somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

লামিয়ার আত্মহনন: রাষ্ট্রীয় অক্ষমতা, সামাজিক নিষ্ঠুরতা ও মনুষ্যত্বের অন্তর্গত অপমান !

৩০ শে এপ্রিল, ২০২৫ বিকাল ৫:৫১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


সেদিন ছিল ১৮ মার্চ ২০২৫। পটুয়াখালীর দুমকীতে বাবার কবর জিয়ারত করে ফেরার পথে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন শহীদ জসিম হাওলাদারের ১৭ বছরের কলেজপড়ুয়া মেয়ে লামিয়া। সে বাবা, যিনি বৈষম্যবিরোধী জুলাই আন্দোলনের সময় ঢাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হয়েছিলেন, যাঁর রক্তে নতুন একটি সরকার গঠনের পথ উন্মোচিত হয়েছিল। আজ, সেই শহীদের মেয়ে নেই। ২৬ এপ্রিল রাতে ঢাকায় নিজ ঘরে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে লামিয়া। তাকে উদ্ধার করে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

যেদিন সে ধর্ষণের শিকার হয়, তার পরদিনই সাহস করে মামলা করেছিল। গ্রেপ্তারও হয়েছিল দুজন। কিন্তু এরপর ? মূল অভিযুক্তদের একজন জামিনে বেরিয়ে যায়—আরো একবার ভেঙে পড়ে লামিয়ার আশা। চারপাশে ফিসফাস—এ বাড়ি থেকে দু'কথা, ও বাড়ি থেকে দু'কথা, সামাজিক কুৎসা আর চরিত্রহননের বিষাক্ত ধারাবাহিকতা—এসব কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল তাকে। নিজের পরিচিত একজনের সঙ্গে আলাপ করার সময় বলেছিল: "আল্লাহ যা করে, সেটা নাকি ভালোর জন্যেই করে। আমার কি ভালো করসে বলতে পারেন? আমার সাথে খালি খারাপই হইসে !" এমন কথায় ট্রমার গভীরতা বোঝা যায়। সে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল পড়াশোনা করবে, প্রয়োজন হলে কল দেবে। কিন্তু যা হলো, তা কল না—নীরব বিদায়।

এই লজ্জা শুধু ধর্ষণের নয়—এটা ন্যায়বিচারহীনতার, রাষ্ট্রীয় উদাসীনতার, এবং শাসনব্যবস্থার নিষ্ঠুর বৈপরীত্যের। একদিকে সরকার শহীদদের পরিবারকে প্রতীক হিসেবে তুলে ধরছে, আরেকদিকে শহীদের মেয়ের জন্য কবর জিয়ারতের পথটুকুও নিরাপদ করতে পারছে না। এই সরকার জুলাই আন্দোলনের রক্তমূল্যে গঠিত, অথচ সেই আন্দোলনের শহীদের কন্যা কোনো সুরক্ষা পায় না। একজন বাবা প্রাণ দিয়েছেন যে রাষ্ট্রে, সে রাষ্ট্রই তাঁর মেয়েকে ‘পালানোর’ সিদ্ধান্তে ঠেলে দেয়।

জুলাই অভ্যুত্থানের পর নারীর প্রতি সহিংসতা কমেনি—বরং বেড়েছে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত নধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে প্রায় ১,১০০টিব, যার মধ্যে গণধর্ষণের সংখ্যা ২১০টির বেশি । শুধু ধর্ষণ নয়—আত্মহত্যায় প্ররোচনা, সামাজিক বয়কট, চরিত্রহননন ইত্যাদি কারণে আত্মহননের ঘটনাও বেড়েছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি এবং সহজে জামিন পেয়ে যাওয়ার নজির এসব অপরাধকে উৎসাহ দিচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে ‘নারী দিবস’ কেবল এক প্রতীকী অনুষ্ঠান—যা বাস্তব পরিস্থিতির সামনে দাঁড়িয়ে নিষ্ঠুর ঠাট্টায় পরিণত হয়েছে।

