আগের পর্ব: নতুন জীবন- চৌদ্দ
[এতদিন কাহিনী বর্ণিত হচ্ছিল প্রথম পুরুষে, ডেভিডের ভাষায়। এখন কাহিনী সংক্ষেপ করার জন্য কাঠামো বদলে তৃতীয় পুরুষে বর্ণনা করা হল]
প্রান্তভূমির দিকে যাত্রা
ডেভিডরা স্থির করে,তারা দিনের বেলা লুকিয়ে থেকে শুধু রাতে যাত্রা করবে, দক্ষিণ- পশ্চিম অভিমুখে। দিনের বেলায় পালা করে ঘুমাবে আর পাহারা দেবে। সেইমত প্রথম ঘুমাতে গেল রোজালিন আর পেট্রা, সেইসময়ে মাইকেল ডেভিডের সাথে যোগাযোগ করে জানাল যে, ওদের ধরতে টহল দল তৈরি করে বিভিন্ন দিকে যাবার প্রস্তুতি চলছে। মাইকেল বলল, ও গুজব রটাবে যে ডেভিডদের দক্ষিণ- পূর্ব দিকে যেতে দেখা গেছে, তারপর টহল দলকে সেদিকে নিয়ে যাবে। এই সময় মার্ক যোগ দিল, ও বলল ও গুজব রটাবে ডেভিডদের উত্তর পশ্চিমে দেখা যাবার।
কয়েক ঘণ্টা পর ডেভিড রোজালিনকে জাগিয়ে ঘুমাতে গেল, কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই রোজালিনের আর্তনাদে ঘুম ভেঙ্গে গেল; শুনতে পেল মাইকেল রোজালিনকে স্বান্তনা দিচ্ছে। ওদের আলাপ থেকে বুঝলো ডেভিড বুঝল, রোজালিন তীর ছুঁড়ে একটা লোককে মেরে ফেলায় খুব ভয় পেয়ে গেছে, লোকটা গাছের আড়াল থেকে ওকে দেখছিল!! ডেভিড আতঙ্কিত রোজালিনকে শান্ত করল, তারপর দুজন মিলে লোকটার মৃতদেহ একটা গর্তে লুকিয়ে ঝরাপাতা দিয়ে ঢেকে দিল।
বিকালের দিকে ক্যাথেরিনের তীব্র যন্ত্রণাময় কান্না ওদের কাছে পৌঁছাল। ক্যাথেরিনের যন্ত্রণা এত বেশি ছিল যে ও কোন ভাবনা চিত্র পাঠাতে পারছিল না। স্যালী জানালো যে, প্রচন্ড নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে ক্যাথেরিন ইন্সপেক্টরকে সব বলে দিয়েছে, স্যালীও স্বীকার করেছে সব, ওরা ইন্সপেক্টরকে শুধু ডেভিড, রোজালিন আর পেট্রার কথা বলেছে, বাকিদের কথা বলেনি...
স্যালীর ভাবনা চিত্র মিলিয়ে গেল; কিন্তু ওদের সবার মাথাতেই ওর যন্ত্রণার চিত্র রয়ে গেল। মাইকেল জানাল, ডেভিড আর ওর সঙ্গীদের নিয়ে ইন্সপেক্টর খুবই বিচলিত হয়েছেন, কারণ তাদের বিকৃতির ধরণ এমন যে, বিশ বছর তারা সবার সাথে মিশে কাটিয়েছে, ধরা না পড়ে। এই ধরনের বিকৃতিকে তিনি বিপজ্জনক মনে করছেন। তিনি আনুষ্ঠানিক ভাবে এই তিনজনকে বিকৃত সৃষ্টি বা না- মানব হিসাবে ঘোষণা দিয়ে এদের দেখামাত্র মেরে ফেলার হুকুম দিয়েছেন। ওদের মেরে ফেলার হুকুম হয়েছে শুনে ডেভিড বলল, প্রাণ বাঁচাতে ওদের খুব তাড়াতাড়ি প্রান্তভূমিতে পৌঁছাতে হবে।
কথা শেষ করেই ওরা যাত্রা শুরু করল, প্রান্তভূমিতে যাবার কথা শুনে পেট্রা মুখে কিছু বলল না কিন্তু ঘোড়া চলা শুরু হতেই হঠাৎ তার সেই প্রচন্ড জোরে আর্তনাদের বিচ্ছুরণ শুরু করল, এই বিচ্ছুরণের ধাক্কা সামলে ডেভিড পেট্রাকে এর কারণ জানতে চাইলে পেট্রা বলল প্রান্তভূমিতে থাকা দৈত্য দানবদের ও ভয় পাচ্ছে!! এসময় মাইকেল পেট্রাকে বোঝাতে লাগলো যে, প্রান্তিক মানুষেরা মোটেই দৈত্য দানব না, তারা ওদের মতোই মানুষ। কথার মাঝখানে পেট্রা মাইকেলকে থামতে বলে বলল, আরেকজন কেউ ওর সাথে যোগাযোগ করতে চাইছে।
