
জুলাই অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশকে সঠিক ভাবে পরিচালনার জন্য গঠিত হয় অন্তবর্তীকালীন সরকার। এই সরকারের প্রধান হন ড. ইউনূস।জনগণের নিরঙ্কুশ সাপোর্ট ছিলো এই সরকারের প্রতি। কিন্তু তিনমাস অতিবাহিত হওয়ার পর সাধারণ জনগণের মধ্যে হতাশা দেখা দেয়। দেশের আইনশৃংখলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার দক্ষতার পরিচয় দিতে ব্যর্থ হয়। এছাড়া ঢাকা সহ বিভিন্ন জেলায় মারামারি, মাজার ভাঙা সহ অনেক অস্থিতিশীল কর্মকান্ড জনগণের মধ্যে প্যানিক সৃষ্টি করে। বর্তমান সরকারের প্রধান শক্তিগুলোর মধ্যে নানা ধরণের ইস্যু নিয়ে এক ধরণের বিভেদ দেখা যায়। অন্যদিকে প্রতিবেশি দেশ ভারতে বসে শেখ হাসিনার উসকানি মূলক কথাবার্তা সরকার কে অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। এত সব ঘটনার প্রেক্ষিতে ড. ইউনূস ছাত্র-জনতা, রাজনৈতিক দল ও ধর্মীয় ব্যক্তিদের একত্রিত করে জাতীয় ঐক্যের ডাক দেন।জাতীয় ঐক্যের ডাকে দেশের সর্বস্তরের জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করা সরকারের পক্ষে সম্ভব হয়নি। রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে যে ঐক্যের ডাক দিয়েছিলেন ইউনূস সাব তার মধ্যে ১৬/১৭ টা দল উপস্থিত ছিলো। আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি সহ ১৪ দলকে বাদ দিলেও দেশে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল বাকি থাকে ১৩/১৪ টি। রাজনৈতিক দল এলডিপির অলি সাহেব কে আমন্ত্রণ জানানো হলেও পরে ড. ইউনূস সাহেবের সাথে দেখা না করে ফেরত চলে যান। রাজনৈতিক অঙ্গনে এই ধরণের ঘটনা নিয়ে আলোচনা সমালোচনা চলছে।
ড. ইউনূস সাহেব ছাত্র সংগঠন গুলোকে নিয়ে ঐক্যের ডাক দিলেও মাত্র দুইটি সংগঠন উনার সাথে আলোচনায় বসার সুযোগ পায়। তারা হলো নাগরিক কমিটি ও বৈষম্য বিরোধী ছাত্রসংগঠন। ছাত্রদল, ছাত্রশিবির সহ বামপন্থী ছাত্র সংগঠন গুলো ড. ইউনূসের সাথে আলোচনায় বসেনি। এতে ছাত্রসংগঠন গুলোর মধ্যে ঐক্যের বদলে বিভেদ সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ড. ইউনূসের সরকার বরাবর বৈষম্য বিরোধী ছাত্র সংগঠন কে তাদের সরকারের প্রধান চালিকাশক্তি হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে আসছেন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে তাদের অবদান কে বড়ো করে দেখাতে গিয়ে বাকি ছাত্র সংগঠন গুলোর অবদান কে ছোট করে দেখানো হয়েছে। আওয়ামী লীগের পর প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির অবদান কে ছোট করে দেখানো হয়েছে। দেশের মধ্যে এক শ্রেণী রয়েছেন যারা মনে করেন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র সংগঠনের ডাকে ছাত্র-জনতা রাস্তায় নেমে এসে স্বৈরশাসকের পতন ঘটিয়েছে। কিন্তু খোদ সমন্বয়কদের কথায় এই অভ্যুত্থানের প্লান আরো দশ বছর আগে থেকে করা হয়েছে বলে বোঝা যায়। হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন শক্তি অনেক আগে থেকেই সক্রিয় ছিলো। ২০২৪ সালের পহেলা জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সংগঠন আত্নপ্রকাশ করে। মাত্র একমাসের চেষ্টায় শেখ হাসিনার মতো স্বৈরাচার সরকারের পতন ঘটানো ছিলো প্রায় অসম্ভব ব্যপার। জুলাই অভ্যুত্থানের পিছনে যার ভূমিকা সবচেয়ে বেশি ছিল তারা হলেন দেশের সেনাবাহিনী! চীনে ১৯৮৯ সালে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে অসংখ্য ছাত্র-জনতা গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেলেও অভ্যুত্থান সফল হয় নি কারণ সেনাবাহিনীর ছাত্র-জনতার প্রতি সমর্থন ছিলো না। বাংলাদেশের অভ্যুত্থান সফল হয়েছে কারণ সেনাবাহিনী শেখ হাসিনার সরকারের উপর থেকে তাদের সমর্থন উঠিয়ে নিয়েছিল।