ধর্ষণের মতো ভয়াবহ ঘটনার শিকার হয়েও লামিয়াকে যেটা সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিয়েছে, তা ছিল সমাজের ফিসফাস আর অপমান। তাঁর মা বলেছিলেন—"ইন্টার পরীক্ষা শেষ হলে ওকে নিয়ে দূরে চলে যাব, যেখানে কেউ চিনবে না, আঙুল তুলবে না"। এই “চিনে ফেলা”র ভয়, এই সমাজের তকমা—ই ভেঙে দিয়েছে তাকে। তার ধর্ষকরা তো অপরাধী, কিন্তু যারা আঙুল তুলেছে, যারা চরিত্র নিয়ে মুখ টিপে হাসছে, তারাও সমান অপরাধী। এই সমাজের নীরব বর্বরতা লামিয়ার গলায় ফাঁস হয়ে আসে।

জুলাই অভ্যুত্থান কি শুধু ক্ষমতার রদবদল ছিল ? নাকি তা ছিল ন্যায়ের পথে এক প্রত্যাবর্তন? যদি তা-ই হয়, তাহলে শহীদ পরিবারগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে, বিচার প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী না করে, নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতা কমাতে ব্যর্থ থেকে সেই অভ্যুত্থান কতটা বৈপ্লবিক ছিল? এক শহীদকন্যার লাশ আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে বলে দিচ্ছে—জুলাই অভ্যুত্থানের ভিত কাঁপছে ।

লামিয়ার মৃত্যু আত্মহনন নয়—এটা একটা সমাজের আত্মঘাত। এটা বিচারহীনতার আত্মচিত্র, রাষ্ট্রের মুখোশহীনতা, এবং অভ্যুত্থানোত্তর ব্যর্থতার সরব দলিল। সে কেবল এক কিশোরী ছিল না—সে ছিল আমাদের শাসনব্যবস্থার আয়না। যেখানে একজন মেয়ে প্রশ্ন করে যায় "আমার সাথে খালি খারাপই হইসে, এটা কেমন রাষ্ট্র?" এই প্রশ্ন যদি আমরা শুনতে না পাই, তবে আমরা সবাই এই আত্মহননের একেকজন অংশীদার।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:০১
১০টি মন্তব্য ১১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার কথা: দাদার কাছে—একজন বাবার কিছু প্রশ্ন

লিখেছেন সুম১৪৩২, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৫৫



দাদা,
কেমন আছেন? আশা করি খুবই ভালো আছেন। দিন দিন আপনার ভাই–ব্রাদারের সংখ্যা বাড়ছে—ভালো তো থাকারই কথা।
আমি একজন খুবই সাধারণ নাগরিক। ছোটখাটো একটা চাকরি করি, আর নিজের ছেলে–মেয়ে নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্টেরিম সরকারের শেষদিন : গঠিত হতে যাচ্ছে বিপ্লবী সরকার ?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:২২


ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়াকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার আন্তঃদেশীয় প্রকল্পটা সফল হতে অনেক দিন লেগে গিয়েছিল। বাংলাদেশে সে তুলনায় সংশ্লিষ্ট শক্তিসমূহের সফলতা স্বল্প সময়ে অনেক ভালো। এটা বিস্ময়কর ব্যাপার, ‘রাষ্ট্র’... ...বাকিটুকু পড়ুন

মব সন্ত্রাস, আগুন ও ব্লাসফেমি: হেরে যাচ্ছে বাংলাদেশ?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৩:৫২


ময়মনসিংহে হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন মানুষকে ধর্মীয় কটূক্তির অভিযোগে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। মধ্যযুগীয় এই ঘটনা এই বার্তা দেয় যে, জঙ্গিরা মবতন্ত্রের মাধ্যমে ব্লাসফেমি ও শরিয়া কার্যকর করে ফেলেছে। এখন তারই... ...বাকিটুকু পড়ুন

তৌহিদি জনতার নামে মব সন্ত্রাস

লিখেছেন কিরকুট, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৪




ছবিঃ অনলাইন থেকে সংগৃহীত।


দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মের নাম ব্যবহার করে সংঘটিত দলবদ্ধ সহিংসতার ঘটনা নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে তৌহিদি জনতা পরিচয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুখ গুজে রাখা সুশীল সমাজের তরে ,,,,,,,,

লিখেছেন ডঃ এম এ আলী, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০৫


দুর্যোগ যখন নামে আকাশে বাতাশে আগুনের ধোঁয়া জমে
রাস্তা জুড়ে কখনো নীরবতা কখনো উত্তাল প্রতিবাদের ঢেউ
এই শহরের শিক্ষিত হৃদয়গুলো কি তখনও নিশ্চুপ থাকে
নাকি জ্বলে ওঠে তাদের চোখের ভেতর নাগরিক বজ্র
কেউ কেও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×