somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একটি স্মার্ট জাতির অন্তঃসারশূন্য আত্মজৈবনিক !

০৩ রা মে, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:৩৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


একটা সময় ছিল, যখন জাতির ভবিষ্যৎ বলতে বোঝানো হতো এমন এক শ্রেণিকে, যারা বই পড়ে, প্রশ্ন তোলে, বিতর্কে অংশ নেয়, আর চিন্তা করে। এখন জাতির ভবিষ্যৎ মানে—ইনফ্লুয়েন্সার। তারা সকাল ১০টায় ঘুম থেকে উঠে বলে, “আজকে একটা প্রোডাক্টিভ দিন হবে”—তারপর সারাদিন ইনস্টাগ্রামে 'ভাইবা' দেয়। ভবিষ্যতের দিকে আমরা এগোচ্ছি ঠিকই, কিন্তু পেছন ঘুরে দেখি—সৃজনশীলতা দাঁড়িয়ে আছে কান ধরে, বলে, “স্যার, আমি কিছু বলিনি!”

আজকের রাষ্ট্রীয় নির্মাণে “বীর” মানে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিয়ে ফিতা কাটা মানুষ, যিনি বলবেন, “আমরা তরুণদের পাশে আছি”—যদিও পাশে মানে ফটোসেশনের দূরত্বে। এই দূরত্ব এখন এতটাই নিয়মিত যে, ‘সম্ভাবনা’ শব্দটাই একটা প্রটোকল হয়ে গেছে—যা সবাই উচ্চারণ করে, কেউ বিশ্বাস করে না।

আমাদের ছাত্রসমাজও আর আগের মতো “অ্যাকটিভ ক্যাডার” নয়, আবার পুরোপুরি “প্যাসিভ কনজ্যুমার” ও নয়। তারা এখন মাঝামাঝি কিছু—একধরনের “ডিজিটাল মধ্যবিত্ত”। দিনশেষে তাদের যাত্রা ওয়াইফাই-এর গতি আর মেন্টরের মোটিভেশন স্পিচের মাঝখানে দুলে ওঠে। তারা রাজনৈতিক হয়, কিন্তু প্রণোদনায়। তারা ধর্মচিন্তায় আগ্রহী, কিন্তু কুরআন-হাদিস না পড়ে ইউটিউব শর্টসে “হেল্পফুল হুজুর” দেখে। তারা লেখাপড়া করে, কিন্তু মূলত পরীক্ষার আগে; কারণ জিপিএ ৫ না পেলে সমাজে ‘প্রোডাক্ট’ হিসেবে ভ্যালু কমে।

এই প্রজন্মের একদল আবার চেতনাবাজির বুট পায়ে মৌলবাদকে হেঁটে আনে শহরে। তাদের দৃষ্টিতে ধর্ম মানে নিয়ন্ত্রণ, সংস্কৃতি মানে সমস্যা, এবং শিল্প মানে পাপ। অথচ এই মৌলবাদ, যে কিনা ধর্মের ভাষায় কথা বলে, বাস্তবে ক্ষমতার ছায়ায় বাঁচে। ধর্মের নামে তারা শিল্পকে নিঃশেষ করে, অথচ নিজেরা প্রচার চালায় বিদেশি প্ল্যাটফর্মে। আধুনিক প্রযুক্তির সুযোগ নিয়ে তারা প্রচারণা চালায় সেই চিন্তার বিরুদ্ধে, যা চিন্তা করতেই শেখায়।

অন্যদিকে, আমাদের শিল্প-সাহিত্য জগতও “অত্যন্ত প্রোফেশনাল” হয়ে গেছে। এখানে আর সত্য বলা হয় না, বরং “সেলফ সেন্সরড ব্যালান্স” শেখানো হয়। নতুন লেখকেরা সাহস করে যদি বলে ফেলেন, “রাজনীতি সংস্কৃতিকে দখল করছে”—তখন এক বড় ভাই বলবেন, “এভাবে লিখলে স্পন্সর পাবা না”। ফলে আজকের লেখক সাহস নয়, সচেতনতা দিয়ে লেখে—যা পাঠক পড়ে না, শুধু ‘রেফারেন্স’ হিসেবে ব্যবহার করে।

রাষ্ট্র এখন এক ধরনের “ব্যবস্থাপত্র” হয়ে গেছে—যেখানে চিন্তার বদলে প্রয়োজনীয়তা, আর মানবতার বদলে উন্নয়ন দাঁড়িয়ে থাকে। এখানে ধর্ম মানে অনুমোদিত সংস্করণ, জাতীয়তাবাদ মানে ফরমায়েশি ব্যানার, আর সৃষ্টিশীলতা মানে সরকারী রেজিস্ট্রেশনের অপেক্ষা। তুমি কবিতা লিখলে কেউ বলবে, “চাকরি পাওনি বলেই তো এত বিষণ্নতা”—আর যদি ছবি আঁকো, বলবে, “এতে দেশের কী উপকার?”

