আগের পর্ব: নতুন জীবন- আট
অবশেষে আনুষ্ঠানিক ভাবে আমার বোন পেট্রার জন্মকে স্বীকৃতি দেয়া হল। আমাকে জানানো হল আমার একটা বোন হয়েছে। আমি বোন দেখতে গেলাম, দেখি মায়ের পাশে ছোট একটা পুতুলের মত বোনটা শুয়ে আছে। যখন আমরা একজন একজন করে পেট্রাকে দেখতে যাচ্ছিলাম তখন কেউ একজন আস্তাবলের বড় ঘণ্টা বাজিয়ে দিল, যাতে খামারে কর্মরত সকলেই শুনতে পায়। কাজ করা বন্ধ করে একটু পরেই সবাই প্রার্থনা করার জন্য রান্নাঘরে সমবেত হল।
দশ
পেট্রার জন্মের দুই বা তিনদিন পর হঠাৎই এমন কিছু জেনে যাই, যা জানার পর আমার শান্তিময় জীবন অশান্তিময় হয়ে ওঠে!!
সেদিন দুপুরের খাবারের পর আমি মা-বাবার ঘরের পাশের ঘরে বসে ছিলাম, যাতে খাওয়ার পর ক্ষেতের কাজে যাবার সময়টা সকলের নজর এড়িয়ে কাটানো যায়। এ ঘরে আমাকে খোঁজার জন্য কারো আসার সম্ভাবনা কম, তাছাড়া মাও বিছানায় শুয়ে থাকতেন বলে আমাকে দেখতে পেতেন না; ঘণ্টাখানেক এ ঘরে থেকে সবাই কাজে চলে যাবার পর আমি বের হতাম। অবশ্য মা যেন টের না পান সেজন্য পা টিপে টিপে সাবধানে ঘরে হাঁটতে হত। সেদিন সকলেই কাজে চলে যাবার পর যেই ঘর থেকে বের হতে যাব, তখনই একটা দু'চাকার এক্কাগাড়ির আওয়াজ পেলাম। নিঃশব্দে জানালার কাছে গিয়ে দেখি হ্যারিয়েট খালা গাড়ি চালিয়ে উঠানে ঢুকছেন।
হ্যারিয়েট খালা আমার মায়ের ছোট বোন, বয়সে তিন বছরের ছোট। উনি দেখতে অনেকটা আমার মায়ের মত হলেও আচরণে একেবারে আলাদা, খুব দয়ালু আর কোমল। উনি আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় পনের মাইল দূরে কেন্টাক এলাকায় থাকেন। বছরে হয়ত একবার উনার সাথে আমাদের দেখা হয়।
দেখলাম হ্যারিয়েট খালা ঘোড়াদুটো খুঁটির সাথে বাঁধলেন, তারপর গাড়ি থেকে একটা সাদা পুটুলী নিয়ে বাড়ির দিকে আসতে লাগলেন। একটু পরেই তার পায়ের আওয়াজে বুঝলাম উনি মায়ের ঘরে ঢুকলেন।
- একি হ্যারিয়েট!! তুমি হঠাৎ এই অবস্থায় এসেছ কেন? এতটা পথ নিশ্চয় ছোট বাচ্চাটাকে সাথে নিয়ে আসনি?
মা খুব বিরক্ত হয়েই খালাকে বললেন।
- জানি এমিলি... মায়ের বিরক্ত স্বরে কিছুটা বিব্রত হয়ে হ্যারিয়েট খালা বলতে লাগলেন,
- আমার যে না এসে কোন উপায় ছিল না এমিলি। তখন শুনলাম তোমারও মেয়ে হয়েছে... ওহ্, এই বুঝি বাবুটা! কী মিষ্টি হয়েছে দেখতে!
একটু চুপচাপ, তারপরই খালা বলতে লাগলেন,
- আমারও মেয়ে হয়েছে। ও-ও খুব মিষ্টি দেখতে। এই যে দেখ!
তারপর কিছুক্ষণ বাচ্চাদের নিয়ে দুই বোনের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা শোনা গেল।
- এমন মিষ্টি মেয়ে পেয়ে হেনরি নিশ্চয়ই খুব খুশি?
