জেসিকা লালের ঘটনাটা এরকম:
জেসিকা লাল ছিলেন দিল্লির এক বারের কর্মী। ১৯৯৯ সালের এক রাতে তিনি যখন বার বন্ধ করছেন, তখন মনু শর্মা তার দুই বন্ধু নিয়ে এসে উপস্থিত হয়, এবং তাদের মদ দিতে নির্দেশ দেয়। নির্দেশ উপেক্ষা করেন জেসিকা লাল; রেগে গিয়ে জেসিকার কপালে বন্দুক ঠেকিয়ে দুবার গুলি করে তাকে হত্যা করেন মনু শর্মা। এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন অনেকজন।
মনু শর্মা ছিলেন হরিয়ানার অতি প্রভাবশালী ও ধনবান, সর্বোপরি মুখ্যমন্ত্রী ভূপিন্দর সিং-এর ঘনিষ্ঠ সহযোগী বিনোদ শর্মার ছেলে। সুতরাং মনু শর্মার বিরুদ্ধে আনা হত্যাকাণ্ডের অভিযোগের তদন্ত ও বিচারে তার বাবার রাজনৈতিক ও আর্থিক প্রভাব খাটানো হয়। ফলে সমস্ত প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও দেখা গেল হত্যাকাণ্ডের বাদী জেসিকার পরিবার,(মূলত তার বোন সাবরিনা) বিবাদী মনু শর্মার পরিবারের বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারল না। ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আদালত পর্যাপ্ত প্রমাণের অভাব দেখিয়ে মনু শর্মা ও তার বন্ধুদের মুক্তি দেয়, অর্থাৎ বলা হয় জেসিকাকে কেউ মারে নি। এই রায় দেখে জেসিকার মা হার্টফেল করে মারা যান, আর তার বাবা অসুস্থ হয়ে আই সি ইউ তে ভর্তি হন। দীর্ঘকাল শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াই করে হেরে যাওয়া সাবরিনা নীরবে দূরে চলে যায়।
কিন্তু সাধারণ জনগণ এই রায়ের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদে ফেটে পড়ে, ফলে আবার নতুন করে তদন্ত শুরু এবং দ্রুত বিচার হয়। ২০০৬ সালের ডিসেম্বর মাসে বিচার শেষ হয়, এবার মনু শর্মার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় হয়।
রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে কিভাবে সমস্ত প্রমাণ লোপাট করে হত্যার অভিযোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়, এই ঘটনায় তার বিশদ বিবরণ মেলে। এই ঘটনা নিয়ে পরে "No one killed Jessica" নামে চলচ্চিত্র তৈরি হয়।
এমন ঘটনার বাংলাদেশী ভার্সনও আছে, অর্থাৎ দীর্ঘ কাল বিচারকাজ চলার পর রাজনৈতিক প্রতিপত্তিশালী হত্যাকারী বেকসুর খালাস পেয়ে যায়, যেমন বুশরা হত্যার ঘটনা। জেসিকা হত্যার এক বছর পর, ২০০০ সালে রূশদানিয়া ইসলাম বুশরাকে ধর্ষণের পর খুন করা হয় তার নিজের বাড়িতে, নিজের ঘরে। পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে দেখা যায় প্রধান সন্দেহভাজন বুশরার চাচা এম এ কাদের, সম্পত্তি নিয়ে বিরোধের কারণে নিরীহ বুশরা খুন হয়েছে। কাদের ছিলেন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা, ফলে তদন্ত কাজ ঢিমেতালে আগাতে থাকে। কিন্তু মিডিয়ায় বার বার ফলো আপ আসতে থাকে, ফলে পুলিশ কাদেরকে রিমান্ডে নেয় এবং হত্যাকাণ্ডে তাকে সহযোগিতার দায়ে গ্রেপ্তার করে কাদেরের স্ত্রী রুনু কাদের এবং দুই শ্যালক শওকত ও কবীরকে। শোকসন্তপ্ত বুশরার বাবাও তিন বছর পর মারা গেলেন, তখন তার মা বিচারের আশায় একাই লড়ে গেছেন। ২০০৩ সালের ৩০শে জুন নিম্ন আদালত কাদেরসহ তিনজনকে মৃত্যুদন্ডের এবং রুনুকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় দেন। মামলা যায় হাইকোর্টে। ২০০৭ সালের ২৯শে জানুয়ারি হাইকোর্টে আপিলের রায়ে কাদেরের ফাঁসি ও রুনুর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বহাল থাকে, বেকসুর খালাস পায় শ্যালকদ্বয় শওকত ও কবীর। এই রায়ের বিরুদ্ধে দুই পক্ষই সুপ্রিম কোর্টে আপিল করলে রায় হয় ২০১৬ সালের ১৫ নভেম্বর; রায়ে কাদের ও রুনু খালাস পান, অর্থাৎ বুশরা খুন হলেও কোন খুনী নেই, No one killed Bushra...
