আগের পর্ব: নতুন জীবন- ছয়
ইন্সপেক্টরের কপালে ভাঁজ পড়ল,
- না জানিয়ে খুব খারাপ করেছ। একে বলে বিকৃতি- গোপনে সহায়তা করা। এটা একটা অপরাধ; তুমি জানো না?
আমি মাথা নিচু করে বললাম,
- আমার মনে হয়েছিল নীতি কথায় এ নিয়ে বলা হয় নি। তাছাড়া আঙ্গুলটা খুবই ছোট...
ইন্সপেক্টর আরেকটা মিঠাই নিয়ে বাকিটা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন,
- "আর প্রতি পায়ে থাকবে পাঁচটি করে আঙ্গুল," উনি বললেন, "তোমার মনে আছে তো বর্ণনাটা?"
- মনে আছে, বললাম আমি।
- তাহলে বুঝতেই পারছ, এই বর্ণনার প্রত্যেকটা শব্দ গুরুত্বপূর্ণ। যদি কোন শিশুও এই বর্ণনার সাথে না মেলে তবে বুঝবে তার কোন আত্মা নেই, সে ঈশ্বরের আদলে সৃষ্টি হয়নি। ঈশ্বর কখনো বিকৃত সৃষ্টি করেন না। তাই কারো মাঝে যদি বিকৃতি থাকে, তবে তা যত ছোটই হোক না কেন, যতই তাকে মানুষের মত দেখাক না কেন, সে আসলে ঈশ্বরের সৃষ্টি সত্যিকারের মানুষ নয়।
- কিন্তু সোফি তা নয়, ও একেবারে আমাদের মতো, আমি একটু চিন্তা করে বললাম।
- আরেকটু বয়স হলেই তুমি এটা বুঝতে পারবে। কিন্তু তুমি মানুষের বর্ণনা ভালোভাবে জান, সোফি বিকৃত এটা জেনেও তুমি তোমার বাবা বা আমাকে জানাও নি কেন?
আমি ইন্সপেক্টরকে বললাম বাবা যেভাবে বিকৃত পশু জবাই করে ধ্বংস করতেন, আমি ভয় পেয়েছিলাম সোফির সাথেও তাই করবেন। শুনে উনি আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কিছু ভাবলেন। তারপর বললেন,
- আমার কর্তব্য তোমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা। কিন্তু তোমার বাবা তোমাকে যথেষ্ট শাস্তি দিয়েছেন, তাই আমি আর কিছু করব না। কিন্তু তোমার মনে রাখতে হবে, শয়তান আমাদের বিশুদ্ধতা নষ্ট করার জন্য মাঝে মাঝেই একেবারে মানুষের মত করে কিছু সৃষ্টি করে, কিন্তু সেই সৃষ্টিতে ছোট খাটো কিছু ত্রুটি থেকে যায়। তাই এরপরে কখনো যদি এমন ত্রুটিযুক্ত কোন সৃষ্টি দেখ, অবশ্যই সেটা জানাব। মনে থাকবে, ডেভিড?
আমি জানি ইন্সপেক্টরের মত একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ কোন ভুল কথা বলবেন না, কিন্তু সোফি শয়তানের সৃষ্টি, এটা আমি মানতে পারছিলাম না।
- সোফি আমার বন্ধু, সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু।
ইন্সপেক্টর চুপ করে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন, তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
- বিশ্বস্ততা অনেক বড় গুণ, কিন্তু পাপীর প্রতি বিশ্বস্ততা ভাল গুণ নয়। একদিন তুমি বুঝতে পারবে যে, সমস্ত বিশ্বস্ততা দিয়ে আমাদের উচিত মানবজাতির বিশুদ্ধতা রক্ষা--,
দরজা খোলার শব্দে উনার কথা থেমে গেল। বাবা ঘরে ঢুকলেন,
- ধরা পড়েছে, তিনোটাকেই ধরেছে..., ইন্সপেক্টরকে কথাটা বলে বাবা আমার দিকে কড়া নজরে চাইলেন।
ইন্সপেক্টর সাথে সাথে উঠে পড়লেন, তারপর বাবার সাথে বেড়িয়ে গেলেন। বাবার এই এক কথায় আমার মনে হল বুকটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। পরাজয়ের বেদনা আর আত্মগ্লানিতে আমি ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলাম, কান্নার দমকে পিঠে ব্যথা করে উঠছিল কিন্তু চেষ্টা করেও কান্না থামাতে পারছিলাম না। এবার ঘরের দরজা আবার খুলল, আমি মুখ ফেরালাম না। কারো পায়ের শব্দ আমার দিকে এগিয়ে এল, কেউ একজন আলতোভাবে আমার পিঠে হাত রাখলেন। শুনতে পেলাম ইন্সপেক্টর বলছেন,
- তুমি যা ভাবছ তা ঠিক না, এখানে তোমার কোন দোষ নেই। ওরা ধরা পড়েছে বিশ মাইল দূরে, একটা নিয়মিত টহলদলের হাতে।
আট
ক'দিন পর একদিন আমি এক্সেল খালুকে বললাম,
- খালু, আমি এখান থেকে পালিয়ে যাচ্ছি।
খালু কাজ থামিয়ে হাতের কাঁচির দিকে চেয়ে রইলেন, তারপর বললেন,
- এটা তেমন কাজের কিছু হবে না। তাছাড়া..., একটু ভেবে বললেন,
- যাবেই বা কোথায়?
