আগের পর্ব: নতুন জীবন- পাঁচ
উনি আমার দিকে তাকালেন, দেখলেন আমার জলেভরা চোখ! হাতের কাজ থামিয়ে আমার পিঠে হাত রেখে ঘরে নিয়ে গেলেন। সোফির মা তখন শেষ বারের মত ঘরে চোখ বুলাচ্ছিলেন।
- মার্টি, ও আমাদের সাথে যেতে চাচ্ছে।
সোফির মা প্রথমে একটা টুলে বসলেন, তারপর দুহাত বাড়িয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। এত কাছে থাকায় আমি উনার চিন্তা স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম... উনি দ্রুত চিন্তা করছিলেন, আমি সাথে গেলে উনার কত ভালো লাগতো... এইসময় সোফির বাবা কথা বলায় উনার চিন্তা থেমে গেল,
- মার্টি, ওকে সাথে নেবার বিপদ আছে। যদি আমরা ধরা পড়ে যাই, তবে সোফিকে লুকানো আর ডেভিডকে কিডন্যাপ করা- এই দুটো অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে আমাদের শাস্তি পেতে হবে।
- ধরতে পারলে ওঁরা সোফিকে আমাদের থেকে নিয়ে নেবে। এর চাইতে বড় শাস্তি আর কী দেবে?
- সোফিকে নিয়ে আমরা এলাকা ছেড়ে গেলে হয়ত তারা আমাদের পিছু নেবে না। কিন্তু যদি স্ট্রর্মের ছেলেকে সাথে নিয়ে যাই, তবে চারপাশে খোঁজাখুঁজি শুরু হবে, আর আমাদের ধরা পড়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যাবে। এভাবে সোফির বিপদ বাড়ানো কি ঠিক হবে, বলো?
আমি শুনতে পাচ্ছিলাম সোফির মা ওর বাবার যুক্তি বুঝতে পারছেন, কিন্তু কী করে কথাটা আমাকে বোঝাবেন তা বুঝতে পারছেন না। উনি দুহাতে শক্ত করে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন, তারপর বলতে লাগলেন,
- ডেভিড, আমি চাই তুমি আমাদের সাথে আসো, কিন্তু এতে যে সোফি বিপদে পড়ে যাবে। তোমার বাবা যখন শুনবেন যে তুমি আমাদের সাথে চলে গেছ, তখন উনি খুব রেগে যাবেন আর এমন খোঁজাখুঁজি করবেন যে আমরা ধরা পড়ে যাব। তুমি তো সোফির একমাত্র বন্ধু ডেভিড; তুমি কি ওকে বিপদের হাত থেকে বাঁচাবে না ডেভিড? জানি তোমার খুব মন খারাপ হচ্ছে, কিন্তু একটু বোঝার চেষ্টা কর লক্ষী সোনা।
উনার মুখের কথার চাইতে উনার চিন্তা আমি বেশি স্পষ্ট ভাবে শুনতে পাচ্ছিলাম। উনার কথা মেনেও নিয়েছিলাম। চোখের পানি আটকে রেখে কোনমতে মাথা নেড়ে উনাকে সম্মতি জানালাম। উনি আমাকে জড়িয়ে ধরেই থাকলেন, আমার মাও কখনও আমাকে এভাবে আদর করে জড়িয়ে ধরেন নি...
সন্ধ্যার আগেই সব গোছগাছ শেষ হল, এবার যাবার পালা। মিস্টার ওয়েন্ডার বন্ধুর মত আমার হাত ধরলেন, তারপর বললেন,
- ডেভী, তুমি সোফিকে বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্য অনেক কষ্ট করেছ। তুমি সোফির সত্যকার বন্ধু... তুমি যদি এখন আরেকটু সাহায্য কর, তবে খুব ভালো হয়!
- নিশ্চয়ই করব মিস্টার ওয়েন্ডার, কী করতে হবে?
- কাজটা হচ্ছে, আমরা চলে যাবার পর বাড়ি না গিয়ে তুমি যদি আজ রাতটা এবাড়িতেই থেকে যাও, তবে আমরা সোফিকে নিয়ে নিরাপদ জায়গায় চলে যাবার জন্য বেশি সময় পাব। থাকতে পারবে না?
