মোহাম্মদপুরের কাচ্চি ভাই। পুরো ভবন কাঁচে ঘেরা।
ভুলে গেলে অনেক ঝামেলা কমে যায়! তাই এই অগ্নিকাণ্ডের কথা আমরা কিছুদিন পর ভুলে যাব, যেমন আগের অনেকগুলো অগ্নিকাণ্ডের এর কথা ভুলে গেছি!
তবে ভুলতে যতক্ষণ লাগবে, সেই সময়ের মধ্যে আমরা নিজেদের বাড়ি, যে সকল মার্কেট হাসপাতালে যাই সেগুলোর অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা পরীক্ষা করে দেখতে পারি, হয়তো কোন দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যেতে পারি! আগে বলে নেই, উন্নত দেশের মতো আমাদের দেশেও ভবন নির্মাণের জন্য অগ্নি নিরাপত্তার বিধান রাখা হয়েছে। রাজধানীর জন্য বিধান দাতা কর্তৃপক্ষ রাজউক; রাজউকের ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী, ছয়তলার বেশি উচ্চতার বাড়ি হাইরাইজ ভবন এবং এমন ভবনে আগুন থেকে নিরাপত্তা দিতে এই জিনিসগুলো করতে হবে:
১) সমস্ত বাড়িতে তাপ নির্ণায়ক, আগুন, ধোঁয়া নির্ণায়ক যন্ত্র বসাতে হবে। যদি কোথাও তাপমাত্রা ৬২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের উপরে উঠে, তাহলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে স্প্রিংকলার চালু করার ব্যবস্থা থাকতে হবে।
২) যথেষ্ট পরিমাণ অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র ফার্স্ট এইড ব্যবস্থা এবং অগ্নি নির্বাপনের দক্ষ কর্মী রাখা অত্যাবশ্যকীয় করা হয়েছে এসব ভবনে।
৩) সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হয়েছে জরুরী নির্গমন ব্যবস্থা বা ফায়ার এক্সিটের ওপর। এটা একটা বিশেষ সিঁড়ি, বিশেষ ভাবে নির্মিত দেয়াল ঘেরা এবং অগ্নি নিরোধক দরজা দেয়া থাকবে। আগুন আর ধোঁয়ামুক্ত থাকার জন্য এই সিঁড়িতে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকবে। বিধিমালার লিঙ্ক: view this link
এই সিঁড়ি ছাড়াও ভবনে বাঁধাহীন ভাবে নেমে যাবার জন্য সাধারণ সিঁড়ি ও লিফট থাকা অত্যাবশ্যক।
এই বিধিমালাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ঢাকার প্রায় সমস্ত ভবন নির্মিত হচ্ছে। এই বিধিমালায় বলা আছে, কোন ভবন নির্মাণের পর ফায়ার সার্ভিসসহ ১১টা দপ্তরের ছাড়পত্র পাওয়ার পর রাজউক অকুপেন্সি সার্টিফিকেট পরীক্ষা দেবে। এটা ছাড়া ভবন ব্যবহার বা বসবাস করা যাবে না। এই বিধিমালা পাশের পরে রাজউক ৪০,০০০ ভবন নির্মাণের অনুমতি দিয়েছে, যেগুলোর মধ্যে মাত্র ১৬২ টি ভবনের অকুপেন্সি সার্টিফিকেট আছে!! বাকিরা অকুপেন্সি সার্টিফিকেট ছাড়াই ভবন ব্যবহার করছেন, অর্থাৎ বাসিন্দাদের ঝুঁকির মধ্যে ফেলছেন, এবং মাঝে মাঝে অগ্নিকাণ্ড ঘটছে। view this link
অগ্নিকাণ্ডের পর গতকাল রাজউক জানিয়েছে, বেইলি রোডের ভবনটিতে রেস্তোরাঁ করার অনুমতি ছিল না। view this link তাহলে এতদিন ধরে এতগুলো রেস্তোরাঁ এখানে ব্যবসা করছে কি করে? এগুলো দেখা কার দায়িত্ব? বেইলি রোডের প্রায় সমস্ত বহুতল ভবনে নানারকম রেস্তোরাঁ চলছে। এগুলো করার কি অনুমতি আছে? সাতমসজিদ রোডের যে অসংখ্য বহুতল ভবনের প্রতি তলায় রেস্তোরাঁ, সেগুলোর কি অনুমতি আছে? এগুলো কি ঝুঁকিহীন?