- হ্যা, খুশি তো অবশ্যই... কেমন অনিশ্চিত গলায় খালা বললেন। তারপর বলতে লাগলেন,
- ও জন্মেছে এক সপ্তাহ আগে... বুঝতে পারছিলাম না কী করব। তখনই শুনলাম তোমারও মেয়ে হয়েছে, ভাবলাম ঈশ্বর আমার প্রার্থনা শুনেছেন...
একটু থামলেন, তারপর যেন কথার কথা বলছেন এভাবে জিজ্ঞেস করলেন,
- ওর জন্য নিশ্চয়ই তোমরা সার্টিফিকেট পেয়ে গেছ?
- অবশ্যই পেয়েছি। মায়ের গলা হঠাৎ চড়ে গেল,
- কেন হ্যারিয়েট, তুমি কি সার্টিফিকেট পাওনি?
কোন উত্তর নেই, শুধু চাপা কান্নার আওয়াজ।
- হ্যারিয়েট, বাচ্চাটাকে আবার দেখাও, ঠিকমতো দেখাবে...
আবার চাপা কান্নার শব্দ, তারপর খালা বললেন,
- এটা খুবই ছোট, তেমন বাড়তি কিছু না।
- বাড়তি কিছু না?
মা রাগে ফেটে পড়লেন,
- এই পিশাচটাকে নিয়ে আমার বাড়িতে ঢোকার স্পর্ধা দেখিয়েছ, আবার বলছ 'বাড়তি কিছু না' !!
- পিশাচ!! কান্নার মাঝে চড় খেলে যেমন আর্তনাদ শোনা যায়, খালা তেমন চাপা আর্তনাদ করে উঠলেন। কিন্তু মায়ের ধমকে কান্না প্রায় থেমে গেল।
- এজন্যই ইন্সপেক্টরকে ডাকতে পারনি, না? কিন্তু এই পিশাচকে নিয়ে এখানে এসেছ কেন?
হ্যারিয়েট খালা প্রাণহীন কণ্ঠে বলতে লাগলেন,
- ওকে দেখে প্রথমে আমার ইচ্ছা হয়েছিল নিজেকে শেষ করে দেই! কারণ আমি জানি এটুকু বাড়তির জন্য ওরা ওকে সার্টিফিকেট দেবে না। আমার আদরের সোনা-মানিক... মনে হল ওকে বাঁচাবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করতে হবে... কিভাবে করব জানতাম না। এটা জানতাম, একমাস সময়ের মধ্যে আমাকে ওর জন্মের কথা জানাতে হবে, আর জানালেই ওরা ওকে নিয়ে যাবে... তাই আমি চেয়েছিলাম অন্তত সেটুকু সময় ওকে আমার কাছে রাখতে, কাউকে না জানিয়ে। তারপর যখন শুনলাম যে তোমারও মেয়ে হয়েছে, তখন ভাবলাম ঈশ্বর আমার প্রার্থনা শুনেছেন।
- বুঝতে পারছি না হ্যারিয়েট, আমার মেয়ের জন্মের সাথে তোমার প্রার্থনা পূরণের কী সম্পর্ক!
খুব কর্কশ কন্ঠে মা বললেন, তুমি ঠিক কী বলতে চাচ্ছ?
- আমি ভাবছি, হ্যারিয়েট খালা অনেক কষ্ট করে বলতে পারলেন,
- যদি আমার মেয়েকে ক'দিনের জন্য তোমার কাছে রেখে তোমার মেয়েকে ধার নেই... বেশি না, এক বা দুদিন, এরমধ্যেই আমি সার্টিফিকেট পেয়ে যাব... এমিলি, তুমি আমার বোন; তুমি আমার এমন বিপদে সাহায্য করবে না?
আবার কাঁদতে শুরু করলেন হ্যারিয়েট খালা। দীর্ঘ সময় পর মায়ের রুক্ষ কণ্ঠ শোনা গেল,
- এমন একটা জঘন্য প্রস্তাব দেবার সাহস তোমার হলো কি করে হ্যারিয়েট? একটা অনৈতিক অপরাধের ষড়যন্ত্রে আমি তোমাকে সাহায্য করবো? কী করে ভাবলে আমি আমার মেয়েকে....
