
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র মাসুদ আল মাহাদীর আত্মমুক্তির কথা মনে হলে আজও একটা প্রবল ঝাঁকুনি খাই। দুনিয়ার বাস্তবতায় ফিট খেতে না পেরে নিজেকে চিরমুক্তি দিলেন। শুনেছিলাম, তাঁর নাকি শিক্ষক হওয়ার ইচ্ছে ছিলো। এইটা হইতে না পারায় নিজের জীবনের অর্থ হারিয়ে ফেলেছিলেন বোধ হয়। কয়দিন আগে রুয়েটের দুইটা ছেলে পরপর কয়েকদিনের ব্যবধানে নিজেদের চিরোমুক্তি দিয়েছিলো। এইসব খবর কানে বাজলে খারাপ লাগে। আবার ভালোও লাগে- এই সিসিফাসের জীবনে প্রত্যেকদিন নির্থক পাথর টানার দরকারটাই বা কী! এর চেয়ে জীবনের অমোঘ সত্য- মৃত্যুকে আলিঙ্গণ করাই উত্তম নয় কি?
হোমারের ইলিয়াড বলে, এফিরিয়া বা করিন্থের রাজা সিসিফাস ছিলেন নশ্বর মানুষদের মধ্যে সবচেয়ে চতুর আর জ্ঞানী। তিনি দেবতাদের বিরুদ্ধে গিয়েছিলেন। শাস্তির জন্য তাকে মৃত্যু দেয়া হলেও তিনি মৃত্যু দেবতাকে দুই-দুই বার কলা দেখান। তৃতীয়বার আর রক্ষে হয় না। তাকে দেবতারা শাস্তি দেয় একটা পাথর পাহাড়ের গোড়া থেকে আবার ওপরে তুলতে হবে। সেই পাথর আবার নিচে গড়িয়ে পড়বে। আবার তাকে কষ্ট করে ওপরে তুলতে হবে। সিসিফাস জানেন এটা নির্থক কাজ। তবুও এই পণ্ড শ্রমেই তাঁর আনন্দ। ফঁরাসী দার্শনিক অ্যালবের কামু তাঁকে অ্যাবসার্ড হিরো বা নির্থকতার নায়ক আখ্যা দিয়েছেন। কামুর মতে, সিসিফাসের এই নির্থক পাথর তোলার পৌনঃপুনিকতা মানুষের জীবনেরই প্রতিরূপ- অর্থহীন বেঁচে থাকা।
এই যে রোজ ঘুম থেকে উঠি, খাই, ঘুমাতে যাই, জীবনের শত সমস্যা সমাধানে ব্যস্ত হয়ে পড়ি- দিন শেষে এসবের মানে কী? ‘প্রতিটি দিনের নতুন জীবাণু আবার স্থাপিত হয়’, প্রতিদিনই তো সিসিফাসের পাথরই কাটতে হয়- তবু কি পাথর কাটা শেষ হয়? ইঁদুর দৌঁড়ে পড়ে আমরা প্রতিনিয়ত ছুটি, তবু এই ছোটা অনন্ত। তাহলে এর শেষ কোথায়? মৃত্যু? যদি তা-ই হবে তাহলে এসব আত্মমুক্তির খবর শুনে খারাপ লাগবে কেন? অর্থহীন একটা জীবন অযথা ৫০/৬০/৭০ বছর টেনে বেড়ানোর মানে কী? জন্ম যখন হয়েছে, মৃত্যুই তখন চরম সত্য, অ্যাবসোলিউট ট্রুথ। তাহলে বৃদ্ধ বয়সে বার্ধক্যে মরার চেয়ে ইচ্ছেমত যখন-তখন মরাই কি ভালো নয়?
যে বিরাট পৃথিবীটাকে জৈবিক চোখে দেখে মনে হয় প্রতিটি জীবন এখানে অনেক বিস্তৃত, আদতে সেই পৃথিবী অজস্র মাল্টিভার্স, সহস্র ছায়াপথ, গ্যালাক্সি সৌরজগতের ভেতর একটা নগণ্য কণা মাত্র- অনন্ত মহাবিশ্বের চিরন্তন অন্ধকারে এই বিরাট পৃথিবীকে একটা ক্ষুদ্র নীল বিন্দু মনে হয়। সেই নগণ্য বিন্দুতে ইহজাগতিক মোহে আচ্ছন্ন হয়ে আমরা নির্থক জীবনটাই প্রতিদিনের মত টেনে বেড়াই। বাঁচতে হয় বলে বাঁচি, শ্বাস নিতে হয় বলে নেই, খেতে হয় বলে খাই। নিজেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভাবি- নিজের চিন্তা, বিশ্বাস, জীবনকেই একমাত্র সত্য বলে মনে হয়- নিজেদের বেঁচে থাকাটা জগতের সব থেকে মহান ব্যাপার বলে ভাবি। ইঁদুর দৌঁড়ের চক্করে পড়ে মনভোলানো ক্ষমতা, বিত্ত, যৌনতা, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের পেছনে ছুটে বেড়াই। একটা পেয়ে গেলে আরেকটা নতুন পাওয়ার আশায় নতুন করে নিজেকে ইঁদুর দৌঁড়ে নিয়োজিত করি। না পেলে হতাশায় ভুগি। আশায় বুক বেঁধে পাওয়ার জন্য আবার চেষ্টা করতে বসি। আসলেই এটাই কি জীবনের সত্য অর্থ! এই পাওয়া না পাওয়ার হিসাব-নিকাশেই বেঁচে থাকার মাহাত্ম্য?
