somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিদ্যা যদি অন্তরে ধারণ করা না যায় তবে সেটা কোনো কাজে আসে না।

২৭ শে এপ্রিল, ২০২৫ রাত ১২:২৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ঘটনাটি যেন দুঃস্বপ্নের চেয়েও নির্মম। ধর্মের পথপ্রদর্শক একজন ইমাম, যার কাজ মানুষকে সহনশীলতা, দয়া ও ন্যায়বিচারের শিক্ষা দেওয়া — তিনি নিজেই স্ত্রীর সামান্য বাকবিতণ্ডায় মত্ত হয়ে উঠলেন হত্যার মতো ভয়ঙ্কর অন্যায়ে। রাতের আঁধারে স্ত্রীর নাক-মুখ চেপে মৃত্যুমুখে ঠেলে দিলেন। তারপর মৃতদেহ গোপন করতে গিয়ে সেপটিক ট্যাংকে ফেলে রাখলেন। মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ালেন, তাকওয়া শেখালেন, অথচ নিজের নফসের কাছে পরাজিত হয়ে ইসলামি নৈতিকতার সর্বনাশ করলেন। প্রশ্ন জাগে — কেমন ইমান, কেমন তাকওয়া, কেমন আলেম এই যে স্ত্রীর জীবনের মুল্য বোঝে না ? ধর্মীয় আবরণ কি কেবল বাহ্যিকতা হয়ে রয়ে গেল?

কুরআনে বহুবার স্ত্রীদের সাথে নম্র, সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ্‌ বলেন: "আর তাদের (স্ত্রীদের) সাথে সদ্ভাবে বসবাস করো" - (সূরা আন-নিসা, ৪:১৯) । রাসূল (সা.) স্ত্রীদের সঙ্গে এমন সদয় আচরণ করেছেন যে, তাঁর জীবনই হয়ে উঠেছে নারীর সম্মানের সংবিধান। তিনি ঘোষণা করেছেন: "সবচেয়ে পরিপূর্ণ মুমিন সেই ব্যক্তি, যার চরিত্র সবচেয়ে উত্তম; আর তোমাদের মধ্যে উত্তম সেই ব্যক্তি, যে তার স্ত্রীদের সাথে উত্তম আচরণ করে"- (তিরমিজি, হাদিস ১১৬২)। শুধু তাই নয়, রাসূলুল্লাহ (সা.) স্পষ্ট ভাষায় নারী নির্যাতন নিষিদ্ধ করেছেন: "কেউ যেন স্ত্রীকে দাসীর মতো আঘাত না করে এবং পরে একই বিছানায় তার সাথে না যায়"- (সহীহ বুখারি, ৫২০৪)। অথচ এখানে এক ইমাম ধর্মের এই মৌলিক শিক্ষা ভুলে গিয়ে এমন অপরাধে লিপ্ত হলেন, যা ইমানের মৌলিক দাবিকেই অস্বীকার করে।

রাগ সংযমের ইসলামী আদর্শ: রাগ মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি, তবে ইসলাম মানুষকে শিক্ষা দেয় রাগ দমন করতে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: "শক্তিমান সে ব্যক্তি নয়, যে কুস্তিতে প্রতিপক্ষকে পরাজিত করে, বরং প্রকৃত শক্তিমান সে, যে রাগের সময় নিজের নফসকে সংবরণ করতে পারে"- (সহীহ বুখারী, ৬১১৪)। রাগের সময় উত্তপ্ত হলে রাসূল (সা.) পানি পান করতে, বসে পড়তে, অথবা শুয়ে পড়তে বলেছেন (আবু দাউদ, ৪৭৮৪)। কিন্তু এই ঘটনায় আমরা দেখি — ইমাম মোমিন রাগের মুহূর্তে নিজেকে সংযত করেননি, বরং সেই রাগকে হত্যার বীজে পরিণত করলেন।