- সেটাই তো আপনার কাছে জানতে চাচ্ছি, আমি বললাম। এক্সেল খালু একটু ভাবলেন,
- যেখানেই যাও না কেন, তোমার স্বাভাবিকতা- প্রত্যায়নপত্র দেখাতে হবে। তখনই তো জানা যাবে তুমি কোথা থেকে গেছো...
- প্রান্তভূমিতে গেলে তো এই ঝামেলা হবে না।
উনি আমার দিকে চেয়ে রইলেন,
- তুমি কি পাগল হয়েছ!! সেখানে কোনো কিছু নেই, সেজন্যই তো তারা আক্রমণ করে আমাদের এলাকায়। সেখানে গেলে না খেয়ে মরতে হবে।
- তাহলে অন্য কোথাও যাবো। কোথাও না কোথাও তো যাওয়াই যাবে!
- হ্যাঁ, ধর যদি জাহাজে যেতে পার, তাহলে যাওয়া যাবে, কিন্তু তবুও...
কথা থামিয়ে আনমনে মাথা নাড়লেন খালু। তারপর আবার বলতে লাগলেন,
- পালিয়ে যাওয়া কোন সমাধান নয়। তাছাড়া যাবে কোথায়? আমার এই কথাটা শুনে রাখ, এই এলাকা আশপাশের অন্য এলাকার চাইতে অনেক ভালো। না, আমি মোটেও তোমাকে আটকাতে চাইছি না, শুধু এটাই বলতে চাচ্ছি যে, কয়েক বছরের মধ্যে যখন তুমি তারুণ্যে পৌঁছাবে তখনই তুমি ঠিক ভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। ততদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করাই ভালো, কারণ এখন তুমি পালিয়ে বেশি দূর যাবার আগেই তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে।
খালুর কথা শুনে ভাবতে লাগলাম; অপমান কাকে বলে তা মাত্র ক'দিন আগে জেনেছি, নতুন করে আর জানতে চাই না... কিন্তু কোথায় যাব সেটা তো ভাবতে হবে। আগে জানতে হবে ল্যাব্রাডর ছাড়ালে পরে বাকি পৃথিবী কেমন! খালুকে জিজ্ঞেস করায় বললেন,
- ঈশ্বরের উপস্থিতি বিহীন পৃথিবী। কোথাও ঈশ্বরের কোন চিহ্ন নেই সেখানে।
- আপনি কিন্তু এখন বাবার মত কথা বলছেন খালু। আপনার এই কথা আমি বুঝতে পারছি না!!
- ঠিক আছে, বুঝিয়ে বলছি। কিন্তু তোমাকে কথা দিত হবে যে এসব কাউকে বলবে না।
- মানে এটা গোপন কথা?