কর্তৃপক্ষ জানে এগুলো ঝুঁকিপূর্ণ। ঝুঁকিপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও ভালোভাবে ব্যবসা করতে পারছে কারণ কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষ অর্থের বিনিময়ে এদের ব্যবসা করতে সহায়তা করছে। কারণ যখন দুর্ঘটনা ঘটে, তখন এদের কোনো শাস্তি হয় না, এরা পার পেয়ে যায়। যেমন ২০১৯ সালের ২৮ মার্চ বনানীর এফ আর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডে ২৬ জন মারা যাবার পর পূর্ত মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেছিলেন,
"আপাত অবস্থায় আমার নিকট প্রতীয়মান হয়েছে যে, দায়িত্ব অবহেলার কারণে এই মানুষগুলির জীবন গিয়েছে। কারও দায়িত্বের অবহেলার কারণে যদি কোনো মানুষের মৃত্যু হয়, সেটাকে দায়িত্বে অবহেলাজনিত কারণে হত্যাকান্ড হিসেবে গন্য করার সুযোগ রয়েছে। আমরা প্রাথমিক অনুসন্ধানের পরই আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।"
কেবল প্রাথমিক না, বিস্তারিত অনুসন্ধানের পর দেখা গেল এফ আর টাওয়ারে ১৮ তলা ভবনের প্ল্যান পাস করিয়ে ২৩ তলা ভবন নির্মাণ করা হয় অবৈধভাবে, কাজটা করেছেন নির্মাতা রূপায়ণ এবং জমির মালিক। view this link এই ভবনে কোন অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না। অথচ এই ভবনের মালিক, নির্মাতা এবং রাজউকের যে ৫১ জন কর্মকর্তা নিরাপত্তাহীন এই ভবন ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছিলেন তাদের উপর কিন্তু অবহেলা জনিত হত্যাকান্ডের দায় চাপে নি। এই ভবনের নির্মাতা রূপায়ণের মালিক লিয়াকত মাত্র ২০,০০০ টাকা মুচলেকা দিয়ে জামিন নেবার পর তার উপর কোন দায় আসেনি!! এফ আর টাওয়ার কান্ডে মালিক বা নির্মাতা কেউ গুরুদন্ড পেয়েছে বলে খবর আসেনি।
বেইলি রোডের অগ্নি কান্ডের জন্য একতলার চায়ের দোকানদার সহ তিনজনকে ধরা হয়েছে!!! অথচ বিল্ডিং কোডকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ভবন নির্মাণ করে, অফিস হিসেবে ব্যবহারের অনুমতি নিয়ে বেশি ভাড়া পাবার জন্য রেস্তোরাঁ হিসেবে ভাড়া দিলেন যারা তাদের ধরা দূরে থাক, নামটাও আসে নি!!
ঢাকার অধিকাংশ বাড়ির যেভাবে এমন ভাবে বানানো হয় যে তাতে অগ্নিকাণ্ড ঘটলে অতি বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। বানিজ্যিক ভবন গুলো বানানো হয় অতি লাভজনক হিসেবে; বিম, কলাম, আর ছাদ ঢালাই করে কাঁচ দিয়ে ঢেকে দেন নির্মাতা আর যিনি ফ্লোর স্পেস কেনেন তিনি সেই ফ্লোরে পছন্দ অনুযায়ী ঘর তৈরি করেন, নানারকম বোর্ড আর কাঠ দিয়ে। এগুলো খুবই দাহ্য পদার্থ, তাই যখন এমন ভবনে আগুন লাগে তখন খুব তাড়াতাড়ি আগুন ছড়িয়ে যায়, কাঁচ বদ্ধ জায়গা থেকে ধোঁয়া বের হতে পারে না... হয়ে ওঠে মৃত্যু কূপ!
আবাসিক ভবনগুলোও অধিকাংশ অনিরাপদ। রাজধানীবাসী অনেকের মত আমিও একটা অনিরাপদ বাসায় থাকি। এ বাসায় ইমারত নির্মাণ বিধিমেলার কিছুই মানা হয়নি। আমি থাকি নয়তলায় এক ফ্ল্যাটে। এই বাড়ির সবতলায় অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র আছে, বেশিরভাগই ডেট এক্সপায়ার্ড। তাছাড়া আমরা বাসিন্দারা কেউ জানি না কি করে এগুলো ব্যবহার করতে হয়। জরুরী নির্গমন সিঁড়ি বলে একটা সিঁড়ি আছে, (বিল্ডিং কোড মানার কথা বলে বানানো হয়েছে) সেটা এত সরু যে দুজন মানুষ পাশাপাশি নামতে পারবে না, এটাতে ফায়ার ডোর বা ফায়ার ওয়াল নেই বরং সিঁড়িতে বিভিন্ন ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা অদরকারী আসবাবপত্র জমা রাখেন। যদি আগুন লাগে, দাহ্য পদার্থ দিয়ে ভরা এই সরু সিঁড়ি জ্বলতে থাকবে, নামা যাবে না। আরেকটা যে বড় সিঁড়ি আছে, সেটা দিয়ে নামারও উপায় থাকবে না; সেটাও তখন হয়ে যাবে গনগনে চিমনি! কারণ ধোঁয়ায় থাকা বিষাক্ত কার্বন মনোক্সাইড, কার্বন ডাই অক্সাইড, আর জলীয়বাষ্প বাতাসের চেয়ে হালকা হওয়ায় সবসময় খোলা সিঁড়ি পথে উপরে উঠতে থাকে! (এজন্যই দমকল বাহিনীর মতে, আগুনে পোড়ার চাইতে বেশি মৃত্যু হয় ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে।) এই অবস্থায় যদি সিঁড়ি দিয়ে নামতে না পারি, ঘরে বসে থাকি আর দমকলের মই আমার বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছায়, তবু বের হতে পারবো না কারণ বারান্দা আর জানালা খাঁচায় ঘেরা!
