- এটা কী হলো সালাউদ্দিন ভাই! অফিস ট্রেনিংয়ে আমাদের গ্রুপের সবার নাম আছে, শুধু আমি বাদ! কিন্তু আমি তো ওদের অনেকের চাইতে বেশি কাজ করেছি...
কথা শেষ না করে ফাহিম আহত দৃষ্টিতে সালাউদ্দিন ভাইয়ের দিকে চেয়ে রইল।
- ভেরি স্যরি ফাহিম, ভুল করে তোমার নাম বাদ পড়ে গেছে! কিন্তু তুমি তো ভাই স্পেশাল, তাই তোমার জন্য আমার বিশেষ প্ল্যান আছে... এই ট্রেনিং নিয়ে ভাবছো কেন? এটা তো শুধু অফিসের ট্রেনিং, আসল ট্রেনিং কোরিয়ায়, হা হা! সেটার জন্য তুমি মোটামুটি সিলেক্টেড হয়েই গেছ।
সালাউদ্দিন ভাই বললেন। বরাবরের মতোই মুখে আন্তরিক হাসি।
নিজেকে স্বান্তনা দিল ফাহিম, অফিস ট্রেনিংয়ে ওর নাম নাই তার কারণ হতেই পারে সালাউদ্দিন ভাই ভুলে গেছিলেন। সালাউদ্দিন ভাই যে ওকে স্পেশাল বললেন, আসলেই সে স্পেশাল। কারণ এই সফটওয়্যার কোম্পানিতে তাদের টিমের সকলেই কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার, একমাত্র সেই গনিতের ছাত্র। অথচ নিজের আগ্রহ আর অধ্যবসায় দিয়ে সে কোডিংয়ে এতটাই দক্ষতা অর্জন করেছে যে, তাদের টিমের প্রজেক্টের বেশিরভাগ কাজই সে করে!
একমাস পর দেখা গেল কোরিয়া ট্রেনিংয়ের জন্য দু'জন নির্বাচিত হয়েছে, তার মধ্যে ফাহিম নেই। ফাহিমের বন্ধু ইকবাল বলল,
- সালাউদ্দিন ভাইয়ের রেকমান্ডেশন অনুযায়ী আমাদের গ্রুপ থেকে কোরিয়ায় ট্রেনিংয়ের জন্য নির্বাচন করা হয়। বোঝা যাচ্ছে উনি তোকে রেকমান্ড করেননি।
- কিন্তু কেন!! আমি এত কষ্ট করলাম, প্রজেক্টের কাজ সবচেয়ে বেশি আমিই করেছি, পারফরম্যান্স ওয়াইজ তো আমারই হবার কথা...
ফাহিম বুঝতে পারছে না, টিম লিডার সালাউদ্দিন ভাইয়ের হাসিমুখের পেছনে কি ফাহিমের প্রতি প্রচন্ড বিদ্বেষ লুকিয়ে আছে কিনা!!! এমন আচরণের কারণটা ধরতে না পেরে ধীরে ধীরে সে মনমরা হয়ে যেতে লাগলো। নতুন আরেকটা প্রজেক্ট শুরু হয়েছে, কিন্তু ফাহিম কাজ করার উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে, এই চাকরিতেই উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে!!
পরের মাসে সবার বেতনের সাথে সদ্য সমাপ্ত প্রজেক্টের জন্য বোনাস যোগ হলো। প্রজেক্টের কাজে পারফরম্যান্স অনুযায়ী বোনাস নির্ধারিত হয়, বেতনের শতকরা দশ, বিশ অথবা ত্রিশ হারে।
দেখা গেল দুজন বোনাস পেয়েছে বেতনের শতকরা ত্রিশ ভাগ হারে, বেশিরভাগই শতকরা বিশ আর ফাহিম আর আরেকজন শতকরা দশ। এই আরেকজন অফিসে প্রতিদিন দেরি করে আসে, প্রজেক্টের কাজ তেমন কিছুই করেনি, অথচ সবচেয়ে বেশি কাজ করা ফাহিমকে এর সমান হিসেবে মূল্যায়ন করা হলো!
সেদিন লাঞ্চে ফাহিমের প্রিয় ইটালিয়ান খাবার ছিল, কিন্তু ফাহিম লাঞ্চে গেল না। বসে উথালপাথাল ভাবলো, যা তার প্রাপ্য তা কেন তাকে দেয়া হচ্ছে না... অনেক ভেবেও এ প্রশ্নের উত্তর পেল না! লাঞ্চ থেকে ফিরে সবাই ওকে জিজ্ঞেস করলো কেন লাঞ্চে যায়নি। সালাউদ্দিন ভাই চিন্তিত মুখে বললেন,
- তোমার কি শরীর খারাপ ফাহিম? লাঞ্চে যাওনি কেন?
ফাহিম উত্তর দিল না, তাকালোও না; কোন কাজ না করেই কম্পিউটারের সামনে বসে রইল ছুটির সময় হওয়া পর্যন্ত। পঁচিশ বছরের একটা যুবকের এমন অভিমানী হওয়া মানায় না, কিন্তু দুঃখ আর অভিমান একটা ভারী পাথরের মতো সারাদিন এমনভাবে ফাহিমের বুকে জমে থাকলো যে, ওটা সে সরাতেই পারলো না!
অফিস থেকে বের হবার সময় ইকবাল সঙ্গী হলো, পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বলল,
- বসুন্ধরার ফুড কোর্টে যাই চল্। আজকে তো লাঞ্চ করিস নি!
একটা ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের টুকরায় সস লাগিয়ে ফাহিম আনমনে উপর প্লেটের উপর আঁকিবুকি কাটছিল। ইকবাল বার্গার চিবাতে চিবাতে বলল,
- খাওয়া বাদ দিয়ে কি ভাবছিস?
- ভাবছি আমার দোষটা কোথায়! কেন সালাউদ্দিন ভাই আমাকে পছন্দ করেন না!
- দোষ তোর না! এটা সালাউদ্দিন ভাইয়ের সমস্যা। আমি আজ সারাদিন এ নিয়ে ভাবছিলাম, হঠাৎ মনে পড়ল সালাউদ্দিন ভাই একদিন বলছিলেন, আমাদের গ্রুপে গণিতের একজন থাকায় ইউনিফর্মিটি নষ্ট হয়ে গেছে!
- গণিতের হলে সমস্যা কোথায়! আমি তো কঠিন কোডিং টেস্ট উৎরে তারপর এডভান্সড লেভেল প্রোগ্রামার হিসেবে এখানে চাকরি পেয়েছি। অনেক সিএসইর ছাত্রও এই কোডিং টেস্ট পাশ করতে পারেনি!!
- হয়তো সেটাই সমস্যা! হয়তো এজন্যই সালাউদ্দিন ভাই তোকে পছন্দ করেন না!
- আমার দোষটা কোথায়?
- দোষ কোথাও নেই। ব্যাপারটা হলো, একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে যেমন বিশেষভাবে পছন্দ করতে পারে, তেমনি বিশেষভাবে অপছন্দও করতে পারে, এই পছন্দ- অপছন্দের পেছনে কোন যুক্তি কাজ করে না। যেমন ট্রাম্প, সে মনে করে তার মতো সাদা চামড়ার মানুষেরাই সেরা... যেমন হিটলার, সে মনে করে ইহুদিরা অতি নিকৃষ্ট। তেমনি সালাউদ্দিন ভাইও...
কথাটা শেষ না করেই চুপ করে গেল ইকবাল।
ছবি সূত্র: https://bn.crazypng.com/118.html
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৩ দুপুর ১২:৩৮