দীর্ঘ ষোল বছর মেয়ের হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়ে লড়াই করার পর যখন বুশরার মা দেখলেন এই
হত্যাকাণ্ডের কোন খুনী পাওয়া গেল না, তিনি বললেন,
" - - - তাহলে বুশরাকে খুন করলো কে? আমার তো মনে হয়, বুশরা নামে কখনো কেউ ছিল না..." view this link
একই ভাবে বলা যায়, আবু বকরকে কেউ খুন করেনি!! ৩ ফেব্রুয়ারি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আবু বকরের মৃত্যুর দশ বছর পূর্ণ হল। ২০১০ সালের ৩ ফেব্রুয়ারী ছাত্র লীগের গোলাগুলি চলাকালীন হলে নিজের ঘরে বসে পড়ছিল মেধাবী ছাত্র আবু বকর। দরিদ্র পরিবারের এই ছেলেটিকে নিয়ে মা-বাবার অনেক স্বপ্ন ছিল; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ তার মা তিন বছর মাথায় তেল না দিয়ে জমিয়েছিলেন। আবু বকরের স্বপ্ন ছিল শিক্ষক হবার, সে তার শ্রেণীতে সর্বোচ্চ সিজিপিএ পেয়েছিল। মাথার ভেতর একটি বুলেট ঢুকে তার সমস্ত স্বপ্ন ও সম্ভাবনার সমাপ্তি টেনে দেয়...
২৬ জানুয়ারি, ২০১৮ এর প্রথম আলোর খবরের শিরোনাম, "আবু বকরকে কেউ খুন করেনি।" কারণ হত্যা মামলায় অভিযুক্ত ছাত্রলীগের দশ নেতা-কর্মীর সবাই বেকসুর খালাস পান। রাষ্ট্রপক্ষ এ নিয়ে আর আগায় নি, এমনকি আবু বকরের পরিবারকে রায়টাও জানায়নি। view this link
আবু বকর হত্যার দশ বছর কেটে গেছে। তার পরিবার সম্ভবত মেনে নিয়েছে এই অবিচার। আবু বকরের ভাই বলছে,
"- - - বিশ্ববিদ্যালয়ই একমাত্র স্থান, যেখানে কোনো ছাত্র হত্যার বিচার ঠিকমতো হয়নি।"
" আমার ভাই আবু বকর হত্যার সুষ্ঠু বিচার পাইনি। আমরা জানতে চাই, আমার ভাই আবু বকরের খুনি কে?" view this link
আরো দশ বছর অপেক্ষা করলেও কি আবু বকরের প্রিয়জনরা জানতে পারবে খুনি কে? বরং তারা ভেবে নিক না,আবু বকর বলে কেউ ছিলই না...
মরাল: রাজনৈতিক প্রতিপত্তিশালী কেউ যদি সাধারণ জনগণের কাউকে খুন করে, তবে বুঝে নিতে হবে বিচার শেষে কোন খুনী পাওয়া যাবে না; এক্ষেত্রে নিহতের সম্পর্কে ভেবে নিতে হবে, আসলে এমন কেউ কখনোই ছিল না।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:৫১