এই শিশুদের বেশিরভাগেরই বয়স দশ বছরের মধ্যে, অথচ তাদের আচরণ হয় প্রাপ্তবয়স্কর মত; এদের দেখা মেলে শিশু প্রতিভা অন্বেষণ প্রতিযোগিতায়। এইসব প্রতিযোগিতায় শিশুরা কোন খ্যাতিমান শিল্পীকে অনুকরণ করে নাচ বা গান করে, অনুকরণ যত বেশি ভালো হবে তত বেশি নাম্বার! প্রেমের আকুলতার ভাব চোখে-মুখে- কন্ঠে ফুটিয়ে তুলে একজন তরুণ গান গাইতেই পারে, একজন তরুণী তা নাচের মুদ্রায় প্রকাশ করতেই পারে, কিন্তু একটা ছোট শিশু যখন বড়দের মতো করে এসব করে, আর তা দেখে প্রতিযোগিতার বিচারকেরা উচ্ছ্বাসে ভেসে মুগ্ধ কন্ঠে মন্তব্য করেন "ওর এক্সপ্রেশনটা দেখো, ভয়েস থ্রোয়িংয়ে কি আবেগ... আরেকবার দেখাও তো"... শিশুটা আবারও প্রেমের আকুলতা বোঝাতে চোখ ছোট করে, মুখ বাঁকা করে দুই লাইন গান গায়। দেখে আমার কেমন পাগল পাগল লাগতে থাকে...ব্যবসায়ীরা কেমিক্যাল দিয়ে ফল পাকায় লাভ করার জন্য, এই বাচ্চা গুলোকে এভাবে পাকিয়ে দিয়ে কার কি লাভ হচ্ছে জানিনা!! বিচারকদের উচ্ছ্বাস পূর্ণ "আরেব্বাস, কেয়া বাত!" উক্তির পাশাপাশি দেখা যায় শিশুদের বাবা-মায়ের গর্বিত মুখ, সন্তানের অকালপক্কতা তাদের মনে কোনো গ্লানি বয়ে আনেনা!!!
আমাদের দেশের টিভিতে এক সময় "নতুন কুড়ি" নামে ছোটদের প্রতিভা অন্বেষণের একটা অনুষ্ঠান হতো। সেখানে গান হত- ছড়া গান, শিশুদের উপযোগী নজরুল- রবীন্দ্র সংগীত, পল্লীগীতি, দেশের গান ইত্যাদি। নাচও তেমনি ছিল। সেই অনুষ্ঠানগুলোতে শিশুদের শিশুদের মতই দেখাতো, শিশুদের সাথে বসে বড়রাও অনুষ্ঠান উপভোগ করতেন। অথচ এই যে অনুষ্ঠানগুলো- "সা রে গা মা পা লিল চ্যাম্প", "ডান্স বাংলা ডান্স জুনিয়র", অথবা এদের আদলে তৈরি আমাদের দেশের "ক্ষুদে গানরাজ", সবই যেন শিশুদের অনাবিল শৈশবকে আবিলতায় ভরিয়ে দেবার জন্য তৈরি!!
এই শিশুরা সেলিব্রিটি, তাদের জন্মদাতা হিসেবে তাদের বাবা-মায়েরাও সেলিব্রিটি মর্যাদা উপভোগ করেন অনুষ্ঠান শেষ হবার পরও বেশ কিছুদিন ধরে। তারপর একসময় সাঙ্গ হয় খেলা,
অনুষ্ঠান শেষ হয়। শিশুটি দেখতে পায় তাকে নিয়ে আর মাতামাতি করা হচ্ছে না, রুপালি স্বপ্নের জগত থেকে সে নেমে আসে প্রতিদিনকার ম্যাড়ম্যাড়ে জগতে। এই পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়ানো একটা ছোট শিশুর পক্ষে আদৌ সহজ হয় কিনা তা কি কেউ ভেবে দেখে! একটা মেয়ের কথা মনে পড়ছে, ডান্স বাংলা ডান্স জুনিয়ারের মস্ত সেলিব্রিটি। চার বছরের মেয়ে, অথচ তার চোখ- মুখের আর নাচের ভঙ্গিমা নাকি হুবহু বড়দের মত! তার প্রতিভায় সকলে মুগ্ধ, গরবিনী মায়ের সাথে তার ঝলমলে মুখের ছবি নানা জায়গায় দেখতাম। তারপর আর তার দেখা নেই, কিন্তু সে সম্ভবত রুপালি জগতকে ভুলতে পারছিল না; ৩/৪ বছর পর দেখি মেয়েটা সিরিয়ালে অভিনয় করার চেষ্টা করছে, কিন্তু তেমন জুৎ করতে পারছে না! অবশেষে মেয়েটি হারিয়ে গেল... জানিনা সে জীবনের সাথে কিভাবে খাপ খাইয়েছে!