ঘরের বাইরে বাবার পায়ের আওয়াজ পেয়ে মা থামলেন, বাবা ঘরে ঢুকতেই বললেন,
- জোসেফ, একে এক্ষুনি দূর করে দাও। ওকে বল "ঐটা" নিয়ে বেরিয়ে যেতে।
- বের করে দেব? হ্যারিয়েটকে?
বাবা হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করলেন। মা সবিস্তারে বর্ণনা করলেন কী ঘটেছে। সব শুনে বাবা সন্দিগ্ধ স্বরে খালাকে জিজ্ঞেস করলেন,
- এসব কি সত্যি? তুমি এমন প্রস্তাব করেছ হ্যারিয়েট ?
ক্লান্ত স্বরে হ্যারিয়েট খালা বলতে লাগলেন,
- এই নিয়ে তিনবার হল। আগের দুবারের মত এবারও ওরা আমার বাচ্চা নিয়ে যাবে। হেনরি আমাকে ঘর থেকে বের করে দিয়ে আবার বিয়ে করবে। আমার আর কিছু থাকবে না,কিছুই না... আমি এখানে খুব আশা নিয়ে এসেছিলাম, ভেবেছিলাম এমিলি আমাকে সাহায্য করবে... এমিলি আমার নিজের বোন... এখন তো মনে হচ্ছে, এই আশা করে বড় বোকামি করেছি...
- আমি তো ভেবেই পাচ্ছিনা, আমাদের মত ধর্মভীরু মানুষের কাছে আসবার সাহস তোমার হলো কী করে! তোমার এখন তো লজ্জা আর অনুতাপে দগ্ধ হবার কথা।
হ্যারিয়েট খালা কথা বললেন, এখন আর কাঁদছেন না।
- লজ্জিত বা অনুতপ্ত হবার মত কিছু আমি করিনি, বরং বলতে পারি আমি হেরে গেছি।
- কিছু করনি মানে? এই যে আমাদের সৃষ্টিকর্তার আদলে সৃষ্টি না করে তুমি অন্যরকম সৃষ্টি করেছ, এটা কি পাপ নয়? আবার সেই সৃষ্টি নিয়ে ষড়যন্ত্র করতে এসেছ! এভাবেই ঈশ্বরের শত্রুরা সারাক্ষণ সুযোগ খুঁজতে থাকে পাপ ছড়িয়ে দেবার... নানা রূপে ধর্মভীরু মানুষের কাছে আসে তাদের হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে, যেমন তুমি এসেছ তোমার পাপ সাথে করে।
- পাপ!! আমার ছোট্ট এই মিষ্টি বাচ্চাটা...
- ছোট্ট বাচ্চা! এই বাচ্চা যদি বড় হয় তবে সে এমন আরও পাপের জন্ম দেবে, সমাজকে নষ্ট করবে। এটা আমরা কিছুতেই হতে দিতে পারি না। জাতিগত বিশুদ্ধতার আইন আমরা কড়াকড়ি ভাবে মেনে চলি। এক্ষুনি তুমি এখান থেকে চলে যাও, বাচ্চার কথা কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে তোমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত কর, ঈশ্বরের কাছে তোমার পাপের জন্য ক্ষমা চেয়ে প্রার্থনা কর।
- নিশ্চয়ই...আমি ঈশ্বরের কাছে অবশ্যই প্রার্থনা করব। প্রার্থনা করব, কোন মানুষ যেন মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলার মত আইন তৈরি না করে, ঈশ্বর যেন মানুষের মনে দুর্বলের প্রতি দয়া আর দুর্ভাগার প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি করেন...
