somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চার প্রজন্ম -১

০৫ ই জুলাই, ২০২৩ সকাল ১০:০৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




আমার নানী থেকে আমার কন্যা- চার প্রজন্ম। আমি মাঝে মাঝেই ভাবতে বসি এই চার প্রজন্ম নিয়ে, গত একশো বছরে বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত নারী জীবনে যেসব পরিবর্তন এসেছে সেসব নিয়ে। পরিবর্তন অনেক এসেছে... নারীর নাম, পোষাক, শিক্ষা, জীবনযাত্রা সবই অনেক বদলে গেছে!

গত একশো বছর বলছি, কারণ আমার নানীর জন্ম সাল হিসাব নিকাশ করে স্থির করা হয়েছিল ১৯১৭ সাল, সত্যিকার জন্ম তারিখ কত কে জানে! নানীর যুগে মেয়েদের জন্ম কবে হলো কেউ মনে রাখতো না। মেয়েরা জন্মাতো, তারপর বড় হতো পরের ঘরে যাবার জন্য, তারপর এক সময় চলেও যেত বাপের বাড়ি ছেড়ে, তারপর তার ঠিকানা হতো স্বামীর কিংবা ছেলের বাড়ি। কিন্তু গত একশো বছরে বিজ্ঞানের অভাবনীয় উন্নতিতে পৃথিবী বদলে গেছে, মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়েছে, তাতে আমার মত মুসলিম মধ্যবিত্ত পরিবারের নারীদের জীবনও বদলে গেছে। কতটুকু বদলেছে তার হিসাব করার জন্য এ লেখা; মূলতঃ স্মৃতিচারণমূলক কিন্তু কখনো জীবন দর্শন। আমার মা আর নানীর মতো রান্না, ঘরকন্না আর বছর বছর বাচ্চা বিয়ানোর জীবন আমি যাপন করিনি, আসলে আমার প্রজন্মে আমরা ক্রমান্বয়ে ঘর থেকে বাইরে বেড়িয়ে এসেছি, শিক্ষিত, স্বাবলম্বী হয়েছি। কিন্তু এই পরিবর্তনের ফলে আমরা কতটুকু এগোলাম!!

আমার নানী নিজের গ্রাম থেকে প্রায় দেড়শ মাইল দূরের এক শহরে স্থায়ী হয়েছিলেন, আমার মা সেখান থেকে আরো দূরে ঢাকা শহরে সংসার পেতেছিলেন, আমি দেশ ছেড়ে আড়াই হাজার মাইল দূরে গিয়েছিলাম, আমার মেয়ে গিয়েছে আট হাজার মাইল দূরে। আমাদের পরিবারের নারীরা ঘর ছেড়ে পৃথিবীর পথে কেবলই এগিয়ে গেছে। আসলে সামগ্রিকভাবে বাঙালি মেয়েরাই এগিয়ে গেছে, আমি স্কুলের পাঠ্য বইয়ে হিলারির এভারেস্ট জয়ের কাহিনী পড়ে বিস্ময়ে অভিভূত হয়েছিলাম, অথচ আজ আমাদের দেশের মেয়েই এভারেস্ট জয়ী হয়েছে। কিন্তু এসব দেখেও এগিয়ে যাবার হিসাব আমি কিছুতেই মিলাতে পারি না। আমার শুধু মনে হতে থাকে, ছোটবেলায় আমার নানী কোথাও গেলে আমাকে সাথে নিয়ে যেতেন, (কারণ একাকী মহিলার যাতায়াত ভালো চোখে দেখা হতো না), আর এই একবিংশ শতাব্দীতেও আমি আমার মেয়েকে স্কুল কলেজে নিয়ে গিয়েছি... মেয়েদের একাকী চলাচল করার মতো পরিবেশ যদি আজও সৃষ্টি না হয়ে থাকে, তবে আমরা কতটুকু এগোলাম!!

