আগের পর্ব: নতুন জীবন- চার
মর্টনকে শায়েস্তা করতে না পেরে বাবা দিনরাত ঘরের ভেতর আস্ফালন করে বেড়াতে লাগলেন। এই অশান্তি এড়ানোর জন্য বাড়ি থেকে সুযোগ পেলেই কেটে পড়তাম- সবার নজর এড়িয়ে চলে যেতাম সোফির বাসায়। প্রান্তভূমির মানুষদের আক্রমনের পর এলাকায় শান্তি বিরাজ করছে, সবাই নিজেদের ক্ষেতখামারের কাজে ব্যস্ত, তাই হঠাৎ এদিকে কোন মানুষ চলে আসার সম্ভাবনা কম। এজন্য সোফির মা-বাবা ওকে বাড়ির কাছাকাছি ঘোরাঘুরি করার অনুমতি দিয়েছিলেন। এই ঘোরাঘুরির ফাঁকে ফাঁকে আমি স্কুলে যা যা শিখেছি সেসব সোফিকে বলতাম। সোফি কখনো স্কুলে যায়নি, ওর কোন বইও ছিল না। ওর মা-বাবা অবশ্য ওকে লিখতে পড়তে শিখিয়েছিলেন।
আমি ওকে স্কুলের বইয়ে শেখা বিষয়ে বলতাম যে ধারণা করা হয়, পৃথিবী বিশাল আর সম্ভবত গোলাকার। পৃথিবীর যে অংশ সভ্য হয়ে উঠছে তার নাম ল্যাব্রাডর, আমাদের ওয়াকনুক ল্যাব্রাডরের একটা ছোট এলাকা। ল্যাব্রাডর নামটা সম্ভবত প্রাচীন মানুষের দেয়া। ল্যাব্রাডরকে ঘিরে আছে বিশাল জলরাশি, একে বলে সমুদ্র, সমুদ্রে প্রচুর মাছ পাওয়া যায়। অবশ্য আমার চেনাজানার মধ্যে একমাত্র এক্সেল খালু ছাড়া আর কেউ সমুদ্র দেখেননি। যদি কেউ আমাদের এলাকা থেকে তিনশ' মাইল পূর্ব, উত্তর বা উত্তর- পশ্চিমে যায়, তবে একসময় সমুদ্রে পৌঁছে যাবে, কিন্তু দক্ষিণ বা দক্ষিণ- পশ্চিমে গেলে পৌঁছাবে প্রান্তভূমিতে, আর তারপর পোড়াভূমিতে, যেখানে মৃত্যু অবধারিত। ধারণা করা হয় অনেক কাল আগে ল্যাব্রাডর ছিল প্রচন্ড ঠান্ডা, সেখানে তখন কেউ থাকতেই পারত না। কতকাল আগে, তা অবশ্য জানা যায় নি- হতে পারে একহাজার, দুহাজার বছর, অথবা আরো বেশি- কেউ ঠিকমতো বলতে পারেনা। ঈশ্বরের অভিশাপ নেমে আসার পর বহুদিন মানুষ বর্বর জীবন যাপন করেছে। আমাদের আছে তিনশ' বছরের লিখিত ইতিহাস, তার আগে যা ছিল সব তলিয়ে গেছে বিস্মৃতির অতলে। প্রাচীন মানুষের সম্পর্কে অনেক কিছু জানা গেছে মাটির নিচে পুঁতে রাখা অনেক পুরানো এক সিন্দুক আবিষ্কৃত হবার পর, সেটি থেকে অনেক তথ্য পাওয়া গেছে। আগে ভাবা হত শুধু ল্যাব্রাডর আর নিউফ দ্বীপেই বুঝি প্রাণের অস্তিত্ব আছে। কিন্তু পরে দেখা গেছে পোড়াভূমির মাঝে মাঝে প্রান্তভূমি রয়েছে- যেখানে সমস্ত কিছুই বিকৃত। এর বাইরে পৃথিবীতে আর কিছু আছে কিনা, সে সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি।
এছাড়া স্কুলে পড়ানো হত নীতিমালা। নীতিমালার অধিকাংশই শুধু করনীয় আর বর্জনীয় সম্পর্কে উপদেশ। বলা হত, আমরা যদি সমস্ত বিকৃতি, বিচ্যুতি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, তবে একসময় আমরা মানুষ হিসেবে আমাদের হারানো গৌরব ফিরে পেতে পারি। তাই আমাদের সদা সতর্ক থাকতে হবে পাপাত্মা সম্পর্কে, বিচ্যুতি সম্পর্কে।
স্কুলে শেখা সবকিছুই সোফিকে বলতাম, কিন্তু এইসব নীতিমালা সম্পর্কে কিছুই বলতাম না। আমার মনে হত এ নিয়ে কথা বললে ও কষ্ট পাবে। আর কথা বলার বিষয়ের তো কোন অভাব ছিল না। বাসার আশেপাশের বনবাদাড়ে ঘুরতে ঘুরতে নতুন দেখা গাছ-পাখি নিয়ে আমরা অনর্গল কথা বলতাম, কিন্তু খুব আস্তে আস্তে। চলতামও গাছপালার আড়ালে আড়ালে, যেন কারো নজরে না পড়ে যাই। এমনিতে সোফির সহজাত প্রবৃত্তিই ছিল এমন, যে কোন মানুষের আভাস পাওয়া মাত্র ও লুকিয়ে পড়তে পারত!