এ তো গেল মাত্র তিন চার মাস রুপালি জগতে অবস্থান করা শিশুর গল্প। কিন্তু এমনও শিশু আছে, যারা তিন চার বছর ধরে এই রুপালি জগতে বাস করে, তারপর হঠাৎ দেখতে পায় মরীচিকার মত রুপালি জগত মিলিয়ে গেছে! এই শিশুরা কোন সিরিয়ালের মূল চরিত্রে অভিনয় করে থাকে। "পটল কুমার গানওয়ালা" নামের সিরিয়ালে পটল কুমারের নাম ভূমিকায় অভিনয় করা আট বছরের মেয়েটার কথা মনে পড়ছে। দুই বছরের বেশি সময় মেয়েটা সিরিয়ালে অভিনয় করেছে। এক সাক্ষাৎকারে দেখলাম মেয়েটার মা বলছেন, স্কুলে সে দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়তো। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তাকে শুটিং করতে হয়, তাই এখন আর স্কুলে যাবার সুযোগ পায় না। সন্তানকে সেলিব্রিটি বানাতে গিয়ে মা বাবা তাকে শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করছেন!!
সন্তানকে প্রতিভাবান, সেলিব্রেটি প্রমাণ করতে গিয়ে মা-বাবারা মাঝে মাঝে মরিয়া হয়ে ওঠেন। বছর ছয়েক আগে আমাদের বাংলাদেশেই এক ছয় বছরের শিশু কম্পিউটার প্রতিভা নিয়ে মাতামাতি শুরু হল; বলা হল সে কম্পিউটার উইজার্ড, গিনেস বুক অব রেকর্ডসে তার নাম উঠেছে। অতএব সে স্কুলে যায় না, সারাদিন ঘরে বসে শুধু বার্গার খায় আর কম্পিউটার প্রোগ্রামিং করে। ফলে তার আকার অনেকটা ফোলানো বেলুনের মতো হয়ে গেছিল! যখন দেখলাম ভারতীয় তের বছরের এক ছেলে গুগোলে যোগ দিয়েছে, তখন আমার মনে পড়ল এই কম্পিউটার উইজার্ডের কথা। এখন তার কি অবস্থা, তা জানবার জন্য অন্তর্জালে অনেক খোঁজাখুঁজি করলাম, কিছু পেলাম না... লেখাপড়া, খেলাধুলা বাদ দিয়ে সারাদিন বসে প্রোগ্রামিং করলে একটা ছয় বছরের ছেলের কোন উপকার হয় না, মা- বাবা কি সেটা বুঝতে পারেন নি! নাকি সেলিব্রেটির মা- বাবা হবার আকাঙ্খায় সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভাবেনই নি!!
শৈশব হওয়া উচিত আনন্দময়, নিশ্চিন্ততায় ভরা, অন্তত জীবনের প্রথম দশ বছর। অবশ্যই অনেক শিশু প্রতিভাবান হয়, কিন্তু তাই বলে সেই প্রতিভাকে পুঁজি করে শিশুকে সেলিব্রেটি বানিয়ে তার শৈশবের আনন্দকে বিসর্জন দেয়া ঠিক হয় কি!! অনেক দেশে দেখি রাজপরিবারের, প্রেসিডেন্টের, বা যেকোন সেলিব্রেটির শিশু সন্তান থাকলে তারা চেষ্টা করেন শিশুর উপর যেন সেলিব্রেটির তকমা না লাগে, শিশু যেন একটা স্বাভাবিক শৈশব পায়। অথচ আমাদের দেশে এর উল্টোটাই দেখা যায়!
প্রার্থনা করি, কোন মা- বাবা যেন সেলিব্রেটি সন্তানের মা- বাবা হতে গিয়ে সন্তানকে শৈশবের আনন্দ থেকে বঞ্চিত না করেন।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জুন, ২০১৯ রাত ১০:৫৬