মাঝে মাঝে ভাবি, আমরা কি আসলেই কোনো জাতি হয়ে উঠেছি ? নাকি একটা 'ডিজিটাল ভোক্তা গোষ্ঠী', যারা মোবাইলের স্ক্রিনে সুখ খোঁজে, আর বাস্তবে ক্ষোভ জমিয়ে রাখে? আমাদের স্বপ্ন এখন ইএমআই ভিত্তিক; আমাদের ভাষা, ফিল্টার-আশ্রিত। যে কবি সাহস করে সিস্টেমের বিরুদ্ধে লেখে, তাকে বলা হয় “মাইনরিটি ভিউ”। আর যে সাংবাদিক সত্য তুলে ধরতে চায়, তাকে বলা হয় “প্রশ্নবিদ্ধ”।

এখানে সৃষ্টিশীলতা কোনো অপরাধ নয়, কিন্তু অপ্রয়োজনীয়। আর যেখানে চিন্তা অপ্রয়োজনীয়, সেখানে বেঁচে থাকা মানেই অস্তিত্বের উপর চাপে চলা এক জাতীয় অভিনয়। এই “স্মার্ট জাতি” এখন অনেক কিছু পারে—কিন্তু ভাবতে পারে না। তাদের গান আছে, তবু সুর নেই। তারা লেখে, কিন্তু প্রশ্ন করে না। তারা বিশ্বাস করে, কিন্তু যাচাই করে না। আর যারা যাচাই করে, তারা সমাজ থেকে গায়েব হয়ে যায়—নিরবতায়, মৌন তিরস্কারে, কিংবা রাষ্ট্রীয় প্রটোকলে।


সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মে, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:৩৫
১৪টি মন্তব্য ১৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তৌহিদি জনতার নামে মব সন্ত্রাস

লিখেছেন কিরকুট, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৪




ছবিঃ অনলাইন থেকে সংগৃহীত।


দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মের নাম ব্যবহার করে সংঘটিত দলবদ্ধ সহিংসতার ঘটনা নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে তৌহিদি জনতা পরিচয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুখ গুজে রাখা সুশীল সমাজের তরে ,,,,,,,,

লিখেছেন ডঃ এম এ আলী, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০৫


দুর্যোগ যখন নামে আকাশে বাতাশে আগুনের ধোঁয়া জমে
রাস্তা জুড়ে কখনো নীরবতা কখনো উত্তাল প্রতিবাদের ঢেউ
এই শহরের শিক্ষিত হৃদয়গুলো কি তখনও নিশ্চুপ থাকে
নাকি জ্বলে ওঠে তাদের চোখের ভেতর নাগরিক বজ্র
কেউ কেও... ...বাকিটুকু পড়ুন

নজরুল পরিবারের প্রশ্ন: উগ্রবাদী হাদির কবর নজরুলের পাশে কেন?

লিখেছেন মাথা পাগলা, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৩:০১



প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে কাজী নজরুল ইসলামের দেহ সমাধিস্থ করা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশে। শনিবার বাংলাদেশের স্থানীয় সময় বিকেল ৪টে নাগাদ সেখানেই দাফন করা হল ভারতবিদ্বেষী বলে পরিচিত ইনকিলাব মঞ্চের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির আসল হত্যাকারি জামাত শিবির কেন আলোচনার বাহিরে?

লিখেছেন এ আর ১৫, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:৫৪


গত মাসের শেষের দিকে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পারওয়ারের ছেলে সালমান, উসমান হাদির সঙ্গে খু*নি ফয়সালের পরিচয় করিয়ে দেন। সেই সময় হাদিকে আশ্বস্ত করা হয়—নির্বাচন পরিচালনা ও ক্যাম্পেইনে তারা... ...বাকিটুকু পড়ুন

দিপুকে হত্যা ও পোড়ানো বনাম তৌহিদী জনতা!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:০৫


পাইওনিয়ার নিটওয়্যারস বিডি লিমিটেড (Pioneer Knitwears (BD) Ltd.) হলো বাদশা গ্রুপের (Badsha Group) একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। বাদশা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান কর্ণধার হলেন জনাব বাদশা মিয়া, যিনি একইসাথে এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×