যিল্যান্ডের মহিলা
শুনে সবাই অবাক হলো; ডেভিড, রোজালিন, মাইকেল, রেচেল, মার্ক সবাই খুব মনযোগ দিয়েও কোন ভাবনা চিত্র ধরতে পারল না, কিন্তু পেট্রা চোখ বুজে খুব মন দিয়ে কিছু শুনছিল। চোখ খুলে ও ডেভিডদের বলল, একজন মহিলা ওকে প্রশ্ন করছিলেন। মহিলাটি অনেক অনেক দূরে থাকেন, কিন্তু পেট্রার ভয়ার্ত বিচ্ছুরণ তার কাছে পৌঁছেছে, তাই তিনি জানতে চাচ্ছেন পেট্রা কোথায় থাকে। পেট্রা জানাল ওরা ল্যাব্রাডরে থাকে। মহিলা জানালেন, তিনি বহুদূরে দক্ষিণ- পশ্চিমে থাকেন, সেই জায়গার নাম যিল্যান্ড, সেই জায়গার চারপাশে সাগর। সেই মহিলা জানালেন ল্যাব্রাডর বলে কোন জায়গা আছে বলে তার জানা নেই; মাইকেল- ডেভিড- রোজালিনরাও যিল্যান্ডের নাম কখনো শুনেছে বলে মনে করতে পারল না। ডেভিড পেট্রার কাছ থেকে যিল্যান্ডের বর্ণনা শুনে বুঝতে পারল, ছোটবেলায় ও যে একটা অদ্ভুত শহরের স্বপ্ন দেখত, যিল্যান্ড হুবহু সেই শহর!
সারারাত চলার পর সকালে ওরা এক জায়গায় থামল। সারারাত জেগে পেট্রা হয়রান ছিল বলে ওকে আর রোজালিনকে ঘুমাতে দিয়ে ডেভিড পাহারায় বসল। কিছুক্ষণ পর মাইকেল জানাল, রোজালিন যাকে হত্যা করেছিল সেই লোকের কুকুর লুকিয়ে রাখা লাশ বের করে ফেলেছে, এটা দেখে সবাই বুঝে গেছে ডেভিডরা দক্ষিণ পশ্চিমে যাচ্ছে। এখন অন্যদিকে থাকা সমস্ত দলগুলোকে একত্রিত করা হচ্ছে ওদের পিছু ধাওয়া করার জন্য। আবার পালাতে হবে... রোজালিন আর পেট্রার কাঁচা ঘুম ভাঙ্গিয়ে ডেভিড আবার চলা শুরু করল। এবার হঠাৎ সামনে এল এক ঘোড়সওয়ার, ডেভিড আর রোজালিন কয়েকটা তীর ছুঁড়ে তার ভবলীলা সাঙ্গ করল। লাশ লুকানোর জন্য সময় ব্যয় না করে আবার চলা শুরু করল, এরপর লুকিয়ে থাকার উপযোগী একটা জায়গা পেয়ে ওরা বিশ্রাম নিতে থামল।
ঘোড়ারা ঘাস খাচ্ছে, ডেভিডরাও গোগ্রাসে খাবার খাচ্ছে, এমন সময় যেন তড়িতাহত হয়ে ডেভিড বিষম খেল; একটু ধাতস্থ হয়ে বুঝল পেট্রা তার দূরের বন্ধু, সেই মহিলার সাথে কথা বলছে, এটা তারই অভিঘাত। পেট্রার বন্ধু ডেভিডদের সাথে কথা বলতে চাইলেন, কিন্তু ডেভিড আর রোজালিন তাদের সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করেও ওনার কাছে পৌঁছাতে পারল না। অবশেষে পেট্রা মহিলার কথা শুনে ডেভিডদের কাছে পাঠাতে লাগলো- মহিলার কথা এই, পেট্রা অসাধারণ অভিক্ষেপণ ক্ষমতার অধিকারী, তাই পেট্রাকে রক্ষা করার জন্য তিনি আসছেন, তার পৌঁছানো পর্যন্ত যেন যে কোন মূল্যে ডেভিডরা পেট্রাকে রক্ষা করে। তিনি বারে বারে একথা বলতে লাগলেন। ডেভিডের খুবই অদ্ভুত লাগছিল, কারণ এক্সেল খালু পৃথিবীর যে বর্ণনা দিয়েছেন তাতে দক্ষিণ পশ্চিমে পৃথিবীর শেষ প্রান্ত পর্যন্ত শুধু পোড়াভূমি থাকার কথা, তাহলে এই যিল্যান্ড কোথায়!!
