ফেসবুকে কয়েক লাইনের যে পোস্ট দিয়ে ঝড় বইয়ে দিলেন তানজিম হাসান সাকিব, আমি অন্তর্জাল খুঁজে বের করলাম সেই পোস্টে তানজিম কী লিখেছিলেন। কথাগুলো এই:
'স্ত্রী চাকরি করলে স্বামীর হক আদায় হয় না, স্ত্রী চাকরি করলে সন্তানের হক আদায় হয় না, স্ত্রী চাকরি করলে তার কমনীয়তা নষ্ট হয়, স্ত্রী চাকরি করলে পরিবার ধ্বংস হয়, স্ত্রী চাকরি করলে পর্দা নষ্ট হয়, স্ত্রী চাকরি করলে সমাজ নষ্ট হয়।'
'ভার্সিটির ফ্রি মিক্সিং আড্ডায় অভ্যস্ত মেয়েকে বিয়ে করলে আর যাই হোক সন্তানের জন্য একজন লজ্জাশীলা মা দিতে পারবেন না।'
সূত্র: ফেসবুকে নারীদের নিয়ে সাকিবের আপত্তিকর পোস্ট
তানজিমের এই কথাগুলো নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক, অবমাননাকর, নিঃসন্দেহে। কিন্তু এই কথাগুলো বলে সে বাংলাদেশের নারীদের সম্মান আকাশ থেকে নামিয়ে একেবারে পাতালে চাপা দিয়েছে, এমনটা নয়! প্রথমত এদেশে নারীর সম্মান তো কেবল পুরুষের মুখে মুখেই, ভিড়ের বাসে কিংবা ভিড়ের বাজারে যাওয়া প্রতিটি নারীই একথা খুব ভালোভাবে জানে!! মুক্ত চিন্তার ধারক ও বাহক বলে সমাজের উঁচু তলার যে পুরুষের পরিচয়, আদতে তিনি নারী স্বাধীনতার কথা বলে নারীকে কেবল ভোগের সামগ্রী হিসেবেই ব্যবহার করেন। উদাহরণ দিচ্ছি না, দিতে গেলে পোস্ট অনেক বড় হয়ে যাবে।
সামুতে আসি! এখানে যেভাবে অনেকে তানজিমের প্রতি নিন্দা জানাচ্ছেন, শাস্তি দাবী করছেন, তাতে মনে হচ্ছে যেন আমাদের সকল ব্লগারেরা নারীদের প্রতি খুব সম্মানের ভাব পোষন করেন, সংসারে তাদের সমানাধিকার দেন, নারীদের খুব তাজিম (সম্মান) করেন, ইত্যাদি! এটা বড় ভন্ডামি!! যারা এখন তানজিম ইস্যুতে সোচ্চার হয়ে হয়েছেন, তাদের কেউ কেউ মনে করেন নারী কেবলমাত্র সন্তান জন্ম দানের মেশিন, ঘর সাজানোর জিনিস (উচ্চ শিক্ষিত মেয়েকে বউ করে এনে তাকে চাকরি করতে না দিয়ে ঘরে বসিয়ে রাখতে চান), নারীদের কোন ইচ্ছা অনিচ্ছার মর্যাদা রক্ষার দরকার নেই!! এমন মনে করা মানুষদের অনেক ব্লগাররাই সমর্থন করেন দেখেছি!! এই দ্বিচারিতা একটু পরে উদাহরণসহ ব্যাখ্যা করছি।
তার আগে বলি, যখন নারীর বিরুদ্ধে সত্যিই খুব বড় অন্যায় করা হয় এরা তখন সেগুলো দেখেও না দেখার ভাব করছেন!! সৌদি দূতাবাসের ধর্ষকের ঘটনা ধরা যাক। উপরে আমি যে ছবি দিয়েছি, তা সৌদিআরবে বাংলাদেশ দূতাবাসে কর্মরত এক ধর্ষক উপসচিবের। ছবি এবং খবরের সূত্র এখানে view this link
