
বলতে না বলতেই যুদ্ধটা শুরু হয়ে গেল। না, যুদ্ধ না বলাই ভালো—রাষ্ট্রীয় অভিনয় বলা ভালো। ভারত ও পাকিস্তান আবার সীমান্তে একে অপরকে চেঁচিয়ে বলছে, "তুই গো-মূত্রখোর ", "তোর দেশ জঙ্গি"। কেউ বোমা ছুড়ছে, কেউ প্রতিশোধ নিচ্ছে। কেউ পরমবীরচক্র পাচ্ছে, কেউ নিশান-এ-হায়দার। আমরা পাশে দাঁড়িয়ে পপকর্ন খাচ্ছি, কার সক্ষমতা বেশি তার হিসাব করছি, কেউ কেউ আবার ফেসবুকে গলা ফাটিয়ে বলছি: “আমরা পাকিস্তানের পক্ষে”, “ভারতকে এবার উচিত শিক্ষা দেয়া উচিত পাকিস্তানের !”
রাষ্ট্র এক আজব এনটিটি । কর আদায়ে তার উপস্থিতি আছে, কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগে সে নিখোঁজ। তার অস্তিত্বের সংকট শুরু হয় যখন জনতা তাকে ভুলে যায়। তাই রাষ্ট্র চিরকাল শত্রুর খোঁজে থাকে। যার শত্রু নেই, তার রাষ্ট্রবোধ ঝিমিয়ে পড়ে। যার প্রতিপক্ষ নেই, তার জাতীয়তাবাদ পচে যায়। এইখানে এসে কাশ্মীর খুব জরুরি হয়ে পড়ে—যুদ্ধ নয়, যুদ্ধের সম্ভাবনাটাই জরুরি। ভারতের হিন্দু প্রাইড বনাম পাকিস্তানের কাশ্মীর কার্ড আসলে দুই রাষ্ট্রের নিয়মিত পেশির ব্যায়াম!
কাশ্মীরকে নিয়ে এত মাথাব্যথার কারণ কী? কারণ এটি দুই রাষ্ট্রের নৈতিক সাজঘর। ভারত কাশ্মীরকে সমগ্র ভারতীয়ত্বের ‘নথিভুক্ত’ বানাতে চায়। পাকিস্তান চায় কাশ্মীর যেন চিরকাল ‘অধিকারবঞ্চিত’ থাকে। কারণ এই নাটক না থাকলে জেনারেলদের অস্তিত্ব থাকে না। মোদী জানেন, কাশ্মীরের প্রতিক্রিয়া না দেখালে হিন্দু ভোটব্যাংকে জং ধরবে। পাক জেনারেলরা জানেন, কাশ্মীর না থাকলে সেনাবাহিনীর বাজেট কমবে। কাশ্মীর মানে যুদ্ধ নয়—কাশ্মীর মানে ট্রিগার হয়ে থাকা একটা চিরস্থায়ী সংকেত।
ভারত-পাকিস্তান নাটকের একটা আন্তর্জাতিক সংস্করণ হচ্ছে ইরান-ইসরায়েল। ইসরায়েল সিরিয়ায় ইরানের কনস্যুলেট অফিসে ইরানের লোক হত্যা করে , ইরান প্রতিশোধ নিতে পাল্টা মিসাইল হামলা করে ইসরায়েলে। এসব যুদ্ধের থিয়েটারে মূল বিষয় জয়ের চেয়ে আত্মপ্রকাশ! দুইদেশের জনগণ ভাবতে থাকে তাদের দেশ অনেক শক্তিশালী ! রাষ্ট্র তার জনগণকে অতিকায় যুদ্ধ দিয়ে বোঝাতে চায়,“আমি আছি, কারণ ও আছে।” এই ‘ও’ টার নাম কখনো পাকিস্তান, কখনো ইরান, কখনো “অসাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী চক্র”।
নরেন্দ্র মোদীর রাজনীতি এক ধর্মীয় উৎপাদন প্রকল্প। সেই প্রকল্পের জন্য যুদ্ধের উত্তাপ দরকার, যাতে তার হিন্দুত্ববাদ "সর্বোচ্চ তেজস্ক্রিয়" হয়ে ওঠে। আর পাকিস্তানের সামরিকতন্ত্র আসলে রাষ্ট্র নয়, রাষ্ট্রের ঠিকাদার। জনগণ মরবে, বাজেট যাবে অস্ত্র কেনায়, কিন্তু সেনাপ্রধানরা পাবেন পদক ও কবরের আগেই রাষ্ট্রীয় বীরত্ব। মোদী ভোট পান, জেনারেলরা মেডেল। আর দুই রাষ্ট্রের জনগণ পায় ভাইরাল কবরে শুয়ে থাকার অনুমতি !
আমরা, মানে বাংলাদেশ। পাশের ফ্ল্যাটে আগুন লেগেছে—আমরা বারান্দা থেকে ভিডিও করছি। ফেসবুকে বলছি, “এই ঘটনায় আমরা গভীর উদ্বিগ্ন" । কিন্তু সত্যি বলতে , আমাদের অবস্থান এই দুই রাষ্ট্রের মধ্যে নয়—আমরা দাঁড়িয়ে আছি শূন্যস্থানে , যেখানে মুদ্রার কোন পাশেই আমাদের মুখ নেই। আমরা যুদ্ধ চাই না, আবার যুদ্ধ দেখে উত্তেজিত না হয়ে পারিও না। আমাদের রাষ্ট্র এক ভদ্র দর্শক—আর আমরা? রসগোল্লার মধ্যে লঙ্কার স্বাদ খুঁজে বেড়ানো জাতি।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই মে, ২০২৫ রাত ৯:৪৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