পাঁচ
আমরা একটি তিরতির করে বয়ে চলা ঝর্ণা আবিষ্কার করেছিলাম, সেটাতে মাছ ধরা ছিল এক খেলা। আমি যখন আমার জুতা খুলে, প্যান্ট গুটিয়ে ঝর্ণার পানিতে নেমে একটা ছোট জাল দিয়ে মাছ ধরতাম, সোফি তখন একটা বড় পাথরের উপর বসে সতৃষ্ণ নয়নে আমার মাছধরা দেখত। জুতা পরে তীরে বসেই ও চেষ্টা করত ওর ছোট জালটা দিয়ে মাছ ছেঁকে তুলতে, কিন্তু একটা মাছও ধরতে পারত না। মাছ ধরার এই ছোট জাল দুটো সোফির মা বানিয়ে দিয়েছিলেন, সাথে একটা ছোট পাত্র দিয়েছিলেন মাছ রাখার জন্য।
একদিন সাহস করে সোফি জুতা খুলে ফেলল, তারপর স্বচ্ছ, অগভীর দাঁড়িয়ে নিজের পায়ের পাতার দিকে চেয়ে কি চিন্তা করত লাগলো। আমি ভরসা দিয়ে বললাম,
- এদিকে এসো। এখানে অনেক মাছ আছে...
সোফি মহাখুশি হয়ে হাসতে হাসতে ছুটে এল। দুজনে জাল দিয়ে মাছ ধরতে লাগলাম মহানন্দে, বেশ খানিকটা মাছ ধরার পর আমরা একটা বড় পাথরের উপর বসলাম পা শুকাবার জন্য।
ক'দিন পর আবার মাছ ধরতে গেলাম, জুতা খুলে রাখলাম বড় পাথরের উপর, মাছ রাখার পাত্রের পাশে। যেটুকু মাছ পাচ্ছিলাম তা পাত্রে রেখে আবার ছুটে যাচ্ছিলাম মাছ ধরতে, কোনদিকে আর খেয়াল ছিল না... হঠাৎ শুনি কে যেন বলছে,
- এ্যাই ডেভি-ই-ড, এখানে কি করছ?
আমি টের পেলাম আমার পেছনে দাঁড়ানো সোফি পাথরের মত জমে গেছে। সামনে তাকিয়ে দেখলাম আমাদের জিনিসপত্রের পাশে দাঁড়িয়ে আছে এ্যালেন, কামার জন এরভিংয়ের ছেলে। এ্যালেন আমার চেয়ে প্রায় দু'বছরের বড়।
আমি নিস্পৃহভাবে বললাম,
- এ্যালেন, কি খবর!
ওর সাথে আলাপে কোনো আগ্রহ না দেখিয়ে পানির উপর দিয়ে হেঁটে গেলাম পাথরের ওপর, যেখানে সোফির জুতা জোড়া রাখা ছিল।
- ধর! ওর দিকে জুতা ছুঁড়ে দিয়ে চিৎকার করে বললাম। সোফি একটা ধরতে পারল, আরেকটা পানি থেকে তুলে নিল। আমি এ্যালেনকে পাত্তা না দিয়ে আমার জুতা পড়তে লাগলাম।
- মেয়েটা কে?
