আমার পরিচিত কয়েকজন এবার এইচএসসি পরীক্ষার্থী। মাঝে মাঝে তাদের কাছে খবর নিতাম পরীক্ষার সিদ্ধান্ত হলো কিনা জানতে। শুনেছিলাম পরীক্ষা বিষয়ক সিদ্ধান্ত নেবার জন্য একটা কমিটি করা হয়েছে এবং কমিটির মতে বিশেষ ব্যবস্থায় নভেম্বর নাগাদ পরীক্ষা নেয়া সম্ভব। বিশেষ ব্যবস্থাগুলো এমন:
১)পরীক্ষা শেষ করা হবে অল্প কয়েকদিনের মধ্যে, একই বিষয়ের দুই পত্র পরীক্ষা একদিনে দুই ঘন্টা দুই ঘন্টা করে নেয়া হবে, ফলে সাত বিষয়ের পরীক্ষা এখনকার মত দুই মাস যাবত না নিয়ে তাত্বিক পরীক্ষা ৭ কার্যদিবসে, ১৫ দিনের মধ্যে নিয়ে ফেলে পরীক্ষা কার্যক্রম শেষ করা হবে। ব্যবহারিক পরীক্ষা হবে না, টেস্ট পরীক্ষার নম্বরকে প্রাপ্ত নম্বর ধরা হবে।
২) এইচএসসি পরীক্ষার অনুষ্ঠিত হয় কলেজগুলোতে, এবার সেই সাথে আশেপাশের স্কুলগুলোতেও পরীক্ষা নেয়া হবে (যেহেতু স্কুল বন্ধ) যাতে পরীক্ষার্থীদের মাঝে প্রয়োজনীয় ছয় ফিট দূরত্ব বজায় রাখা যায়।
৩) পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষা শুরুর তিন দিন আগে করোনা টেস্ট করে কেবলমাত্র নেগেটিভ রেজাল্ট হলেই পরীক্ষা দিতে আসবে টেস্টের রিপোর্টসহ। পরীক্ষায় ব্যবহৃত ক্লিয়ার ব্যাগ, কলম, ক্যালকুলেটার স্যানিটাইজার দিয়ে বিশুদ্ধ করবে। সকলে মাস্ক পড়বে, হলে ঢোকার আগে হাত স্যানিটাইজ করবে।
৪) পরীক্ষার গার্ড এবং পরীক্ষা সংশ্লিষ্ট সকলের জন্য সরকারি খরচে পর্যাপ্ত সুরক্ষা সামগ্রী দেয়া হবে, যাতে পরীক্ষার্থীদের কাগজ পরীক্ষার সময় তারা ঝুঁকিমুক্ত থাকতে পারেন। একদিনে দুই পরীক্ষা হবার কারণে তাদের কাগজপত্র ধরার ঝুঁকিও কম হবে। তারপরও একই মানুষকে পুরো পরীক্ষা কালে ডিউটি না দেয়া হবে না। সরকারী খরচে তাদের করোনা টেস্ট হবে, নেগেটিভ হলে ডিউটি করতে পারবেন, পজিটিভ হলে পারবেন না।
৫) যদি দেখা যায় এরপরও পরীক্ষা নেবার অনুকূল পরিস্থিতি হয়নি, তবে প্রি টেস্ট আর টেস্টে প্রাপ্ত নাম্বারের ভিত্তিতে এইচএসসির ফল ঘোষণা করা হবে।
শুনেছিলাম এইচএসসি নিয়ে পরিকল্পনা এমনই ছিল- ঝটপট পরীক্ষা নিয়ে ফেলা, ডিসেম্বর/ জানুয়ারি নাগাদ ফল প্রকাশ ইত্যাদি। এই ব্যবস্থায় ছাত্রদের ঝুঁকি সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখার চেষ্টা করা হবে। শিক্ষকদের ঝুঁকির ব্যাপারে বলা হয়েছে যে এখন যখন সর্বত্র সাধারণ মানুষ প্রতিদিন ঝুঁকি নিয়ে যাতায়াত, অফিস ডিউটি, ট্যুর করতে পারছেন তবে শিক্ষকেরা মাত্র কটা দিন কেন তাদের ডিউটি করতে পারবেন না?
