somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কামাল আতাতুর্ক: ইতিহাসের মহান সংস্কারক, যার মতো নেতা আজ বাংলাদেশে দরকার !

১২ ই মার্চ, ২০২৫ রাত ১০:৩৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


কিছু মানুষ থাকেন, যারা কেবল ইতিহাসের অংশ নন—বরং ইতিহাস গড়ে দেন। কামাল আতাতুর্ক তেমনই একজন নেতা, যিনি শুধু তুরস্ককে নয়, গোটা বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছিলেন, কীভাবে একটি পশ্চাৎপদ, ধর্মান্ধ রাষ্ট্রকে আধুনিক, প্রগতিশীল ও শক্তিশালী দেশে পরিণত করা যায়। উসমানীয় সাম্রাজ্যের পতনের পর যখন তুরস্ক দিশেহারা, যখন খিলাফতের নামে ধর্মীয় কূপমণ্ডূকতা পুরো সমাজকে পেছনের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন এই মানুষটি একাই সামনে দাঁড়িয়ে দেশকে বদলে দিয়েছিলেন।

১৮৮১ সালের ১২ই মার্চ জন্ম নেওয়া কামাল আতাতুর্ক ছিলেন উসমানীয় সাম্রাজ্যের এক সামরিক কর্মকর্তা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি গ্যালিপোলির যুদ্ধে অসাধারণ নেতৃত্ব দেখান, কিন্তু পরে উপলব্ধি করেন—উসমানীয় সাম্রাজ্যের পতন আসন্ন এবং এটি বাঁচানোর কোনো উপায় নেই। তিনি নতুন করে ভাবতে শুরু করেন, কীভাবে ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে একটি আধুনিক রাষ্ট্র গড়ে তোলা যায়।

কীভাবে কামাল আতার্তুক তুরস্ককে বদলে দিলেন ?

খিলাফত ব্যবস্থা বিলুপ্ত করা: উসমানীয় সাম্রাজ্যের শাসন ছিল পুরোপুরি ইসলামি শরিয়াহ ও খলিফার নির্দেশ অনুযায়ী পরিচালিত। কিন্তু আতাতুর্ক বুঝতে পারলেন, ধর্ম যখন রাষ্ট্রের সঙ্গে মিশে যায়, তখন জনগণের চিন্তাভাবনার স্বাধীনতা নষ্ট হয়ে যায়। তাই ১৯২৪ সালে তিনি খিলাফত ব্যবস্থা বাতিল করলেন এবং ঘোষণা করলেন—তুরস্ক আর ধর্মীয় রাষ্ট্র থাকবে না, এটি হবে একটি আধুনিক, ধর্মনিরপেক্ষ জাতি-রাষ্ট্র।

ধর্মীয় শাসনের অবসান ও আইন সংস্কার: তুরস্কের বিচারব্যবস্থা তখন ছিল পুরোপুরি ইসলামি শরিয়াহ আইনের উপর ভিত্তি করে। আতাতুর্ক এটি পুরোপুরি পরিবর্তন করে পশ্চিমা আইন চালু করলেন , যাতে সব ধর্মের মানুষ সমান অধিকার পায় এবং আইন বিজ্ঞানভিত্তিক হয়। ধর্মীয় আদালতগুলো তুলে দিয়ে তিনি সিভিল কোর্ট চালু করলেন।

ধর্মীয় গোঁড়াদের কঠোর হাতে দমন: আতাতুর্ক জানতেন, ধর্মীয় গোঁড়ারা কখনোই সংস্কার মেনে নেবে না। তারা সমাজকে ধর্মের নামে পিছিয়ে রাখতে চায়। তাই তিনি কঠোর ব্যবস্থা নিলেন—যে সমস্ত ধর্মীয় সংগঠন রাজনীতি ও আইন ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করছিল, তাদের নিষিদ্ধ করলেন। যারা ষড়যন্ত্র করেছিল, তাদের নির্মূল করলেন। এভাবে তিনি তুরস্ককে "ধর্মীয় গোঁড়ামির হাত থেকে মুক্ত করলেন" ।