অবশ্য আগের দুই প্রজন্ম থেকে আমি মানসিকভাবে অনেকটা এগিয়ে গেছি অন্তর্জালের অবদানে। এই অন্তর্জাল আমার হাতের মুঠোয় অনেক তথ্য এনে দিয়েছে, ফলে আগের প্রজন্মের অনেক কুসংস্কার আর ভুল ধারণা থেকে মুক্তি পেয়েছি। জানিনা কত প্রজন্ম ধরে এই ভুল ধারণা গুলো নারীরা মনে লালন করতেন, কিন্তু আমার মনেও এমন অনেক ধারণা গেঁথে গেছিল, যেগুলোর মূলকথা হচ্ছে পুরুষের সন্তুষ্টি অর্জন করাই নারী জনমের সার্থকতা, ইহকালে এবং পরকালে!! কিন্তু এখন অন্তর্জালের কল্যাণে সত্য মিথ্যা যাচাই করা খুব সহজ হয়ে গেছে, তাই নারীদের দমিয়ে রাখার জন্য রচিত যেসব কাহিনী শুনে আমার মা নানী বিশ্বাস করেছেন, আমি আর করি না। এমন একটা কাহিনী টেডি বেগমের ঘটনা।

টেডি বেগমের গল্প আমার মা যখন প্রথম শুনেছিলেন তারপর প্রায় পঁয়ষট্টি বছর পেরিয়ে গেছে, কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার এই, ক'মাস আগে আমিও এই গল্প আবার শুনলাম, শুধু স্থান আর নাম বদলে গেছে। ঘটনাটা এরকম:

তখন আমার মায়ের বিয়ের পর নতুন সংসার আজিমপুর কলোনির ছোট একটা ফ্ল্যাটে। কলোনির কাছাকাছি ঢাকা মেডিকেল কলেজ আর পুরানো ঢাকার অনেক দর্শনীয় স্থান। তাই বাসায় সবসময় মেহমান লেগেই থাকে, এরা আমার দাদাবাড়ির গ্রামের মানুষ, কখনো রোগী আর কখনো ঢাকা- দর্শনার্থী হিসেবে আসতেন। একজন যদি রোগী হয় তবে তার সাথে চারজন এ্যাটেনডেন্ট, তারা ঢাকা শহর দেখবে বলে আসেন। আমার আব্বা চাকরিতে নতুন, তাই বেতন কম আর বাসা ছোট, তারমধ্যে আমার মা ছোট সন্তান নিয়ে মেহমানদারি করতে গিয়ে হিমশিম খেতেন। প্রায়ই রান্নার সময় মা দেখতেন কিছু না কিছু ফুরিয়ে গেছে, অতএব বাচ্চা কোলে নিয়ে কাছাকাছি নিউমার্কেটে গিয়ে কিনে আনতে হতো। একদিন এভাবে কিছু কিনতে নিউমার্কেটে যাচ্ছেন, একজন মেহমান জিজ্ঞেস করলেন মা কোথায় যাচ্ছেন। মা যখন বললেন নিউমার্কেটে যাচ্ছেন, তখন তিনি খুব রেগে বললেন,

- তুমি কি টেডি বেগম হতে চাও নাকি? খবরদার!
স্বামী ছাড়া কখনও ঘর থেকে এক পাও বাড়াবে না।

তারপর মা টেডি বেগমের গল্প শুনেছিলেন। একজন মহিলা ছিলেন যিনি স্বামী ছাড়া একা একা বাজার হাটে যেতেন, তাই তাঁকে লোকে 'টেডি বেগম' বলে ডাকতো। একদিন অসুস্থ হয়ে তিনি মারা যান, তাকে আজিমপুর কবরস্থানে কবর দেয়া হয়। কবর দেবার পর যখন সবাই ফিরে যাচ্ছে তখন একজন দেখলেন তার হাতের ঘড়ি হাতে নাই। তিনি অনুমান করলেন, যখন লাশ কবরে রাখছিলেন, তখন হাত থেকে ঘড়ি খুলে কবরে পড়ে থাকতে পারে। তাই ঘড়ি উদ্ধারের জন্য তিনি কবরের পাশে গিয়ে কবরের উপরের মাটি কিছুটা সরালেন; দেখলেন কবরের ভিতর গিজগিজ করছে অসংখ্য ভয়ংকর সাপ, সেগুলো টেডি বেগমকে অনবরত ছোবল দিচ্ছে। এই ভয়াবহ দৃশ্য দেখে তিনি ঘড়ির কথা ভুলে তাড়াতাড়ি পালিয়ে এলেন, সকলকে জানালেন তিনি কী দেখেছেন! শুনে তার সঙ্গীরা সবাই বুঝতে পারলেন, টেডি বেগমের এই শাস্তি হয়েছে কারণ তিনি স্বামীর অনুমতি ছাড়া বাজার হাটে যেতেন!