গতকাল শুনলাম এইচএসসি পরীক্ষা হবে না। জেএসসি আর এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে এইচএসসির ফলাফল নির্ধারিত হবে। জানি না, কেন আগের পরিকল্পনা বদলে দিয়ে পরীক্ষা না নেবার এই বর্ণবাদী সিদ্ধান্ত নেয়া হলো!! বর্ণবাদী সিদ্ধান্ত বলছি, কারণ এই অক্টোবর মাসেই হতে যাচ্ছে দুটো পাবলিক পরীক্ষা, ও লেভেল আর এ লেভেল পরীক্ষা। এই দুই পরীক্ষা অনলাইনে নয়, স্কুলে বসেই দেবে শিক্ষার্থীরা কিছু নিয়ম মেনে। ও লেভেল এ লেভেল পরীক্ষা নেয়া সম্ভব হলে এইচএসসি নেয়া কেন যাবে না? এর কারণ কী এটাই, আমাদের সমাজের উঁচু তলার মানুষেদের সন্তানেরা ও লেভেল/ এ লেভেল পড়ে তাই তাদের শিক্ষায় গলদ থাকা চলবে না, আর আমজনতার সন্তানদের শিক্ষায় গলদ সৃষ্টি করা দরকার!! আমাদের বিল্ডিঙের ক্লিনারের মেয়ে এইচএসসি পরীক্ষা দেবে, গ্রামের কলেজে ফিস চৌদ্দ/ পনের হাজার টাকা। সে আমাদের সবার থেকে এই টাকা চেয়ে নিয়ে ফিস জমা দিয়েছে। আরো কয়েকজনকে আমি জানি যারা অনেক কষ্টে পরীক্ষার ফিস জমা দিয়েছে। জমাকৃত ফিসের এই কয়েকশ' কোটি টাকা এখন কিসে ব্যয়িত হবে?
কেউ বলতে পারেন একটানা বসে চার ঘণ্টা পরীক্ষা দেয়া অসম্ভব। আসলে এটা কঠিন কিছু নয়, আমিও দিয়েছি। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন পরীক্ষা এলেই একদল ছাত্র পরীক্ষা পেছানোর জন্য আন্দোলন করত, তাদের দাবি ছিল এত কঠিন বিষয়ে পরীক্ষা দেবার জন্য ১৫ দিনের পরীক্ষা- প্রস্তুতি ছুটি পর্যাপ্ত নয়। একবার শিক্ষকেরা ক্ষেপে গিয়ে পরীক্ষা পরের সেমিস্টার পর্যন্ত পিছিয়ে দিলেন, অর্থাৎ দুই সেমিস্টারের পরীক্ষা একদিনে হলো, নির্ধারিত তিন ঘণ্টার বদলে চার ঘণ্টায়। সেই পরীক্ষা আমরা দিয়েছিলাম আর কোন উপায় না থাকায়, দুদিনের গ্যাপে দুই সেমিস্টারের পড়া পড়ে... এবার এইচএসসির অনেক ছাত্র এই কয় মাস নিয়মিত পড়ে গেছে পরীক্ষা হবার আশায়, একদিনে দুই পরীক্ষা দিতে তাদের কোন অসুবিধা হবার কথা নয়।
হতাশ লাগছে এটা ভেবে, বড়লোকের বাচ্চাদের ও এ লেভেল পরীক্ষা দিতে দেয়া হচ্ছে, কারণ এরপর তাদের বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হবে, অফলাইন বা অনলাইন ক্লাস যেটাই হোক। অথচ আমাদের মতো আমজনতার সন্তানদের লেখাপড়ার কোন গুরুত্ব নেই!! বরং আমজনতার শিক্ষাকে ধাপে ধাপে ধ্বংস করা হয়েছে। ধ্বংসের প্রক্রিয়া বুঝতে গেলে কয়েক বছর পেছনে মেতে হবে, যখন শিক্ষা ব্যবস্থা এমন ছিল যে মেধাবীদের মূল্যায়ন করা হতো। আগে এসএসসি, এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হতো ১৫/২০ দিনে, ফলাফল বোঝানো হতো ডিভিশন দিয়ে, ফার্স্ট সেকেন্ড থার্ড ডিভিশন ইত্যাদি। গড়ে ৭৫% নম্বরকে বলা হতো স্টার মার্ক, এটা পাওয়া খুব সহজ ছিল না তাই কেউ স্টার নম্বর পেলে তাকে মেধাবী বলা যেত। কোন বিষয়ে ৮০% বা তদূর্ধ্বকে বলা হতো লেটার মার্ক। বোর্ডের এই দুই পরীক্ষায় ফল প্রকাশ হলে প্রথম বিশজনের নাম ছাপা হতো পত্রিকায়, আর সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়ে যে প্রথম স্থান অধিকার করতো মা-বাবা সহ তার ছবি ছাপা হত পত্রিকায়। এই দুই পরীক্ষায় মেধার ভিত্তিতে বৃত্তি দেয়া হতো। এইসব করা হতো শিক্ষায় ছাত্রদের অনুপ্রাণিত করতে।