এ্যালেন জিজ্ঞেস করল। আমি উত্তর দিলাম না। আড়চোখে দেখলাম সোফি ঝর্ণার অন্যপাশে ঝোপের পিছনে
লুকিয়ে পড়েছে।
- মেয়েটা কে? আবার জিজ্ঞেস করল,'মেয়েটাতো আমাদের কোন...' বলতে বলতেই থেমে গেল। তাকিয়ে দেখি ওর নজর আমার পাশে পাথরের ওপর। আমি তাড়াতাড়ি সেদিকে ফিরলাম...পাথরের ওপর ভেজা পায়ের ছাপ, একটু আগেই সেখানে সোফি এক পা তুলে পাত্রে মাছ রাখতে গিয়েছিল।এখনও পুরোপুরি শুকায় নি, তাই পায়ের ছয় আঙ্গুলের ছাপ স্পষ্ট। ভাবতে এক মূহুর্ত লাগলো আমার; পরক্ষণেই আমি মাছের পাত্র উল্টে দিলাম! পানিতে পায়ের ছাপ মিলিয়ে গেল, কিন্তু বুঝতে পারছিলাম, ক্ষতি যা হবার হয়ে গেছে...
- ও..., বাঁকা হেসে বলল এ্যালান, 'মেয়েটা কে?'
- আমার বন্ধু, আমি বললাম।
- নাম কি ওর?
আমি উত্তর দিলাম না।
- ঠিক আছে আমিই জেনে নেব...
- যা ভাগ্, নিজের চরকায় তেল দে!
দেখলাম এ্যালেন আমার কথা শুনছে না, সোফি যেদিকে ঝোপের পেছনে গিয়েছে সেদিকে তাকিয়ে আছে। আমি দৌড়ে গিয়ে এ্যালেনকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে দুই হাতে ওকে ঘুষি মারতে লাগলাম। আমি চাচ্ছিলাম ওকে কিছু সময়ের জন্য আটকাতে, যাতে সোফি কোথাও লুকিয়ে পড়তে পারে। এই হঠাৎ আক্রমণে এ্যালেন প্রথমে হকচকিয়ে গেলেও সামলে নিয়ে আমাকে এমন মারতে লাগলো, যে আমি সোফির কথা একেবারে ভুলেই গেলাম। এ্যালেন বয়সেও আমার বড় গায়েগতরেও বড়, ধস্তাধস্তি করতে করতে আমাকে মাটিতে ফেলে ও আমার উপরে চেপে বসে মারতে লাগলো, মনে হচ্ছিল মরেই যাব...
হঠাৎ একটা কাতরোক্তি শুনলাম, আর দেখি এ্যালেন পড়ে গেল। আমি মাটি থেকে কষ্ট করে উঠে বসে দেখি সোফি দাঁড়িয়ে আছে; হাতে একটা বড় পাথর, আর অজ্ঞান এ্যালেনের মাথা থেকে রক্ত গড়াচ্ছে।
- আমি মেরেছি,
একগাল হেসে সোফি বলল, বলেই এ্যালেনের অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে হাত থেকে পাথরটা ফেলে দিল।
বুঝতে পারছিলাম, এ্যালেনের কিছু শুশ্রূষা করা উচিত, কিন্তু কি করব বুঝতে পারছিলাম না। হঠাৎ মনে পড়ল সোফির মায়ের কথা, "কেউ যেন না জানে... কখনোই না"...কিন্তু এ্যালেন যে জেনে গেল!! প্রচন্ড ভয় পেয়ে আমি সোফির হাত টান দিয়ে ধরে দৌড়াতে লাগলাম।
সোফির বাবা জন ওয়েন্ডার খুব শান্ত ভাবে আমাদের কথা শুনলেন। সব শুনে বললেন,
- এমনও তো হতে পারে, অচেনা বলে সোফির প্রতি ওর কৌতুহল হয়েছে; হয়তো পায়ের ছাপ দেখেই নি...