এই গল্প আমি পরেও শুনেছি, একবার শুনেছি বছর পাঁচেক আগে মিশরের এক নারীকে নিয়ে, মাস দুয়েক আগে শুনলাম করাচির এক নারীকে নিয়ে; তারা বেপর্দা চলাফেরা করতেন, তাদের মৃত্যুর পর তাদের কবরের শাস্তির প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা হুবহু টেডি বেগমের শাস্তির মতো। দেশ, সময় আর মানুষ বদলে গেছে, কিন্তু এই গল্প প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চালু আছে। এই গল্পের মূলকথা, ঘর ছেড়ে বাইরে পা রাখা নারীর জন্য মৃত্যুর পর ভয়াবহ আজাব অপেক্ষা করছে।

আমার মায়ের সাথে আমার তফাৎ এই, আমার মা গল্প বিশ্বাস করেছিলেন। কিন্তু আমি বিশ্বাস করিনি!
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জুলাই, ২০২৩ সকাল ১০:০৭
২৫টি মন্তব্য ২৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তুমি অথবা শরৎকাল

লিখেছেন আজব লিংকন, ১৫ ই অক্টোবর, ২০২৪ সকাল ১০:১০


রোদ হাসলে আকাশের নীল হাসে।
গুচ্ছ গুচ্ছ সাদা মেঘ দল ব্যস্ত হয়ে
দূর সীমাহীন দিগন্তে ছুটে।

লিলুয়া বাতাসে তোমার মুখে এসে পড়া চুল আর
ঢেউ খেলানো আঁচলের সাথে—
কাশবনে সব কাশফুল নেচে যায়।
নিভৃতে একজোড়া অপলক... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রসঙ্গঃ স্কুলে ভর্তি.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ১৫ ই অক্টোবর, ২০২৪ সকাল ১০:৪০

প্রসঙ্গঃ স্কুলে ভর্তি.....

সেই ষাট সত্তর দশকের কথা বলছি- আমাদের শিক্ষা জীবনে এক ক্লাস পাস করে উপরের ক্লাসে রেজাল্ট রোল অনার অনুযায়ী অটো ভর্তি করে নেওয়া হতো, বাড়তি কোনো ফিস দিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মন্দির দর্শন : ০০২ : পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি পূজা মন্ডপ ও নাচঘর বা নাট মন্দির

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৫ ই অক্টোবর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২


পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি বাংলাদেশের জমিদার বাড়িগুলির মধ্যে খুবই সুপরিচিত এবং বেশ বড় একটি জমিদার বাড়ি। পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি সম্পর্কে একটি লেখা আমি পোস্ট করেছিলাম সামুতে।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে কলকাতা থেকে রামকৃষ্ণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

একদিন সবকিছু হারিয়ে যাবে

লিখেছেন সামিয়া, ১৫ ই অক্টোবর, ২০২৪ বিকাল ৩:৩১



একদিন সবকিছু ফিকে হয়ে যাবে,
সময়ের সাথে হারিয়ে যাবে স্মৃতি।
মনে থাকবে না ঠিক ঠাক কি রকম ছিল
আমাদের আলাদা পথচলা,
হোঁচট খাওয়া।
মনে থাকবে না
কাছে পাওয়ার আকুতি।
যাতনার যে ভার বয়ে বেড়িয়েছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে না'ফেরা অবধি দেশ মিলিটারীর অধীনে থাকবে।

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৫ ই অক্টোবর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৯



একমাত্র আওয়ামী লীগ ব্যতিত, বাকী দলগুলো ক্যন্টনমেন্টে জন্মনেয়া, কিংবা মিলিটারী-বান্ধব।

আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ অনেকটা সমর্থক শব্দ ছিলো: বাংলাদেশ ব্যতিত আওয়ামী লীগের প্রয়োজন নেই, আওয়ামী লীগ ব্যতিত বাংলাদেশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×