শিক্ষা ও ভাষার আধুনিকীকরণ: শিক্ষার ক্ষেত্রে তিনি সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আনলেন। তুরস্কের ভাষা তখন আরবি হরফে লেখা হতো, যা সাধারণ মানুষের জন্য শেখা কঠিন ছিল। আতাতুর্ক "আরবি হরফ বাদ দিয়ে ল্যাটিন হরফ চালু করলেন" এবং শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে ধর্মীয় শিক্ষাকে সরিয়ে দিলেন। তিনি ঘোষণা করলেন, "একটি জাতির সবচেয়ে বড় শত্রু হলো অজ্ঞতা।" তাই ধর্মভিত্তিক শিক্ষার বদলে তিনি বিজ্ঞান, গণিত, ইতিহাস ও প্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করলেন।

নারীর স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ: তুরস্কের নারীরা তখন অবরুদ্ধ ছিল। আতাতুর্ক ঘোষণা করলেন—নারীরাও পুরুষের সমান। তিনি তাদের ভোটাধিকার দিলেন, শিক্ষা ও চাকরির সুযোগ নিশ্চিত করলেন, এবং বিয়ের ক্ষেত্রে শরিয়াহ আইন তুলে দিয়ে "একটি আধুনিক পারিবারিক আইন চালু করলেন" , যাতে নারীরা বিয়ে, তালাক ও সম্পত্তির বিষয়ে সমান অধিকার পায়।

ধর্মীয় পোশাক সংস্কার : তুরস্কে ধর্মীয় পোশাক বাধ্যতামূলক ছিল—পুরুষদের ফেজ টুপি পরতে হতো, নারীদের পর্দার আড়ালে থাকতে হতো। আতাতুর্ক এসব তুলে দিলেন। তিনি ইউরোপীয় পোশাক পরা বাধ্যতামূলক করলেন, যাতে মানুষ নিজেদের আধুনিক মনে করে এবং সমাজ থেকে ধর্মীয় পরিচয়কে সরিয়ে ফেলে।

বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে আতাতুর্কের শিক্ষা কেন জরুরি ?

ধর্মনিরপেক্ষতার পুনঃপ্রতিষ্ঠা : বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ছিল, কিন্তু পরবর্তীতে কিছু রাজনৈতিক দল এটিকে দুর্বল করে দেয়। আজ দেখা যাচ্ছে, ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করা দলগুলো সমাজে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে, যা আতাতুর্কের যুগের তুরস্কের মতোই বিপজ্জনক।

ধর্মীয় গোঁড়াদের দমন : সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে ধর্মীয় গোঁড়াদের উত্থান বাড়ছে । ধর্মীয় উগ্রপন্থার প্রচার, নারীদের স্বাধীনতার ওপর হুমকি, ভিন্নমত দমন—এসব আতাতুর্কের যুগের তুরস্কের মতোই সংকট সৃষ্টি করছে। আতাতুর্কের মতো একজন দৃঢ় নেতা দরকার, যিনি ধর্মীয় গোঁড়ামিকে বিন্দুমাত্র ছাড় দেবেন না।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা: বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা এখনও অনেক ক্ষেত্রে ধর্মীয় কুসংস্কারে আচ্ছন্ন। এখানে শিক্ষাব্যবস্থায় বিজ্ঞান, গণিত ও প্রযুক্তিকে অগ্রাধিকার দিয়ে একটি একক, আধুনিক ব্যবস্থা চালু করা দরকার।

নারীর ক্ষমতায়ন: আতাতুর্ক যেমন নারীদের সমান অধিকারের সুযোগ দিয়েছিলেন, বাংলাদেশেও নারীর বিরুদ্ধে বৈষম্য, নির্যাতন ও গোঁড়াদের রক্তচক্ষু বন্ধ করতে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া দরকার ।

কেন কামাল আতাতুর্কের মতো নেতা আজ বাংলাদেশে দরকার ?