- না, আমি বললাম। "পায়ের ছাপ দেখেছে বলেই ও সোফিকে ধরতে চাইছিল।"
- ওহ! আচ্ছা...,
উনি এত শান্তভাবে বললেন যে আমি অবাক হয়ে গেলাম। উনি আমার আর সোফির দিকে তাকালেন; উত্তেজনায় সোফির চোখদুটো বড়ো দেখাচ্ছিল, আমার এলোমেলো চেহারা, গাল- কপালের চামড়া ছড়ে রক্ত বেরোচ্ছে । এবার উনি সোফির মায়ের দিকে তাকালেন,
- তাহলে... এবার... সময় এসেই গেল!!
ম্লান হেসে বললেন উনি।
সোফির মাকে বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিল, উনি কিছু বলতে যেতেই সোফির বাবা বললেন,
- স্যরি মার্টি, বুঝতেই পারছ, আর কোন পথ নেই... আমি জানতাম এইদিন আসবেই... তবু ভালো যে এই সময়ে আমি বাসায় ছিলাম...
উনি সোফির মাকে জড়িয়ে ধরে স্বান্তনা দিলেন।তারপর বললেন,
-আচ্ছা, গোছগাছ করতে তোমার কতক্ষন লাগবে?
- বেশিক্ষণ লাগবে না... আমি তো সবসময়ই তৈরি থাকি।
দুজনেই সোফির দিকে তাকালেন; হঠাৎ সোফির মা বিষন্নতা কাটিয়ে আবার আগের মত হাসিখুশি হয়ে আমাদেরকে বললেন,
- এই যে নোংরা পাখিরা, তাড়াতাড়ি মুখ হাত ধুয়ে খেয়ে নাও। খাবার সবটুকু শেষ করবে কিন্তু...
সোফির মা চটপট দুই প্লেট খাবার দিলেন টেবিলে।
বহুদিন থেকে জিজ্ঞেস করব ভেবেও যা জিজ্ঞেস করতে পারিনি আজ মুখহাত ধুতে ধুতে আমি সেই প্রশ্ন করলাম,
- মিসেস ওয়েন্ডার, সোফি যখন ছোট ছিল তখন এই আঙ্গুলটা কেন কেটে ফেলেন নি?
- কাটার দাগ থেকে যেত ডেভিড... সেটা দেখলেই লোকে বুঝে যেত... যাও,এখন খাওয়াটা শেষ কর...শিগগির।
উনি দ্রুত গোছগাছ করতে লাগলেন।
খাবার চিবাতে চিবাতে সোফি বলল,
- আমরা চলে যাচ্ছি।
- চলে যাচ্ছ! বলে আমি বোকার মত তাকিয়ে রইলাম। সোফি মাথা নাড়ল,
- মা বলেছেন কেউ আমাকে দেখে ফেললেই আমাদের চলে যেতে হবে।
- চলে যাবে..., মানে, আর ফিরবে না?
- তাই মনে হয়।
হঠাৎ আমার ক্ষুধা একেবারে চলে গেল; মনে হল গলায় কিছু আটকে গেছে।
- কোথায় যাবে?
- জানিনা, মনে হয় অনেক দূরে...
সোফি খাবার ফাঁকে ফাঁকে কথা বলছিল, কিন্তু আমার গলায় যেন খাবার আটকে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল আমার চারপাশে কোথাও কেউ নেই... এই গভীর শুন্যতার উপলব্ধিতে আমার চোখ ভিজে উঠছিল...
সোফির মা ক্রমাগত ঘর থেকে পোঁটলা- পুটলী এনে দরজার কাছে রাখছিলেন আর সোফির বাবা সেগুলো বাইরে নিয়ে যাচ্ছিলেন। সোফিকে তৈরি করার জন্য ওকে ওর মা অন্য ঘরে নিয়ে গেলেন। আমি বাইরে এলাম, যেখানে সোফির বাবা সমস্ত মালপত্র স্পট আর স্যান্ডি ঘোড়ার পিঠে বোঝাই করছিলেন। কিছুক্ষণ উনার কাজ দেখার পর সাহস সঞ্চয় করে জিজ্ঞেস করলাম,
- মিস্টার ওয়েন্ডার, আমাকে আপনাদের সাথে নিয়ে যাবেন, প্লিই-জ!
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ দুপুর ১:৫৩