- ঠিক তা না। আসলে যখন মানুষের মনে কোন বিশ্বাস বদ্ধমূল করে দেয়া হয়, তখন তার বিপরীতে কোনো কথা বললেই ধর্ম- প্রচারকরা প্রচন্ড রেগে যায়। তাই সমুদ্র- যাত্রায় নাবিকেরা যা দেখেছে তা সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচার করে না। তাতে অনেক ঝামেলা এড়ানো যায়।
- আমাদের বইতে বলা হয়েছে ল্যাব্রাডর ছাড়া বাকি পৃথিবী কেবলই পোড়াভূমি।
- এর বিপরীত কথা বলা বইও আছে, যদিও সেই বইগুলো খুব গোপনীয়। সেসব বইতে নাবিকের দেখা স্থানের যে বর্ণনা আছে তার সবকিছু তোমার বইয়ে পড়া বর্ণনার সাথে মিলবে না। আবার সবাই যে একই জিনিস দেখেছে এমনটাও নয়। আসলে তুমি যদি নিজে ভ্রমণে যাও, তাহলে এমন সব অদ্ভুত জিনিস দেখবে, যাতে পৃথিবী সম্পর্কে তোমার ধারণাই বদলে যাবে, অথচ ওয়াকনুকের কেউ এসব করে বিশ্বাসই করবেনা। পারবে তো, সব শোনার পর গোপনে রাখতে?
- পারবো, আমি জানলাম।
- ঠিক আছে, তাহলে শোন, এক্সেল খালু বলে চললেন,
- পৃথিবীর অন্য প্রান্তে পৌঁছানো যায় অনেক ভাবে। ধর তুমি রিগো নদী ধরে যেতে যেতে সমুদ্রে পৌঁছালে, তারপরও সোজা মানে পূর্বদিকে গিয়ে সমুদ্র যাত্রা করতে পার, কিন্তু তাতে কোন লাভ নেই। কারণ মনে করা হয় পূর্বদিকে সমুদ্র অসীম পর্যন্ত বিস্তৃত। যদি তুমি উত্তরদিকে যেতে থাক তীর বরাবর, তারপর একসময় যেতে যেতে প্রথমে পশ্চিম আর তারপর দক্ষিণে যাও, তাহলে ল্যাব্রাডরের অন্যপ্রান্তে পৌঁছে যাবে। অথবা সোজা উত্তরে গেলে কিছু দ্বীপ দেখা যাবে, সেখানে ঠান্ডা অনেক বেশি আর তেমন কোন প্রাণী চোখে পড়ে না। শুনেছি উত্তর- পূর্ব দিকে একটা বড় দ্বীপ আছে যেখানে মানুষ, প্রাণী, গাছপালা চেহারায় স্বাভাবিক, কোন বিচ্যুতি দেখা যায় না। কিন্তু সেখানকার মহিলারা খুব লম্বা আর শক্তিশালী, তারা সেখানকার সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে। পুরুষদের তারা খাঁচায় বন্দী করে রাখে, আর চব্বিশ বছর বয়স হলেই খেয়ে নেয়। এছাড়া ডুবন্ত জাহাজের নাবিকদেরও তারা খায়। এই দ্বীপ থেকে কেউ জীবন্ত ফিরে আসে নি, তাই কোন প্রত্যক্ষদর্শীও নেই, তবু অনেক মানুষ মনে করে এমন দ্বীপ আছে...
