এইসব শিশু কঠিন রোগে আক্রান্ত। শুধু কঠিন রোগ বললে পুরোটা বলা হয় না, এমন রোগে আক্রান্ত যার নিরাময় সম্ভব, কিন্তু চিকিৎসা ব্যয় সাধ্যের বাইরে। চিরকাল যে রোগাক্রান্ত ছিল তা কিন্তু না, অন্য শিশুদের মত এরাও হেসে খেলে বেড়াতো, তারপর হঠাৎ একদিন জ্বর বা অন্য কোন উপসর্গ থেকে ধরা পড়ে যে, তারা শরীরে কোন রোগ বয়ে বেড়াচ্ছে। এমন অবস্থায় ডাক্তার মা- বাবাকে বলেন, সন্তানকে বাঁচানো সম্ভব হবে যদি এই এই চিকিৎসা করা যায়! চিকিৎসা ব্যয় সাধারণত অনেক বেশি হয়, (আমি উচ্চবিত্ত ঘরের সন্তানদের কথা বলছি না) তবু ডুবন্ত মানুষ যেমন খড়কুটো আঁকড়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে, তেমনি এমন শিশুদের মা বাবা সন্তানকে বাঁচাবার জন্য প্রবলভাবে চেষ্টা করতে থাকেন। প্রথমে নিজস্ব সঞ্চয় (যদি থাকে) শেষ করেন, তারপর ঘটি বাটি বিক্রি করতে থাকেন, তারপর ঋণ করে সন্তানকে বাঁচাবার যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকেন... অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হন। কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান হয়না!
খেয়া (কাল্পনিক নাম) আমার পরিচিত ফুটফুটে প্রাণবন্ত একটা মেয়ে! ওর বয়স যখন ছয় বছর, তখন ধরা পড়ল এক কঠিন রক্ত-রোগ। দেশের নানা হাসপাতালে ঘুরে রোগের কোন সুরাহা না হওয়ায় খেয়ার বাবা-মা ধারদেনা করে পাঁচ/ছয় লক্ষ টাকা নিয়ে চেন্নাই গেলেন, সে টাকা শেষ হয়ে গেল কিন্তু চিকিৎসা শেষ হল না; আরো বারো লক্ষ টাকা দরকার, দুই মাসের মধ্যে অস্ত্রোপচার (বোন ম্যারো ট্র্যান্সপ্লান্ট) করতে হবে। নিরুপায় বাবা-মা অর্থ সংগ্রহের জন্য খেয়াকে নিয়ে দেশে ফিরলেন। এবার পত্রিকা, টিভি, ফেসবুকে খেয়ার জন্য সাহায্যের আবেদন জানান হল। ব্যাপক প্রচারণা আর সকলের আন্তরিক চেষ্টায় সাহায্য এলোও, পঞ্চাশ টাকা থেকে শুরু করে সত্তর হাজার টাকা পর্যন্ত; দেড় মাসে জমা হল আট লক্ষ টাকা। সেই টাকাসহ খেয়াকে নিয়ে বাবা-মা চেন্নাই গেলেন। একটাই ভাবনা তাদের, পুরো টাকা জোগাড় হলে মেয়ের অস্ত্রোপচার হবে, না হলে তাদের আদরের কন্যা টি মারা যাবে।
পুরো টাকা জোগাড় হয়নি, কিছুদিন পর খেয়া মারা গেল।
অহনের (সত্যিকারের নাম) ক্যানসার। ওর বয়স বোধহয় ১০/১১ বছর হবে, ফেসবুকে নিজেই কথা বলছিল যে, সে বাঁচতে চায়, সকলে যেন তাকে সাহায্য করেন। ওর দেয়া নাম্বারে ফোন করলাম। ওর মা জানালেন ছয় লক্ষ টাকা জমা হয়েছে, দরকার পঁয়ত্রিশ লক্ষ টাকা। আমার সাধ্য অতি সামান্য; আমি বুঝতে পারলাম না কি বলবো... ফোন রেখে দিলাম।
এমন আরও কত খেয়া, অহন আছে... নিরুপায় বাবা-মায়ের চোখের সামনে এরা দিনে দিনে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়।
"শুয়ে শুয়ে অশোক পাতায়
মুমূর্ষু শিশির ভাবে হায়,
কোন সুখ ফুরালো না যার
তার কেন জীবন ফুরায়?"
অনেক কাল আগে, বিটিভিতে প্রচারিত হত হুমায়ূন আহমেদের লেখা তুমুল জনপ্রিয় ধারাবাহিক নাটক, এইসব দিনরাত্রি। নাটকে একটা ছোট মেয়ে ছিল, নাম ছিল টুনি। সেই মেয়েটার ক্যান্সার ধরা পড়ায় মধ্যবিত্ত মা বাবার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে, বিদেশে কি করে চিকিৎসা করাবেন তাই ভেবে! তাদের এক উচ্চবিত্ত আত্মীয় টুনিকে চিকিৎসা করাতে জার্মানিতে নিয়ে যান। টুনিকে নিয়ে দর্শকদের প্রবল উৎকণ্ঠা শুরু হয়। এই পর্যায়ে কি করে জানিনা, জানা যায় যে টুনি মারা যাবে- অমনি সবাই (তাদের মধ্যে ছিল হুমায়ূন আহমেদের নিজের মেয়েরা) লেখককে অনুরোধ জানাতে থাকে, টুনিকে কে যেন বাঁচিয়ে রাখা হয়। হুমায়ূন আহমেদ অনুরোধ রক্ষা করেননি। টুনির মৃত্যু কাল্পনিক হলেও, সেসময় আমাদের দুঃখটা ছিল আসল।
আজ নানারকম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থাকায় এমন অনেক টুনির অসুস্থতার খবর পাই, টাকার অভাবে এরা ঠিকমতো চিকিৎসা না পেয়ে মারা যায়।
দুঃখ হয় খুব... কেন যে এরা এদেশে শিল্পী হয়ে জন্মালো না!!
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জুন, ২০১৯ বিকাল ৩:৪৭