সরকার শুরু থেকেই ৫ই আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনকে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান বলে জনগণের সামনে উপস্থাপন করার চেষ্টা চালিয়ে গেলেও আদৌতে এই ঘটনাকে সেনা অভ্যুত্থান বলাই ন্যায়সংগত । সেনাবাহিনীর ভূমিকা কে আড়ালে রাখার জন্য বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সংগঠনের কতিপয় নেতাকে সবার সামনে মাস্টারমাইন্ড বলে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। এতে সরকারের অন্যান্য সহায়ক শক্তিগুলোর মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। মূলত জাতীয় ঐক্যের ডাক দেয়ার প্রধান কারণ ছিলো জাতীয় সরকার গঠন! কিন্তু সেখানে বাগড়া দেয় বিএনপি। বিএনপির হাইকমান্ড থেকে এই ধরণের প্রস্তাবে নেগেটিভ রেস্পন্স সরকারের কাছে পৌছায়। বিএনপির নেতা তারেক রহমানের সাম্প্রতিক সময়ের বক্তব্য শুনলে তা স্পষ্ট হয়ে উঠে। তারেক জিয়া তার বক্তব্যে বলেছেন, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে সবাইকে নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করবে। এই বক্তব্য থেকে বোঝা যায় বিএনপি জাতীয় সরকারের অংশ হতে রাজি নয়। অন্যদিকে জামাতের আমীর জাতীয় ঐক্যের ডাকের সম্মেলন শেষে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, দুই-একদিনের মধ্যে দেশবাসী সুসংবাদ পেতে যাচ্ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা জামাতের আমীরের কথার দুইটি ব্যাখ্যা দাঁড় করান। প্রথমটি হলো দ্রুত নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা দেয়া হতে পারে। দ্বিতীয় টি হলো জাতীয় সরকার গঠিত হতে যাচ্ছে। কিন্তু জামাতের আমীর কি সুসংবাদ জানাতে চেয়েছিলেন তা সম্মেলনের পাঁচদিন পরও জানা গেল না।
ড. ইউনূসের সরকার বিদেশি বিনিয়োগ নিয়েও স্বস্তিতে নেই। ক্ষমতা গ্রহণের চার মাস পেরিয়ে গেলেও আশানুরূপ ঋণ পাওয়া গিয়েছে কিনা তা বোঝা যাচ্ছে না। তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ অনুসন্ধানের জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র আহবান করা হলেও ২০১৬ সালের পর এইবার প্রথম বিদেশি কোন কোম্পানি আগ্রহ দেখায় নি। এর পিছনে রাজনৈতিক সংকট রয়েছে। দেশ বাসীর আকুন্ঠ সমর্থন থাকলেও সাংবিধানিক ভাবে ড. ইউনূসের সরকার বৈধ নয়। বিভিন্ন দেশের বিনিয়োগ কারীরা নির্বাচিত সরকারের সাথে চুক্তি করতে বেশি নিরাপদ অনুভব করে। অনির্বাচিত সরকারের সাথে করা এগ্রিমেন্ট নির্বাচিত সরকারের সময় বাতিল হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়। ডিসেম্বর মাসে সংস্কারের গতি পর্যালোচনা করে অতিদ্রুত নির্বাচনের ব্যবস্থা করাই অন্তবর্তীকালীন সরকারের জন্য শ্রেয় হবে। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলে যেটুকু ঐক্য সরকারের অংশীদারদের মধ্যে রয়েছে তাও ভেঙে পড়তে পারে। তাই সবার সমর্থন থাকাকালীন একটি সুন্দর নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে পারলে অন্তবর্তীকালীন সরকার কে জাতির ক্রান্তিলগ্নে সঠিক পদক্ষেপ নেয়ার জন্য সবাই দীর্ঘদিন মনে রাখবে।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই ডিসেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৩৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