- পারব, আমি জোর দিয়ে বললাম।
উনি আমার সাথে হাত মেলালেন, অনুভব করলাম উনি যেন আমার ভেতরে দায়িত্বশীলতা ও শক্তি সঞ্চারিত করে দিলেন... সোফি ওর হাতের মুঠোয় করে কিছু একটা এনে আমার হাতে দিল, দেখি হলুদ ফিতায় জড়ানো একগুচ্ছ বাদামী চুল, তারপর আমাকে জড়িয়ে ধরে বিদায় জানালো। এবার ওর বাবা ওকে তুলে ঘোড়ায় বসিয়ে দিলেন। মিসেস ওয়েন্ডার ঝুঁকে আমাকে চুমু খেয়ে আমার ছাল- ওঠা গালে আদর করে আঙ্গুল বুলিয়ে দিলেন। জল টলমল চোখে বললেন,
- তোমার কথা কখনও ভুলব না ডেভিড।
ঘোড়ার পিঠে তারা রওয়ানা হলেন। গাছপালার নিচে যেখানে সন্ধ্যার অন্ধকার ঘণ হয়ে এসেছে, সেখানে পৌঁছে তারা ঘোড়া থামিয়ে আমার দিকে ঘুরে হাত নাড়লেন, আমিও হাত নাড়লাম। তারপর তারা গাছপালার নিচের অন্ধকারে হারিয়ে গেলেন।
ছয়
আমি বাড়ি পৌঁছালাম বেশ বেলা করে; ততক্ষণে কাজের লোকজন সব ক্ষেতে চলে গেছে। উঠান খালি, কিন্তু একপাশে ইন্সপেক্টরের ঘোড়া বাঁধা দেখে বুঝলাম বাবা বাড়িতেই আছেন।
গতরাত খুব ভালো কাটেনি। এই প্রথম আমি আমার বাড়ির নিজের ঘরের পরিচিত পরিবেশ ছেড়ে সম্পূর্ণ একা, এক অপরিচিত পরিবেশে রাত কাটিয়েছি!! যখন মিস্টার ওয়েন্ডারকে কথা দিয়েছিলাম রাতে তাদের বাড়িতে থাকব বলে, তখন মনে সাহসের সাথে ছিল দায়িত্ববোধ। কিন্তু সোফিদের খালি বাড়ি অন্ধকার হয়ে আসতেই কেমন ভূতুড়ে হয়ে উঠল, চারপাশ থেকে বিচিত্র সব শব্দ ভেসে আসতে লাগলো, আর আমার খুব ভয় লাগতে লাগলো; আমি খুঁজে পেতে কয়েকটা মোম বের করে জ্বালিয়ে দিলাম, তারপর দেয়ালে ঠেস দিয়ে একটা টুলে এমনভাবে বসলাম যেন কেউ ঘরে ঢুকলেই দেখতে পাই। মাঝে দুবার আমার প্রচন্ড ইচ্ছা হল ঘর থেকে বেরিয়ে দৌড়ে বাসায় চলে যাই, কিন্তু আমার প্রতিজ্ঞার কথা আর সোফির নিরাপত্তার কথা ভেবে সে ইচ্ছা দমন করেছি। অবশ্য বাইরের ঘন অন্ধকারে বের হবার সাহস ও ছিল না।
কখনো মনে হচ্ছিল কেউ দরজায় টোকা দিচ্ছে, কখনো মনে হচ্ছিল বাড়ির চারপাশে কেউ পা টিপে হাঁটছে, কখনো কিছু টেনে নিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু জানিনা কেন কেউ আমাকে আক্রমন করল না। টের পেলাম আমার চোখ বুজে আসছে, মাঝে মাঝে টুল থেকে ঢুলে পড়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু ভয় হচ্ছিল নড়াচড়া করলেই কেউ এসে আমাকে ধরবে! শেষ পর্যন্ত অনেক সাহস করে গিয়ে বিছানায় উঠে দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসলাম। বসে দেখতে লাগলাম মোমবাতির আলোয় ঘরের জিনিসগুলোর ছায়া কেমন ভয়ংকর দেখাচ্ছে... দেখতে দেখতে ভাবছিলাম, এই মোমবাতিগুলো নিভে গেলে কী হবে!! হঠাৎ দেখি মোমবাতি নিভে গেছে, আর ঘরের ভেতর ঝলমল করছে সূর্যের আলো...