মোহাম্মদপুরের জাপান গার্ডেন সিটির আগুনের কথা মনে পড়ছে। একজন এগারো তলায় ইন্টেরিয়র ডেকরেশন করাচ্ছিলেন। কাঠমিস্ত্রি কাজ করতে করতে সিগারেট না নিভিয়ে ফেলে গিয়েছিল, সেটা থেকে ফ্ল্যাটে আগুন ধরে। চৌদ্দ তলার এক পরিবার আগুন দেখে ভয় পেয়ে ছাদে উঠতে গিয়ে দেখে ছাদে তালা। তারপর কার্বন মনোঅক্সাইডের বিষে তারা পুরো পরিবার সিঁড়িতেই মারা যায়।
মার্কেটেও অগ্নিকাণ্ড হয়। বসুন্ধরা সিটি মার্কেটে অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা না থাকায় ২০০৯ সালে সাতজন অগ্নিকাণ্ডে নিহত হন।
হাসপাতালেও আগুন ধরার অনেক ঘটনা আছে। ২০১৯ এ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে আগুন ধরে। অভিজাত ইউনাইটেড হাসপাতালে ২০২০ সালে অগ্নিকান্ডে পাঁচজন রোগী মারা যান।
তাই হাসপাতালে গেলে আমি জরুরি নির্গমন সিঁড়ি খুঁজতে থাকি। খুব কম হাসপাতালে এমন সিঁড়ি পেয়েছি। S আদ্যোক্ষরযুক্ত একটি হাসপাতালে এই সিঁড়ি ঠিকঠাক পেয়েছি, মেঝেতে পায়ের চিহ্ন এঁকে সিঁড়ির কাছে পৌঁছে দেয়া হয়েছে, সিঁড়িও ঠিকমতো বানানো। কিন্তু BS আদ্যোক্ষরযুক্ত আরেকটা হাসপাতালে জরুরী নির্গমন সিঁড়ি দেখলাম ফায়ার ডোর আর ফায়ার ওয়াল যুক্ত, সেই সিঁড়ি ধরে নামতে নামতে এসে পৌঁছালাম বেসমেন্টের ক্যাফেটেরিয়ায়, সেখানে সিলিন্ডারের গ্যাসে রান্না হচ্ছে!!
আগারগাঁওয়ের নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে জরুরী নির্গমন সিঁড়ি খুঁজতে গিয়ে দেখলাম প্রতি তলায় বুক সমান উঁচু দেয়াল ঘেরা একটা ফাঁকা জায়গা, দেয়ালে অনেক গুলো ফায়ার এক্সটিংগুইশার লাগানো। বুঝলাম এখানে জরুরী নির্গমন সিঁড়ি হবার কথা ছিল, তা না হয়ে টাকা হয়ে কারো একাউন্টে চলে গেছে।
যারা এতদূর পর্যন্ত পড়েছেন, তাদের কাছে অনুরোধ থাকলো যে বাড়িতে, বেড়াতে কিংবা হাসপাতালে গেলে অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা কেমন আছে তা লক্ষ্য করবেন। না থাকলেও কিছু করার নেই, যেমন আমি নিজে অনিরাপদ বাড়িতে থাকি...
আরেকটা জিনিস, যদি আপনার বাড়ির গ্রাউন্ড ফ্লোরে সারি দিয়ে গ্যাস সিলিন্ডার রাখা থাকে তবে চেক করে নেবেন এগুলো কতটুকু নিরাপদ। অনেক সময় রাস্তায় চলতে গিয়েও দেখা যায় অনেক রেস্তোরাঁ ফুটপাতের উপর সিলিন্ডার রেখেছে। এটা বিপজ্জনক।মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডের কাচ্চি ভাই রেস্তোরাঁ তিনতলায়, সরু সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হয়। এরা গ্যাস সিলিন্ডার সব সারি দিয়ে রেখেছে ভবনের বাইরে, পাশের বাড়ির সীমানা ঘেঁষে। এই ভবনের মালিক এবং রেষ্টুরান্ট মালিককে বারংবার বলা সত্ত্বেও তারা সিলিন্ডার সরাচ্ছে না।
যেহেতু এইসব অনিয়ম দেখার জন্য কোনো কর্তৃপক্ষ নেই, কোথাও থেকে প্রতিকার পাবার উপায় নেই, তাই আমাদের নিজেদের সুরক্ষার কথা নিজেদের ভাবতে হবে। অন্তত নিজের বাড়িতে আগুন লাগলে বেরোবার পথ আছে কিনা সেটা দেখতে হবে।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:০০