শব্দ শুনে বুঝতে পারছিলাম খালা ঘর থেকে বেরিয়ে গেছেন। সাবধানে জানালার কাছে গিয়ে দেখলাম খালা খুব সাবধানে সাদা পুটুলীটা গাড়িতে রাখলেন। তারপর গাড়িতে চড়ে পুটুলীটা কোলে নিয়ে একহাতে ধরে থাকলেন, আরেক হাতে লাগাম ধরলেন। তারপর তিনি গাড়ি ঘোরাতেই তার চেহারা স্পষ্ট হয়ে উঠল। পাথরের মত কঠিন মুখ, অন্ধের মত আলোহীন চোখে সামনে চেয়ে খালা ঘোড়া ছোটালেন- আর এই ছবিটা চিরদিনের মত আমার মনে স্থায়ী হয়ে গেল।
পাশের ঘরে বাবা তখনও খালার পাপ,ধর্মদ্রোহীতা আর নির্লজ্জতা সম্পর্কে মাকে বলছিলেন। মা মনে হচ্ছিল কাঁদছিলেন। বাবা ক্রমাগত বলে চলেছিলেন, বিশেষ করে মহিলাদের উচিত সবরকম পাপ চিন্তা থেকে মনকে মুক্ত রাখা... আমার শুনতে ভালো লাগছিল না, আমি পা টিপে টিপে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। আমার খুব জানতে ইচ্ছা হচ্ছিল, হ্যারিয়েট খালার বাচ্চার "ছোট্ট বাড়তি" জিনিসটা কী ছিল; এটা কি সোফির মত বাড়তি একটা আঙ্গুল!
কিন্তু আমার আর কখনোই জানা হয়নি "বাড়তি" জিনিসটা কী ছিল... কারণ পরদিন শুনলাম হ্যারিয়েট খালার মৃতদেহ নদীতে পাওয়া গেছে; হ্যারিয়েট খালা যে একটা মেয়ে জন্ম দিয়েছিলেন, এ প্রসঙ্গে কেউ কোন কথাই বলল না।
সেদিনের সান্ধ্য- প্রার্থনা শেষে বাবা মৃত হ্যারিয়েট খালার কথা উল্লেখ করে প্রার্থনা করলেন, সেই শেষ। এরপর আমাদের বাসায় আর কেউ কখনও হ্যারিয়েট খালাকে নিয়ে কোন কথা বলেনি, মনে হচ্ছিল সকলের স্মৃতি থেকে উনার নাম পুরোপুরি মুছে গেছে। কিন্তু আমার স্মৃতিতে উনি জেগে রইলেন, শেষ দেখা উনার সেই আশাহত মুখের ছবি বারবার মনে পড়ত, আর মনে পড়ত উনার শেষ কথা, "লজ্জিত বা অনুতপ্ত হবার মত কিছু আমি করিনি, বরং বলতে পারি আমি হেরে গেছি।"
হ্যারিয়েট খালার মৃত্যুর কারণ নিয়ে কোন আলোচনা হয়নি, কিন্তু কানাঘুষায় শুনেছিলাম এটা কোনো দুর্ঘটনা ছিল না। যেসব কথা শুনেছিলাম তার অনেকটাই বুঝতে পারিনি, কিন্তু কোন অজানা ভয়ে আমি প্রচন্ড বিচলিত হয়ে পড়েছিলাম। সোফির ঘটনাতেও আমি আমার অন্যরকম হওয়া নিয়ে ভয় পেয়েছিলাম, কিন্তু এবারের ভয় আমাকে পুরোপুরি গিলে ফেলেছিল। কয়েক রাত আমি হ্যারিয়েট খালাকে স্বপ্নে দেখলাম, একহাতে সাদা একটা পুটুলী আঁকড়ে ধরে উনি পানিতে ভাসছেন,পাথরের মত মুখ ...
এতসব দুঃখজনক ঘটনা ঘটল এমন একটা শিশুর জন্য, যে কিনা ধর্মের ব্যাখ্যা অনুযায়ী স্বাভাবিক ছিল না। ব্যাখ্যায় যা যা উল্লেখ করা আছে শিশুটি হয়তো তার থেকে একটু অন্যরকম ছিল, অথচ এই একটু অন্যরকম হওয়ার জন্য তাকে বিকৃত সৃষ্টি বলা হলো! ধর্মগুরুরা সবসময় বক্তৃতায় বলতেন,বিকৃত সৃষ্টি ধ্বংসই কাম্য, কারণ বিকৃত সৃষ্টি তার ভিতরে এক পাপকে লালন করে, এই পাপ সবকিছুতে ছড়িয়ে দেয় পঙ্কিলতা, নষ্ট করে দেয় সমস্ত পবিত্রতা। এই যে আমি অন্যদের থেকে আলাদা, তাহলে কি এটাও এমন বিকৃতি যা সমস্ত পবিত্রতা নষ্ট করে দেয়? তাহলে ধরা পড়লে আমার সাথে ওরা কী করবে?
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:০০