সন্ধ্যার একটু আগে, রোজালিন আর পেট্রা ঘুমাচ্ছে এমন সময় মাইকেল জানাল যে, ধাওয়াকারী দল দৈত্য ঘোড়ার পায়ের ছাপ খুঁজে পেয়েছে, এখন এই ছাপ ধরে অনুসরণ করে ওরা ডেভিডদের ধরে ফেলবে, তাই যত তাড়াতাড়ি পারে ওদের সরে পড়তে হবে। ডেভিড জানতে চাইল স্যালী আর ক্যাথেরিনের খবর কেউ জানে কিনা। রেচেল জানাল যে স্যালী আর ক্যাথেরিন অত্যাচারের পর অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল, তারপর থেকে আর যোগাযোগ নেই, এর অর্থ একটাই হতে পারে, ওদের দুজনকে মেরে ফেলেছে!!
দুই বন্ধুর এমন মৃত্যুর খবর শুনে ডেভিড আর মাইকেল স্তব্ধ হয়ে গেল; প্রথম কথা বলল মাইকেল। বলল, ধরা পড়লে কথা আদায়ের জন্য রোজালিন আর পেট্রার উপরও প্রচন্ড নির্যাতন করবে। সেই যন্ত্রনাময় মৃত্যু থেকে বাঁচাতে যেন ডেভিড ওদের আগেই মেরে ফেলে...
প্রান্তভূমিতে আগমন
আবার যাত্রা শুরু করার পর দেখা গেল পেট্রা একদম চুপচাপ; তারপর যখন বকবক শুরু করল তখন বোঝা গেল এতক্ষণ ও ঐ মহিলার কথা শুনছিল।
- যিল্যান্ড খুব মজার দেশ- সেখানে সবাই ভাবনা চিত্র বানাতে জানে, অবশ্য সবাই একাজে খুব দক্ষ যে তা না, বেশিরভাগই তোমার আর ডেভিডের মতো। অবশ্য আমার বন্ধু তাদের থেকে অনেক বেশি দক্ষ, কিন্তু উনি বলেছেন যে আমার মতো আর কাউকে এত জোরদার ভাবনা চিত্র উনি বানাতে দেখেননি। উনি বলেছেন, আমার কিছুটা প্রশিক্ষণের দরকার, তারপর আমি এমন সাঙ্ঘাতিক দক্ষ হয়ে উঠব যা অনেক কাজে লাগবে... উনি বলেন, যেসব মানুষ শুধু মুখে কথা বলতে জানে তারা অসম্পূর্ণ মানুষ, তারা খুব একাকী, তারা জানেইনা কিভাবে অনেক মানুষ মিলে একসাথে ভাবতে হয়...
