১২



আগামী নির্বচন জাতিকে আরো কমপ্লেক্স সমস্যার মাঝে ঠেলে দিবে; জাতির সমস্যাগুলো কঠিন থেকে কঠিনতর হবে। এই নির্বাচনটা মুলত করা হচ্ছে আমেরিকান দুতাবাসের প্রয়োজনে, আমাদের দেশের কি হবে, সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গু এনালিস্ট কাম ইন্টারন্যাশনাল সাংবাদিক জুলকার নায়েরের মাস্টারক্লাস অবজারবেশন !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:২৬

বাংলাদেশের দক্ষিণপন্থীদের দম আছে বলতে হয়! নির্বাচন ঠেকানোর প্রকল্পের গতি কিছুটা পিছিয়ে পড়তেই নতুন টার্গেট শনাক্ত করতে দেরি করেনি তারা। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ ঘিরে নতুন কর্মসূচি সাজাতে শুরু করেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক্ষমতাচ্যুত ফ্যাসিবাদ: দিল্লির ছায়া থেকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র

লিখেছেন কৃষ্ণচূড়া লাল রঙ, ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ ভোর ৫:৫৭

একটা সত্য আজ স্পষ্ট করে বলা দরকার—
শেখ হাসিনার আর কোনো ক্ষমতা নেই।
বাংলাদেশের মাটিতে সে রাজনৈতিকভাবে পরাজিত।

কিন্তু বিপদ এখানেই শেষ হয়নি।

ক্ষমতা হারিয়ে শেখ হাসিনা এখন ভারতে আশ্রয় নিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

×