নিহত নারীও ছিলেন বয়স্ক ও দুর্বল: বাংলাদেশের বাস্তবতায় ৬৫ বছর বয়সী নারী খুব একটা সুস্থ থাকেন না। নানারকম শারীরিক জটিলতায় আক্রান্ত থাকেন তারা । এই বয়সী নারীদের প্রায়ই বিভিন্ন দীর্ঘস্থায়ী রোগ যেমন উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিস ইত্যাদিতে আক্রান্ত হতে দেখা যায়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ২০২৩ সালের এক জরিপে বলা হয়েছে — ৪৫ বছরের বেশি বয়সী নারীদের মধ্যে প্রায় ৭৩% কোনো না কোনো দীর্ঘস্থায়ী অসুখে ভুগছেন। এমন একজন নারীর পক্ষে সার্বক্ষণিক শাশুড়ির সেবা করা স্বাভাবিকভাবে কষ্টকর — তা শরীরের সীমাবদ্ধতার কারণেই হোক বা বার্ধক্যের কারণে হোক। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, আমাদের সামাজিক কাঠামো নারীর এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করে; নারীর উপর কেবল দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া হয়, তার সামর্থ্য মূল্যায়ন করা হয় না।

স্ত্রীর উপর শাশুড়ির সেবা নিয়ে ফিকহ শাস্ত্র স্পষ্ট করে দিয়েছে — স্ত্রীর উপর তার শ্বশুর বা শাশুড়ির সেবা বাধ্যতামূলক নয়। ইমাম ইবনে আবেদীন (রহ.) হিদায়া শরহে লিখেছেন: "স্ত্রীর দায়িত্ব হলো স্বামীর ব্যক্তিগত প্রয়োজন পূরণ করা; তার আত্মীয়-স্বজনের নয়"-(রদ্দুল মুখতার, ৩/৫৭৪)। ইমাম নববী (রহ.) লিখেছেন: "শাশুড়ি বা শ্বশুরের খেদমত স্ত্রীর উপর ফরজ নয়, যদি না সে ইচ্ছায় তা করতে চায়"- (আল-মাজমু' , ১৬/৪১১)। অতএব, ইসলামে স্ত্রীকে শাশুড়ির খেদমতে বাধ্য করা, এবং তা করতে না পারলে স্ত্রীর প্রতি বৈরিতা দেখানো, মারধর করা — এগুলোর কোনো শরীয়তসম্মত ভিত্তি নেই। এই ইমাম যদি সত্যিকার ইসলাম বুকে ধারণ করতেন, তাহলে তিনি বুঝতেন — যে সেবা স্বেচ্ছায় হয়, সেটাই ইসলাম সম্মত। বলপূর্বক নয়।

বাংলাদেশে নারী হত্যার ভয়াবহ পরিসংখ্যান: বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের রিপোর্ট (২০২৪) বলছে — প্রতি মাসে গড়ে ৫০ জন নারী হত্যা বা সহিংসতার শিকার হন। ধর্মীয় মূল্যবোধের অভাব এবং আইনি দুর্বলতার কারণে নারী হত্যা প্রায় নিত্যদিনের খবর হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, অধিকাংশ নারী হত্যা ঘটে "পরিবারের ভেতর" — স্বামী, শ্বশুর, কিংবা আত্মীয়ের হাতে। এই হত্যাকাণ্ডের মূলে থাকে — অসম্মান, সামান্য ভুলের অজুহাতে শাস্তি, পণ সংক্রান্ত দাবি, এবং সর্বোপরি নারীকে অধিকারহীন ভোগ্যপণ্য হিসেবে দেখার মনোভাব।

ইসলামে নারীর সম্মান: স্পষ্ট ঘোষণা: ইসলাম নারীকে অবজ্ঞার বস্তু নয়, সম্মানিত জীব বলে ঘোষণা করেছে। কুরআন বলছে: "আমি মানুষকে সম্মানিত করেছি"- (সূরা বনি ইসরাইল, ১৭:৭০)। রাসূলুল্লাহ (সা.) নারীদের নিরাপত্তাকে ঈমানের অঙ্গ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। বিদায় হজ্বের ভাষণে তিনি বলেন: "নারীদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো। তারা আল্লাহর আমানত"- (সহীহ মুসলিম, ১২১৮)। মানুষ হত্যাকে ইসলামে সরাসরি হারাম ঘোষণা করা হয়েছে: "যে ব্যক্তি কোনো প্রাণ হত্যা করে অন্যায়ভাবে... সে যেন সমস্ত মানবজাতিকে হত্যা করল"- (সূরা মায়িদা, ৫:৩২)।

