
একটা সময় ছিল, যখন জাতির ভবিষ্যৎ বলতে বোঝানো হতো এমন এক শ্রেণিকে, যারা বই পড়ে, প্রশ্ন তোলে, বিতর্কে অংশ নেয়, আর চিন্তা করে। এখন জাতির ভবিষ্যৎ মানে—ইনফ্লুয়েন্সার। তারা সকাল ১০টায় ঘুম থেকে উঠে বলে, “আজকে একটা প্রোডাক্টিভ দিন হবে”—তারপর সারাদিন ইনস্টাগ্রামে 'ভাইবা' দেয়। ভবিষ্যতের দিকে আমরা এগোচ্ছি ঠিকই, কিন্তু পেছন ঘুরে দেখি—সৃজনশীলতা দাঁড়িয়ে আছে কান ধরে, বলে, “স্যার, আমি কিছু বলিনি!”
আজকের রাষ্ট্রীয় নির্মাণে “বীর” মানে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিয়ে ফিতা কাটা মানুষ, যিনি বলবেন, “আমরা তরুণদের পাশে আছি”—যদিও পাশে মানে ফটোসেশনের দূরত্বে। এই দূরত্ব এখন এতটাই নিয়মিত যে, ‘সম্ভাবনা’ শব্দটাই একটা প্রটোকল হয়ে গেছে—যা সবাই উচ্চারণ করে, কেউ বিশ্বাস করে না।
আমাদের ছাত্রসমাজও আর আগের মতো “অ্যাকটিভ ক্যাডার” নয়, আবার পুরোপুরি “প্যাসিভ কনজ্যুমার” ও নয়। তারা এখন মাঝামাঝি কিছু—একধরনের “ডিজিটাল মধ্যবিত্ত”। দিনশেষে তাদের যাত্রা ওয়াইফাই-এর গতি আর মেন্টরের মোটিভেশন স্পিচের মাঝখানে দুলে ওঠে। তারা রাজনৈতিক হয়, কিন্তু প্রণোদনায়। তারা ধর্মচিন্তায় আগ্রহী, কিন্তু কুরআন-হাদিস না পড়ে ইউটিউব শর্টসে “হেল্পফুল হুজুর” দেখে। তারা লেখাপড়া করে, কিন্তু মূলত পরীক্ষার আগে; কারণ জিপিএ ৫ না পেলে সমাজে ‘প্রোডাক্ট’ হিসেবে ভ্যালু কমে।
এই প্রজন্মের একদল আবার চেতনাবাজির বুট পায়ে মৌলবাদকে হেঁটে আনে শহরে। তাদের দৃষ্টিতে ধর্ম মানে নিয়ন্ত্রণ, সংস্কৃতি মানে সমস্যা, এবং শিল্প মানে পাপ। অথচ এই মৌলবাদ, যে কিনা ধর্মের ভাষায় কথা বলে, বাস্তবে ক্ষমতার ছায়ায় বাঁচে। ধর্মের নামে তারা শিল্পকে নিঃশেষ করে, অথচ নিজেরা প্রচার চালায় বিদেশি প্ল্যাটফর্মে। আধুনিক প্রযুক্তির সুযোগ নিয়ে তারা প্রচারণা চালায় সেই চিন্তার বিরুদ্ধে, যা চিন্তা করতেই শেখায়।
অন্যদিকে, আমাদের শিল্প-সাহিত্য জগতও “অত্যন্ত প্রোফেশনাল” হয়ে গেছে। এখানে আর সত্য বলা হয় না, বরং “সেলফ সেন্সরড ব্যালান্স” শেখানো হয়। নতুন লেখকেরা সাহস করে যদি বলে ফেলেন, “রাজনীতি সংস্কৃতিকে দখল করছে”—তখন এক বড় ভাই বলবেন, “এভাবে লিখলে স্পন্সর পাবা না”। ফলে আজকের লেখক সাহস নয়, সচেতনতা দিয়ে লেখে—যা পাঠক পড়ে না, শুধু ‘রেফারেন্স’ হিসেবে ব্যবহার করে।
রাষ্ট্র এখন এক ধরনের “ব্যবস্থাপত্র” হয়ে গেছে—যেখানে চিন্তার বদলে প্রয়োজনীয়তা, আর মানবতার বদলে উন্নয়ন দাঁড়িয়ে থাকে। এখানে ধর্ম মানে অনুমোদিত সংস্করণ, জাতীয়তাবাদ মানে ফরমায়েশি ব্যানার, আর সৃষ্টিশীলতা মানে সরকারী রেজিস্ট্রেশনের অপেক্ষা। তুমি কবিতা লিখলে কেউ বলবে, “চাকরি পাওনি বলেই তো এত বিষণ্নতা”—আর যদি ছবি আঁকো, বলবে, “এতে দেশের কী উপকার?”
মাঝে মাঝে ভাবি, আমরা কি আসলেই কোনো জাতি হয়ে উঠেছি ? নাকি একটা 'ডিজিটাল ভোক্তা গোষ্ঠী', যারা মোবাইলের স্ক্রিনে সুখ খোঁজে, আর বাস্তবে ক্ষোভ জমিয়ে রাখে? আমাদের স্বপ্ন এখন ইএমআই ভিত্তিক; আমাদের ভাষা, ফিল্টার-আশ্রিত। যে কবি সাহস করে সিস্টেমের বিরুদ্ধে লেখে, তাকে বলা হয় “মাইনরিটি ভিউ”। আর যে সাংবাদিক সত্য তুলে ধরতে চায়, তাকে বলা হয় “প্রশ্নবিদ্ধ”।
এখানে সৃষ্টিশীলতা কোনো অপরাধ নয়, কিন্তু অপ্রয়োজনীয়। আর যেখানে চিন্তা অপ্রয়োজনীয়, সেখানে বেঁচে থাকা মানেই অস্তিত্বের উপর চাপে চলা এক জাতীয় অভিনয়। এই “স্মার্ট জাতি” এখন অনেক কিছু পারে—কিন্তু ভাবতে পারে না। তাদের গান আছে, তবু সুর নেই। তারা লেখে, কিন্তু প্রশ্ন করে না। তারা বিশ্বাস করে, কিন্তু যাচাই করে না। আর যারা যাচাই করে, তারা সমাজ থেকে গায়েব হয়ে যায়—নিরবতায়, মৌন তিরস্কারে, কিংবা রাষ্ট্রীয় প্রটোকলে।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মে, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:৩৫

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