বাংলাদেশ আজ এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা কি মুক্তচিন্তার একটি আধুনিক দেশ গড়ব, নাকি গোঁড়ামির কাছে হার মানব ? ইতিহাস বলে, মুক্তির একটাই পথ— আতাতুর্কের মতো সংস্কারক ও দূরদর্শী নেতা প্রয়োজন, যিনি ভয় পাবেন না, আপস করবেন না, এবং দেশকে সত্যিকারের প্রগতির পথে নিয়ে যাবেন। আজ আতাতুর্ক নেই, কিন্তু তার শিক্ষা আছে। ইতিহাস আমাদের সামনে একটি স্পষ্ট বার্তা দেয়—যদি আমরা কুসংস্কার এবং ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে না পারি, তবে আমরা পিছিয়ে যাব। কিন্তু যদি আতাতুর্কের পথ অনুসরণ করতে পারি, তবে বাংলাদেশ হতে পারে একটি আধুনিক, মুক্তচিন্তার দেশ, যেখানে প্রতিটি মানুষ সমান, প্রতিটি কণ্ঠ স্বাধীন।

মহান সংস্কারবাদী কামাল আতার্তুকের আজ জন্মদিন। তুরস্ক সহ বিশ্বের সকল গণতন্ত্রমনা মানুষ এই মহান নেতাকে আজকের এইদিনে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই মার্চ, ২০২৫ রাত ১০:৪২
১৬টি মন্তব্য ১৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পেচ্ছাপ করি আপনাদের মূর্খ চেতনায়

লিখেছেন সত্যপথিক শাইয়্যান, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:৩৮

আপনারা হাদি হতে চেয়েছিলেন, অথচ হয়ে গেলেন নিরীহ হিন্দু গার্মেন্টস কর্মীর হত্যাকারী।
আপনারা আবাবিল হয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাড়াতে চেয়েছিলেন, অথচ রাক্ষস হয়ে বিএনপি নেতার ফুটফুটে মেয়েটাকে পুড়িয়ে মারলেন!
আপনারা ভারতীয় আধিপত্যের বিরুদ্ধে... ...বাকিটুকু পড়ুন

নজরুল পরিবারের প্রশ্ন: উগ্রবাদী হাদির কবর নজরুলের পাশে কেন?

লিখেছেন মাথা পাগলা, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৩:০১



প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে কাজী নজরুল ইসলামের দেহ সমাধিস্থ করা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশে। শনিবার বাংলাদেশের স্থানীয় সময় বিকেল ৪টে নাগাদ সেখানেই দাফন করা হল ভারতবিদ্বেষী বলে পরিচিত ইনকিলাব মঞ্চের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির আসল হত্যাকারি জামাত শিবির কেন আলোচনার বাহিরে?

লিখেছেন এ আর ১৫, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:৫৪


গত মাসের শেষের দিকে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পারওয়ারের ছেলে সালমান, উসমান হাদির সঙ্গে খু*নি ফয়সালের পরিচয় করিয়ে দেন। সেই সময় হাদিকে আশ্বস্ত করা হয়—নির্বাচন পরিচালনা ও ক্যাম্পেইনে তারা... ...বাকিটুকু পড়ুন

দিপুকে হত্যা ও পোড়ানো বনাম তৌহিদী জনতা!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:০৫


পাইওনিয়ার নিটওয়্যারস বিডি লিমিটেড (Pioneer Knitwears (BD) Ltd.) হলো বাদশা গ্রুপের (Badsha Group) একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। বাদশা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান কর্ণধার হলেন জনাব বাদশা মিয়া, যিনি একইসাথে এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

সাজানো ভোটে বিএনপিকে সেনাবাহিনী আর আমলারা ক্ষমতায় আনতেছে। ভোট তো কেবল লোক দেখানো আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।

লিখেছেন তানভির জুমার, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:২২



১০০% নিশ্চিত বিএনপি ক্ষমতায় আসছে, এবং আওয়ামী স্টাইলে ক্ষমতা চালাবে। সন্ত্রাসী লীগকে এই বিএনপিই আবার ফিরিয়ে আনবে।সেনাবাহিনী আর আমলাদের সাথে ডিল কমপ্লিট। সহসাই এই দেশে ন্যায়-ইনসাফ ফিরবে না। লুটপাট... ...বাকিটুকু পড়ুন

×