পেট্রা আপনমনে কথা বলতে লাগলো, আর ঘোড়ার পিঠে চেপে ডেভিডরা অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলো। প্রায় তিন ঘন্টা চলার পর যে জঙ্গলে ঢুকলো, অন্ধকারেও তার গাছপালার অস্বাভাবিক আকার আকৃতি দেখে ওরা বুঝল যে প্রান্তভূমিতে পৌঁছে গেছে!! এরপর কি করবে, কোনদিকে যাবে ভাবতে ভাবতেই ডেভিডের মনে হলো মাথার উপর আকাশ ভেঙ্গে পড়ল, সঙ্গে সঙ্গেই ডেভিড জ্ঞান হারালো।
রোজালিন কোমল স্বরে ক্রমাগত ডাকতে থাকায় একসময় ডেভিড চেতনা ফিরে পেল। নড়তে গিয়ে দেখতে পেল ওর পা বাঁধা, শুনতে পেল মাইকেল উদ্বিগ্ন ভাবে ওর কাছে জানতে চাইছে কী ঘটেছে। জবাব দিল রোজালিন; বলল, গাছের ডালের উপর ওত পেতে থাকা চার পাঁচজন প্রান্তিক মানুষ ওদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, একজন সরাসরি ডেভিডের ঘাড়ে, ফলে ডেভিড অজ্ঞান হয়ে যায়। তারপর আরো কয়েকজন প্রান্তিক মানুষ ঘোড়া ঘিরে ধরে, অজ্ঞান ডেভিডকে একটা ঘোড়ায় আর বাকি দু'জনকে অন্য ঘোড়ায় চাপিয়ে প্রান্তভূমির আরো ভেতরে নিয়ে যাচ্ছে। প্রান্তিক এই লোকগুলো বেশ হাসিখুশি। নোংরা, ছেঁড়াফাটা কাপড় ছাড়া ওদের সবকিছুই সাধারণ মানুষের মত।
ডেভিড তাকিয়ে দেখল চারপাশে অস্বাভাবিক সব উদ্ভিদ। ওর ঘোড়ায় যে প্রান্তিক মানুষ বসে আছে তার কোন অস্বাভাবিকতা প্রথমে নজরে না পড়লেও পরে দেখল লোকটার ডানহাতে তিনটা আঙ্গুল নেই। ডেভিডের জ্ঞান ফিরেছে দেখে লোকটা ডেভিডের দিকে একটা চামড়ার পাত্র বাড়িয়ে দিয়ে পানি পান করতে দিল, তারপর ডেভিডের সাথে অনেক কিছু নিয়ে আলোচনা করল। সে বলল, ডেভিডদের বন্দী করা হয়েছে, কারণ প্রান্তভূমি এলাকায় নতুন কেউ এলে তাকে বন্দী করাই নিয়ম।
ডেভিড বুঝতে পারছিল, এই অস্বাভাবিক রাজ্যে ওদের আগমনের কারণ বোঝাতে হবে, কিন্তু ওদের শারীরিক কোন বিকৃতি নেই, তাহলে ওদের অস্বাভাবিকতা কোথায় এটা কিভাবে বোঝাবে সে ব্যাপারে মাইকেলের সাথে আলোচনা করল। মাইকেল বলল, ডেভিড যেন শুধু ওদের তিনজনের কথাই বলে, যে ওরা পরষ্পরের সাথে ভাবনা চিত্রের মাধ্যমে যোগাযোগ করে, এটাই ওদের অস্বাভাবিকতা!!
ডেভিড পেট্রাকে বুঝিয়ে বলল, ও যেন মাইকেলদের বা যিল্যান্ডের মহিলার উল্লেখ না করে। পেট্রা বুঝতে পারল, কিন্তু বলে উঠলো,
- যিল্যান্ডের বন্ধু তো একেবারে কাছে চলে এসেছে!
বলে আবার তার বন্ধুর সাথে কথা বলতে লাগলো। উনি যে সত্যিই কাছে চলে এসেছেন, সেটা ডেভিড আর রোজালিন দুজনেই বুঝতে পারছিল কারণ ওদের কাছেও পেট্রার বন্ধুর ভাবনা চিত্র পৌঁছাচ্ছিল। রোজালিন উনার সাথে যোগাযোগের জন্য যতদূরে পারে ওর ভাবনা অভিক্ষেপণ করল, মহিলা প্রত্যুত্তরে জানালেন ওদের সাথে যোগাযোগ করতে পেরে উনার খুব ভালো লাগছে, এখন পেট্রাকে নিয়ে তার উদ্বেগ কিছুটা কমেছে, পেট্রা তার শিশুসুলভ ভাষায় যেভাবে পরিস্থিতি বর্ণনা করছিল তা তিনি ভালভাবে বুঝতে পারেননি। তিনি রোজালিনের কাছে পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলেন।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে এপ্রিল, ২০২০ রাত ১০:৫৫