অথচ সত্য এই যে, এই জীবনের কোনো মাহাত্ম্য নাই। কামু যেমন বলেন- জীবনের কোনো অর্থই নাই। যারা আগেই জীবন যে ‘শুভঙ্করের ফাঁকি’ বুঝতে পারে, তারা বুঝে যায় মৃত্যুই সত্য। মৃত্যুর পর মানুষের স্থান মর্ত্যরে গর্তে, পাতালের নরকে পচে। মানুষ যখন এটা বুঝতে পারে তখন সে আত্মমুক্তি দেয়- শারীরিকভাবে। শিল্পী ভ্যান গখ, কবি জীবনানন্দ, গায়ক কার্ট কোবেইন... আরও কত জনের কথা বলব! এই যে প্রায়ই খবরে দেখি ফাল্গুনের রাতের আঁধারে দড়িতে ঝুলে পড়ে টগবগে তরুণ- অথচ কারও কারও তো প্রেম ছিলো, আশা ছিলো, অর্থ, বিত্ত, যশ, সবই তো ছিলো অনাগত পথে- তবুও যূথচারী আঁধারের গাঢ় নিরুদ্দেশ্যে যাবার জন্য কেন তারা লাশকাটা ঘরে শুয়ে পড়ে বারবার? কোন বিপন্ন বিস্ময়ে তারা শূন্য করে দিয়ে যায় জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার? জীবনের ইঁদুর দৌঁড়ে ছুটেও কি তারা পেল না অর্থ কোনো আর?
মানবসভ্যতার জ্ঞানীয় বিবর্তন বলে, যুগে যুগে মানুষ পৃথিবীতে তার অস্তিত্বের মানে খুঁজে এসেছে। জীবনের অর্থ খুঁজেছে। যখন পায় নি তখন জীবনকে অর্থ দেয়ার চেষ্টা করেছে। জীবনের অর্থ দিতে গিয়ে আত্ম-কে দাসত্বের হাতে তুলে দিয়েছে। ধর্ম, দর্শন, তত্ত্ব ইত্যাদি খাড়া করে মানুষকে তার জীবনের অর্থ দিতে চেষ্টা করেছে। ভেড়ার পালের মত গণহারে অন্যের চিন্তাকে নিজের অবলম্বন ভেবে মেনে নিয়েছে। এটাই তো বুদ্ধিবৃত্তিক মৃত্যু- নিজের চিন্তার ক্ষমতাকে গলাটিপে অন্যের চিন্তার দাস হয়ে যাওয়া। কিন্তু গলাটিপলেই কি চিৎকার আটকানো যায়! যে জীবনকে মানুষ এতোদিন অর্থময় ভেবে এসেছে, এখন সেই বোকার স্বর্গ বালুঘরের মত হওয়ার ধাক্কায় ভেঙ্গে পড়ছে। মানুষ বুঝতে শিখেছে- জীবনের কোনো অর্থ নেই। নিৎশে যেমন বলেন- মানুষের অস্তিত্বেরও কোনো অর্থ নাই।
তাহলে মানুষ বাঁচবে কেন? সাঁত্রে, কিয়েরকেগ্রাদ, কামু, নিৎশেদের অর্থহীনতায় মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য কী হবে তাহলে? আসলে মানুষের জীবনে মৃত্যু ছাড়া আর কোনো উদ্দেশ্য নাই। জীবনের শেষ কথা মৃত্যু। তারপর আর কিছু নাই। তাহলে কী বেঁচে থাকবো কিসের জন্য? কামু এই উত্তর সিসিফাসের পাথর তোলার মিথের মধ্যেই দিয়েছেন। সিসিফাসের জীবন একটা বিদ্রোহের নাম, দেবতা-মৃত্যুভয়-নির্থকতাকেও উপেক্ষা করে প্রতিবার পাথর তোলে। আমার এক বন্ধু (এনায়েত মুন্সী) যেমন একদিন গল্পে গল্পে বলে ফেললো- চোখ খুলেই দেখি আমি অন্ধ। অন্ধত্বের দশা থেকে বেড়িয়ে মানুষ প্রথমেই অন্ধকারটাই দেখে। তফাৎ শুধু ওই এক জায়গাতেই- সবাই না বুঝেই অন্ধ। আর কেউ কেউ চোখ খুলেই দেখে অন্ধকারটাই শাশ্বত।
সব কিছু নির্থক জেনে-শুনেই বাঁচার মধ্যেই মানুষের বিদ্রোহ। এই চোখ খুলে শাশ^ত অন্ধকার দেখে বেঁচে থাকতে পারাই তার স্বাধীনতা। এটা কোনো মিছে আশার কথা নয়, মনভোলানো নীতিকথাও নয়। জীবনের অর্থ নেই- এটা মেনে নিয়েই বাঁচো। জীবনের প্রতি আসক্তি থেকেই বেঁচে থাকো। বাঁচতে না চাইলে, মরে যাও। শরীরের মৃত্যু ঘটিয়ে গাঢ় অন্ধকারের পথে পা চালাতে পারো, কিংবা বুদ্ধিবৃত্তিকে খুন করে ভেড়ার পালের মত অন্যের টর্চের আলোর রেখা ধরে জীবনের অর্থ খুঁজে দেখতে পারো। ইচ্ছে তোমার। তবু মনে রেখো-
‘সময়ের এই স্থির এক দিক,
তবু স্থিরতর নয়;
প্রতিটি দিনের নতুন জীবাণু আবার স্থাপিত হয়।’
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জুন, ২০২৩ রাত ১২:২৯

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