সোফিদের বাসায় কিছু খাবার পেয়ে সেগুলো খেয়েছিলাম, কিন্তু বাসায় পৌঁছানোমাত্র ক্ষিদে পেয়ে গেল। ক্ষিদেকে পাত্তা দিলাম না, তখন আমার একমাত্র চিন্তা চুপে চুপে নিজের ঘরে ঢুকে যাওয়া যাতে সবাই মনে করে আমি এতবেলা পর্যন্ত ঘুমাচ্ছিলাম। কিন্তু কপাল খারাপ, রান্নাঘরের জানালা দিয়ে মেরি আমাকে দেখে ফেলল।
-এই যে ডেভিড, কোথায় ছিলে সারারাত? সবাই তোমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। বাবা তো ক্ষেপে ব্যোম হয়ে গেছেন। ভালো চাও তো এক্ষুনি দেখা করে আস।
বাবা আর ইন্সপেক্টর বাইরের ঘরে বসে ছিলেন। আমাকে দরজায় দেখামাত্র বাবা ফেটে পড়লেন,
- এদিকে এসো। সারারাত কোথায় ছিলে?
আমি অনিচ্ছা সত্ত্বেও ঘরে ঢুকলাম, কিন্তু প্রশ্নের জবাব দিলাম না। বাবা পরপর প্রশ্ন করতে লাগলেন, আমি একটারও জবাব দিলাম না।
- চুপ করে থেকে পার পাবে না। ঐ বাচ্চাটা...পাপাত্মাটা কে? যার সাথে গতকাল তোমাকে দেখা গেছে?
আমি এবারও জবাব দিলাম না। বাবা এমন ক্রুদ্ধ চোখে আমার দিকে তাকালেন যে আমার পেটে মোচড় দিয়ে উঠলো। এবার ইন্সপেক্টর কথা বললেন,
- তুমি তো জানো ডেভিড, বিকৃতি সম্পন্ন মানুষ দেখে তা কর্তৃপক্ষকে না জানানো একটা বড়সড় অপরাধ, এরজন্য শাস্তি পেতে হয়। তুমি নিজে হয়তো বুঝতে পারনি, কিন্তু তোমার উচিত ছিল আমাকে জানানো যাতে আমি সিদ্ধান্ত নিতে পারি। যদি এ্যালেন মিথ্যা না বলে থাকে, তাহলে তোমাকে গতকাল এক পাপাত্মার সাথে দেখা গেছে। এ্যালেন বলছে সেই পাপাত্মার পায়ে ছয় আঙ্গুল; কথাটা কি সত্যি?
- না, আমি বললাম।
- ও মিথ্যা বলছে, বাবা বলে উঠলেন।
- কথাটা যদি সত্যি নাই হয়, তাহলে তো মেয়েটার কথা সবকিছু তুমি আমাদের বলতেই পারো,তাই না?
আমি ইন্সপেক্টরের দিকে চুপচাপ তাকিয়ে থাকলাম। উনি আবার বললেন,
- কথাটা যদি সত্যি নাই হয় তাহলে...
বাবা ইন্সপেক্টরকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,
- ও মিথ্যা বলছে। আমি ব্যবস্থা করছি।
আমাকে বললেন,
- তোমার ঘরে যাও, এক্ষুনি।
টেবিল থেকে চাবুক তুলে নিয়ে বাবা আমার পিছন পিছন আসতে লাগলেন।
সাত
আমি জানি না আমার মা কেন আমার কাছে আসলেন না। কিন্তু মেরি এল। ও আমার পিঠের ক্ষত ধুয়ে মুছে ওষুধ লাগিয়ে দিয়ে জাউ খাইয়ে দিল। তারপর সাবধানে আমাকে শুইয়ে দিল। আমার ক্ষত দেখে ও সমানে চোখ মুছছিল, কিন্তু আমি অনেক কষ্টে কান্না আটকে রেখেছিলাম। ও বের হয়ে যেতেই আমি হলুদ ফিতায় জড়ানো চুলের গোছা হাতে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লাম। বাবার মারের ব্যথা নয়, আমি চৌচির হয়ে ভেঙে পড়ছিলাম তীব্র দুঃখ, অপমান, আত্মগ্লানি আর অসহায়ত্বে... কাঁদতে কাঁদতে বললাম,
- সোফি আমি তোমাকে বাঁচাতে পারলাম না... পারলাম না সোফি...