আমরা সকলেই জানি, এদেশের অসহায়, অশিক্ষিত, দরিদ্র মেয়েরা সৌদি আরবে গৃহকর্মী পাঠানো হয় বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করার জন্য। সেখানে গৃহের সকল কর্ম করার সাথে সাথে তারা নিয়মিত গৃহকর্তা দ্বারা ধর্ষিত হয়। তাদের কেউ আত্মহত্যা করে, কেউ অজানা কারণে মারা যায় এবং কিছু সংখ্যক পালিয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসে আশ্রয় নিতে সমর্থ হয়। তাদের আশ্রয় দেবার জন্য দূতাবাসে সেফ হোম আছে, তারা সেখানে থাকতে পারে যতদিন দেশে ফেরার ব্যবস্থা না হয়। এমন কিছু মেয়ের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ছিল দূতাবাসের মেহেদী নামের এই উপসচিবের উপর। রক্ষক হয়ে গেল ভক্ষক!! মেহেদী আশ্রয় নেয়া এই নির্যাতিত মেয়েগুলোকে ধর্ষণ করে, এবং একসময় তার এই ধর্ষণের ঘটনা জানাজানি হয়। সে যে সত্যি মেয়েগুলোকে ধর্ষণ করেছে এটা প্রমাণিত হয় এবং এর শাস্তিস্বরূপ তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। ধর্ষকের শাস্তি এতটুকুই, শুধুমাত্র চাকুরীচ্যুতি। কোন জেল জরিমানা হয়নি, মৃত্যুদণ্ড তো দূরের কথা!! অথচ ২০২০ সালের নভেম্বরে আইন পাস করে ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান করা হয়। সূত্র এখানে: view this link
লোকটির এ হেন হীন কর্মের বিরুদ্ধে, কিংবা তার শাস্তি না হওয়ায় মুক্ত চিন্তার ধারক বাহকেরা বিন্দুমাত্র বিচলিত হননি, নিন্দার ঝড় তোলা দূরে থাক!! মনে হয় নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ আর অবমাননা হয় কেবল ফেসবুকে পোস্ট দিলে, ধর্ষণ করলে করলে কোনো কিছু হয়না!!
এবার আসি সামুর যে পোস্টটিকে আমার নারীর প্রতি চরম অবমাননাকর মনে হয়েছে, সেই পোস্টের কথায়। সেসময় আমি কেবল পোস্ট পড়তাম, লগইন করতাম না যেহেতু তাই পোস্ট পড়ে খুব রাগ লাগলেও মন্তব্য করা হয়নি। খুব আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম সেই পোস্টে প্রতিবাদী মন্তব্য করেছে একমাত্র মিরোরডডল, বাকিরা তেলতেলে মন্তব্য করে গেছেন পোস্টদাতার সম্মানে!! মিরোরডডলের মন্তব্য মুছে দিয়ে সেই পোস্ট রেখে দিয়েছিলেন পোস্টাদাতা এতদিন, কিন্তু সম্প্রতি পুরো পোস্টটাই মুছে দিয়েছেন তাই লিঙ্ক দিতে পারলাম না। কিন্তু পোস্ট থেকে দুটি স্ক্রিনশট দিলাম।
তানজিম নারীর অবমাননা করলো, আর এই ব্লগার খুব সম্মান করলেন নাকি!!
এই পোস্টের প্রসঙ্গ মিরোরডডল সম্প্রতি এক মন্তব্যে উল্লেখ করেছে। সেই স্ক্রিনশটও দিলাম।
একমাত্র মিরোরডডলই সেই পোস্টকে অবমাননাকর বলে মনে রেখেছে। আমার এই পোস্ট তাই মিরোরডডলের প্রতি admiration জানানোর জন্য, আর সকলের প্রতি অনুরোধ জানানোর জন্য যে, নারীকে সম্মান জানান, মন থেকে।
‘যারে তুমি নিচে ফেল সে তোমারে বাঁধিবে যে নিচে
পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।
অজ্ঞানের অন্ধকারে
আড়ালে ঢাকিছ যারে
তোমার মঙ্গল ঢাকি গড়িছে সে ঘোর ব্যবধান।"
(দুর্ভাগা দেশ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
প্রথম ছবির সূত্র: প্রথম লিঙ্কে দেয়া।