আব্দুল মোমিন নামের এই ইমামের হাতে স্ত্রীর মৃত্যু -কেবল একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটা আমাদের ধর্মচর্চার বহুমুখী দুর্বলতার প্রতীক। আমরা মুখে তাকওয়ার কথা বলি, কিন্তু অন্তরে তাকওয়া নেই। আমরা নামাজ পড়ি, কিন্তু রাগ সংযম করি না। আমরা কুরআন পড়ি, কিন্তু স্ত্রীর সম্মান রক্ষা করি না। সমাজে যখন নারী জীবনের মূল্য এতো তুচ্ছ হয়, তখন সেটি কেবল একটি নারীর ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি নয় — বরং একটি জাতির আত্মার মৃত্যু। এখন সময় এসেছে — শুধু শিক্ষিত ইমাম নয়, প্রতিটি পুরুষ, প্রতিটি নারী, প্রতিটি পরিবার — সত্যিকার ইসলামকে হৃদয়ে ধারণ করার। যতদিন না আমরা নিজেদের সংশোধন করবো, ততদিন নারী হত্যার এই নির্মম ঘটনা বন্ধ হবে না।

সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৫ রাত ১২:৫৮
১৭টি মন্তব্য ১৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার কথা: দাদার কাছে—একজন বাবার কিছু প্রশ্ন

লিখেছেন সুম১৪৩২, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৫৫



দাদা,
কেমন আছেন? আশা করি খুবই ভালো আছেন। দিন দিন আপনার ভাই–ব্রাদারের সংখ্যা বাড়ছে—ভালো তো থাকারই কথা।
আমি একজন খুবই সাধারণ নাগরিক। ছোটখাটো একটা চাকরি করি, আর নিজের ছেলে–মেয়ে নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্টেরিম সরকারের শেষদিন : গঠিত হতে যাচ্ছে বিপ্লবী সরকার ?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:২২


ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়াকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার আন্তঃদেশীয় প্রকল্পটা সফল হতে অনেক দিন লেগে গিয়েছিল। বাংলাদেশে সে তুলনায় সংশ্লিষ্ট শক্তিসমূহের সফলতা স্বল্প সময়ে অনেক ভালো। এটা বিস্ময়কর ব্যাপার, ‘রাষ্ট্র’... ...বাকিটুকু পড়ুন

মব সন্ত্রাস, আগুন ও ব্লাসফেমি: হেরে যাচ্ছে বাংলাদেশ?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৩:৫২


ময়মনসিংহে হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন মানুষকে ধর্মীয় কটূক্তির অভিযোগে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। মধ্যযুগীয় এই ঘটনা এই বার্তা দেয় যে, জঙ্গিরা মবতন্ত্রের মাধ্যমে ব্লাসফেমি ও শরিয়া কার্যকর করে ফেলেছে। এখন তারই... ...বাকিটুকু পড়ুন

তৌহিদি জনতার নামে মব সন্ত্রাস

লিখেছেন কিরকুট, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৪




ছবিঃ অনলাইন থেকে সংগৃহীত।


দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মের নাম ব্যবহার করে সংঘটিত দলবদ্ধ সহিংসতার ঘটনা নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে তৌহিদি জনতা পরিচয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুখ গুজে রাখা সুশীল সমাজের তরে ,,,,,,,,

লিখেছেন ডঃ এম এ আলী, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০৫


দুর্যোগ যখন নামে আকাশে বাতাশে আগুনের ধোঁয়া জমে
রাস্তা জুড়ে কখনো নীরবতা কখনো উত্তাল প্রতিবাদের ঢেউ
এই শহরের শিক্ষিত হৃদয়গুলো কি তখনও নিশ্চুপ থাকে
নাকি জ্বলে ওঠে তাদের চোখের ভেতর নাগরিক বজ্র
কেউ কেও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×