সন্ধ্যাবেলায় যখন মনের অস্থিরতা কিছু কমেছে, তখন দেখি রোজালিন আমার সাথে কথা বলতে চাচ্ছে। আরো কয়েকজনও উদ্বিগ্ন ভাবে জানতে চাইল কী ঘটেছিল। এখন তো সব জানাজানি হয়েই গেছে, তাই সোফির কথা ওদের বললাম। আমি ওদের বোঝাতে চাইলাম যে, একজন মানুষের দেহে ছোট একটা বিকৃতি থাকলেও তাকে ভয়ংকর, অস্বাভাবিক কোন কিছু ভাবা ঠিক না। সোফি কোনমতেই পাপাত্মা হতে পারে না। আমার কথা ওরা শুনল, কিন্তু পুরোপুরি মেনে নিতে পারছিল না। এতকাল ওরা যা জেনে এসেছে আমার কথা একেবারে তার বিপরীত... অবশ্য ওরা এটা বুঝতে পারছিল, আমি যা সত্যি বলে মানি সেটাই ওদের জানাচ্ছি। মিথ্যা কথা বানানো যায়, কিন্তু মিথ্যা ভাবনা বানানো যায় না। তারা আমার মত করে ভাবতে চাইল যে বিকৃতি মানেই ঘৃণিত বা পাপ নয়, কিন্তু মেনে নিতে পারছিল না। একে একে তারা চুপচাপ হয়ে গেল, বুঝতে পারলাম তারা ঘুমিয়ে পড়েছে।
আমার প্রচন্ড ক্লান্ত লাগছিল, কিন্তু ঘুম আসছিল না। আমি ভাবছিলাম সোফিরা কি এখনো দক্ষিণ দিকে যাচ্ছে, নাকি প্রান্তভূমিতে পৌঁছে গেছে, নাকি আমার বিশ্বাসঘাতকতায় সোফির কোন ক্ষতি হল... ভাবতে ভাবতেই একসময় ঘুমিয়ে গেলাম।
সকালে মা আমাকে দেখতে এলেও তেমন কথাবার্তা বললেন না। মেরি আমার দেখাশোনা করছিল। বলল, যদি তাড়াতাড়ি ক্ষত শুকাতে চাই তবে সারাদিন যেন উপুড় হয়ে শুয়ে থাকি, নড়াচড়া কম করি। আমি তাই করলাম... আর শুয়ে শুয়ে প্ল্যান করতে লাগলাম কিভাবে সুস্থ হয়েই এবাড়ি থেকে পালিয়ে প্রান্তভূমিতে চলে যাওয়া যায়, কোন ঘোড়াটা নেয়া যায়...
বিকেলে ইন্সপেক্টর আমাকে দেখতে এলেন, হাতে করে আনলেন আমার প্রিয় মিঠাই। মনে হচ্ছিল উনি আমাকে দেখতে এসেছেন, কিন্তু আসলে উনি কিছু খবর সংগ্রহ করতে এসেছিলেন। আমার ইচ্ছা করছিল প্রান্তভূমি সম্পর্কে তাঁর থেকে কিছু খবর সংগ্রহ করি, কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করলাম না। একটা মিঠাই ভেঙে খেতে খেতে উনি জিজ্ঞেস করলেন,
- তুমি কতদিন ধরে ওয়েন্ডারদের চেন? আচ্ছা, মেয়েটার নাম কী?
নাম বলা না বলায় এখন আর কিছু আসে যায় না, আমি নাম বললাম।
- তুমি কতদিন ধরে সোফির বিকৃতি সম্পর্কে জানতে?
- বেশ অনেক দিন ধরে।
- অনেক দিন মানে ঠিক কত দিন?
- হবে প্রায় ছয়মাস।
-
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ রাত ৯:৫৩