মেধাবীদের উৎসাহ দেবার জন্য বৃত্তি পরীক্ষা হতো পঞ্চম আর অষ্টম শ্রেণীতে। টাকার পরিমাণ অল্প, কিন্তু মেধার যাচাই হতো বলে শিক্ষার্থীরা খুব চেষ্টা করত এই বৃত্তি পেতে।
বলা হল মেধা যাচাইয়ের এই পদ্ধতি বৈষম্যমূলক। তাই বিদেশের শিক্ষা পদ্ধতি অনুযায়ী আমাদের দেশে গ্রেডিং পদ্ধতি আনা হলো এসএসসিতে প্রথম ২০০১ সালে, সব বোর্ড মিলে সে বছর সর্বোচ্চ জিপিএ ৫ পেলেন ১৯ জন (সম্ভবত), দ্বিতীয় বছরে ৭৬ জন। (কোন বিষয়ে ৮০ নম্বর পেলে সেটা গ্রেড ৫, সব বিষয়ের গড়কে বলা হলো জিপিএ)। এরপর আনা হল চতুর্থ বিষয়ের পদ্ধতি, যাতে জিপিএ ৫ এর সংখ্যা বাড়ে, বাড়লোও। বলা হলো এটাই ছাত্রদের মেধা বিকাশের সর্বোত্তম পদ্ধতি; যারা চতুর্থ বিষয় ছাড়াই জিপিএ ৫ পেল তাদের নাম হলো গোল্ডেন ফাইভ। মা-বাবা, ছাত্র সবাই মিলে ছুটতে লাগলো জিপিএ ফাইভের এর পেছনে!! কোন বিষয়ে খুব ভালো করে শেখার দরকার আর রইলো না, কারণ কোনমতে ৮০ তোলা দরকার!!
২০০৯ সালে পঞ্চম শ্রেণীতে বৃত্তি পরীক্ষা তুলে দিয়ে পাবলিক পরীক্ষা শুরু হলো, নাম হলো পিইসি। কত সালে ঠিক মনে করতে পারছি না, অষ্টম শ্রেণীতে শুরু হলো জেএসসি নামক পরীক্ষা। এগুলো পাবলিক পরীক্ষা, জানা গেল পরবর্তী জীবনে এই পরীক্ষা গুলোকে গুরুত্বপূর্ণ ধরা হবে। ফলে দেখা গেল চতুর্থ শ্রেণী শেষ করেই শিক্ষার্থীরা কোচিংয়ে নাম লেখাচ্ছে জিপিএ পাঁচ পাবার জন্য। শেখার আনন্দ, মেধার লড়াই এই সবকিছু বাদ হয়ে ছাত্রদের পরীক্ষাতংক শুরু হলো। পরীক্ষায় খারাপ করে অনেক ছাত্র আত্মহত্যা করতে লাগলো, পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রও!!
২০১০ সালে কোন রকম প্রস্তুতি/ প্রশিক্ষণ ছাড়াই সৃজনশীল পদ্ধতি নামে এক পদ্ধতি চালু হলো, যে পদ্ধতি সম্পর্কে ছাত্র শিক্ষক কারোরই তেমন ধারণা ছিল না। তাই সৃজনশীলতা শিখতে ছাত্ররা কোচিং আর গাইড বইয়ের সাহায্য নিতে লাগলো... শিক্ষা ব্যবস্থায় এলো বানিজ্য। মেধার চর্চা আর মেধাবীদের কদর এভাবে ক্রমান্বয়ে কমতে লাগলো, ছাত্ররা সহজে জিপিএ ফাইভ পাবার পথ আবিষ্কার করে ফেলল!
২০১৪ সাল থেকে শুরু হলো প্রশ্ন ফাঁস পদ্ধতি, প্রথমে এইচএসসি থেকে শুরু হলেও পরবর্তী কয়েক বছরের মধ্যেই প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্যও এই প্রশ্ন ফাঁস পদ্ধতি খুলে দেয়া হলো। জিপিএ ফাইভের হার বেড়ে হলো হাজার হাজার হাজার...
সবশেষে ২০২০ এল অটোপাশ পদ্ধতি, এই পদ্ধতির সুফল এই যে গতবছর এইচএসসিতে ফেল করারাও এবার পাশ করে যাবে, সবাই সুখী হবে, ভালো ফল করতে না পেরে আত্মহত্যা কেউ করবে না!!
বড়লোকের ছেলেমেয়েরা গাড়ি চড়ে ও/এ লেভেল দিতে যাবে বলে হয়তো তাদের পরীক্ষা নেয়াতে কোন ঝুঁকি নেই... এইচএসসিতেই সব ঝূঁকি। কেন?
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই অক্টোবর, ২০২০ রাত ১০:০২