আমি তিনবার অভিযানে গেছি, শুধু দক্ষিণ দিকে। কয়েকশ' মাইল দক্ষিণে যাবার পর প্রথমে নিউফ প্রণালী, সেটা পার হয়ে কিছুদূর দক্ষিণ- পূর্ব, তারপর আবার দক্ষিণে গেলে তটভূমি দেখা যায়। কাছে গেলে দেখা যায় শুধু পোড়াভূমি, কোথাও কোথাও কিছু প্রান্তভূমি দেখা যায় কিন্তু সেখানকার উদ্ভিদ, প্রাণী সবকিছুই চরমভাবে বিকৃত। এরপর কয়েকদিন ধরে যাত্রা করলেও তটভূমি একই রকম থাকে। প্রথম প্রথম নাবিকেরা এই দৃশ্য দেখে খুব ভয় পায়, তাদের মনে হয় তারা ঈশ্বরের সৃষ্ট পবিত্রতা আর বিশুদ্ধতা থেকে ক্রমশই দূরে সরে যাচ্ছে, আরো আগালে তাদের ঈশ্বর আর সাহায্য করবেন না, তখন তারা ফেরত আসে। কিন্তু একটা প্রশ্ন তাদের মনকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেতে থাকে- এই সব গাছপালা যদি ঈশ্বরের নিয়ম মেনে না জন্মে থাকে, তবে এদের এত বাড়বাড়ন্ত হচ্ছে কেন? যেন স্বয়ং ঈশ্বর তাদের সৃষ্টি করে বাঁচিয়ে রাখছেন!! আর তাদের সে কি বাড়বাড়ন্ত!! একটা দৈত্যাকার ভুট্টা গাছে ফলে থাকে বিশাল বিশাল ভুট্টা, ছত্রাক দেখে মনে হয় যেন বিশালাকৃতির পাথর ছড়িয়ে রাখা! তটভূমির পাশে খাড়া পাহাড়ের উপরে দৈত্যাকার গাছ, তার মোটা মোটা শিকড় সমুদ্রে নেমে গেছে; দেখে ধন্দ লেগে যায়, এটা কি স্থলভূমির গাছ সমুদ্রে গেছে নাকি সমুদ্রের গাছ স্থলে উঠে এসেছে!! চারপাশে কেবলই অস্বাভাবিক সৃষ্টি, মাইলের পর মাইল শুধু বিকৃতির রাজত্ব। যে সব প্রাণী দেখা যায় সেগুলোকেও পরিচিত কোন প্রাণীর শ্রেণীতে ফেলা যায় না। পুরো এলাকা যেন অশুভের ছায়ায় ঢাকা। এই সব দেখলে মনে হয় বিশুদ্ধতা আইন আর ইন্সপেক্টর না থাকলে আমাদের অবস্থাও ভয়াবহ হয়ে উঠত।
এখানেই শেষ নয়, আরো দক্ষিণে গেলে অশুভের বিস্তার আরো বেড়ে যায়। দক্ষিণে যেতে যেতে একসময় যেখানে পৌঁছান যায়, সেখানে প্রাণের চিহ্ন মাত্র দেখা যায় না। যতদূর দেখা যায় কেবল পোড়াভূমি- যেন পোড়া কয়লার এক বিশাল টুকরা! সেখানকার সমুদ্রে কোন মাছ নেই, জলজ- উদ্ভিদ নেই, শামুক গুগলী নেই, কালো সৈকতে ঢেউয়ের ভেঙে পড়া ছাড়া কোন শব্দও নেই।
সে এক ভয়াবহ পরিবেশ। এ পর্যন্ত পৌঁছেই জাহাজীরা সাহস হারিয়ে ফেলেন, তাঁরা জাহাজ ঘুরিয়ে নিয়ে ফিরে আসেন। শুধু এক জাহাজের কাপ্তান হঠকারী সিদ্ধান্ত নেয় স্থলভাগের কাছে যাবার, তারপর সত্যি সত্যিই এতটা কাছে যায় যেখানে থেকে স্থলের অনেক কিছু দেখা যাচ্ছিল। তারা পাথরের মত কিছু দেখে যেগুলো দেখে প্রাকৃতিক বলে মনে হয়নি; মনে হচ্ছিল এটা প্রাচীন মানুষের শহরের ধ্বংসাবশেষ...রিগোতে ফেরার পর এই জাহাজের নাবিকেরা একে একে শুকিয়ে মারা যায়। এটা দেখে তারপর থেকে আর কোন জাহাজ কালো সৈকতের কাছে যায়নি...
এই একটা জাহাজ বাদে অন্য জাহাজের নাবিকেরা ফিরে আসেন, কারণ কয়েকশ' মাইল জুড়ে একটানা পোড়াভূমি দেখতে দেখতে তাদের মনে হয় যে পৃথিবীর শেষ সীমা পর্যন্ত এরকমই হবে। সুতরাং আরো আগালে খাবার বা পানীয় জলের অভাবে তাদের মরতে হবে। রিগোতে ফিরে এসে তারা তাদের পর্যবেক্ষণের কথা জানায়। ধর্মগুরুরা এসব শুনে খুব খুশি হন, কারণ নাবিকদের পর্যবেক্ষণ ধর্মগুরুদের প্রচারিত বাণী সমর্থন করে।
কিন্তু এরপরও কিছু লোকের অনুসন্ধিৎসা থেমে থাকে না...
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ রাত ১১:১৩