
বাংলাদেশের রাজনীতির বর্তমান অবস্থা দেখে একজন সাধারণ নাগরিক কি ভাবছেন? তাদের ভাবনার আদৌতে গুরুত্ব আছে কোনো ? দেশে ইন্টেরিম সরকার ক্ষমতায় থেকে টেনেটুনে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। দেশে নির্বাচন কবে হবে তার জন্য একটি রাজনৈতিক দল আস্তে আস্তে রাজপথ দখল করে ইন্টেরিম সরকারের উপর চাপ বাড়াচ্ছে। অন্যদিকে ইন্টেরিমের কিংস পার্টি বিভিন্ন অজুহাতে নির্বাচন পেছানোর পায়তারা শুরু করেছে । এরই মধ্যে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী ও ইন্টেরিম সরকারের মধ্যে দেশের কিছু স্পর্শকাতর ইস্যুতে স্পষ্ট বিরোধ দেখে যাচ্ছে। এই বিরোধ কি সত্যিকারের বিরোধ নাকি কারো মেটিকুলাস ডিজাইন তা নিয়ে ভাবার সময় এসেছে।
বর্তমান সরকার নামে ইন্টেরিম হলেও নির্বাচন বাদে বাকি সব বিষয় নিয়ে একটি রাজনৈতিক দলের মতো আচরণ করছে। এরই প্রেক্ষিতে সরকার সিদ্ধান্ত নেয় যে মিয়ানমারে রাখাইন রাজ্যে ত্রাণ পাঠানোর জন্য করিডোর বা চ্যানেল বা ত্রাণ সহায়তা তথা বাংলাদেশের ভূখন্ড ব্যবহার করে জাতিসংঘের সহায়তায় ত্রাণ পাঠাবে রাখাইনে। এই ইস্যু নিয়ে সৃষ্টি হয় দেশজুড়ে আলোচনা ও সমালোচনা। মিয়ানমার জান্তার না ও চীনের পুরো ব্যাপারটায় যুক্ত না হওয়ায় দেশজুড়ে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়। ইন্টেরিম সরকার মনোনীত রোহিঙ্গা রিপ্রেজেন্ন্টেটিভ খলিলুর রহমান কে বলতে শোনা যায় কারো তোয়াক্কা না করে বাংলাদেশ রাখাইন রাজ্যে ত্রাণ সহায়তা পাঠানোর জন্য চ্যানেল দিবে।
কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে এই বিষয় নিয়ে আলোচনার দরকার নেই বলে মনে করেন খলিলুর রহমান । এতে বাম হতে শুরু করে ইসলামিস্ট দলগুলো সরকারের তীব্র বিরোধিতা করে। কেবল চুপ ছিলো সরকারের কিংস পার্টি ও আল বটর বাহিনীর লোকজন। সরকারের জন্য মড়ার উপর খাড়ার ঘা হলো সেনাপ্রধানের করিডোর নিয়ে বক্তব্যকে কেন্দ্র করে। সেনাপ্রধান সাফ জানিয়ে দিয়েছেন নির্বাচিত সরকার ব্যতীত অন্য কোনো ধরণের সরকার করিডোর দেয়ার এক্তিয়ার নেই। বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনী এমন কাজ কে সমর্থন করে না। সেনাপ্রধানের বক্তব্য বাংলাদেশের জনসাধারণের মতামত কে প্রতিনিধিত্ব করলেও গভীর চিন্তার অবকাশ আছে।
ইন্টেরিম সরকার করিডোর দিতে চাচ্ছে জাতিসংঘের অনুরোধে আবার সেনাবাহিনীর উপর জাতিসংঘের প্রচ্ছন্ন প্রভাব আছে। জাতিসংঘ যখন ইন্টেরিমের কাছে করিডোরের কথা নলে সেনাবাহিনীকে জানায় নি ? কারণ এই গুরুত্বপূর্ণ কাজে সেনাবাহিনীর সাহায্য লাগবেই। সেনাপ্রধান হটাৎ কেন করিডোর ইস্যুতে ইন্টেরিম সরকারের বিরুদ্ধে গেল ? যেখানে সেনাবাহিনী-ইন্টেরিমের নাটাই একই শক্তির হাতে ? এই যে পরস্পর বিরোধী মনোভাব দেখা যাচ্ছে দুইটি এনটিটির মধ্যে উহা কোনো গেমের অংশ নয়তো ? কোনো একপক্ষকে ভিলেন বানিয়ে উহার জনপ্রিয়তা কমানোর চেষ্টা করেছে কেউ। এই গেম পুরোপুরি ভাবে কাজে লেগেছে। ইন্টেরিম সরকারের করিডোর ইস্যুতে জনপ্রিয়তা হারালো আবার সেনাপ্রধানের ইমেজ পুনরূদ্ধার করা হলো। পুরোটাই একটা মেটিকুলাস ডিজাইনের অংশ মনে হচ্ছে।
এবার আসি চিটাগং বন্দর নিয়ে। পরাশক্তিগুলোর মাঝে বন্দর দখল নিয়ে রাজনীতি চলছে বহুবছর ধরে। বাংলাদেশের ডীপ সি পোর্ট ও মংলা বন্দর নিয়ে ভারত-চীনের তোড়জোড় কেবল বন্দর পরিচালনার অংশ নয়। এখানে কিছু স্ট্রাটেজিক ইস্যু আছে। সাধারণত বিদেশি কোম্পানিগুলো বিভিন্ন দেশে কোনো নিদিষ্ট দেশের হয়ে স্ট্রাটেজিক পয়েন্ট দখল করার উদ্দেশ্যে বন্দর পরিচালনার দায়িত্ব চায়। যে দেশের বন্দর সে দেশ তথা দেশের ক্ষমতাসীনদের নির্ধারণ করতে হবে তারা কি করবে ! ইন্টেরিম সরকার বন্দর পরিচালনার জন্য একটি আমেরিকান-বেইসড কোম্পানিকে দায়িত্ব দিতে চায়। এই সিদ্ধান্তের প্রথম বিরোধিতা করে বাংলাদেশের বাম রাজনৈতিক দলগুলো। এরপর যারা বন্দর অপারেশনে আছেন তারা দাবী করে উক্ত বন্দর খুব সুন্দর ভাবে দেশীয় কোম্পানি চালাচ্ছে।
বিদেশি কোম্পানির হাতে বন্দর তুলে দেয়ার দরকার নেই। কিন্তু ইন্টেরিম সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস উনার এক ভাষণে স্পষ্ট বলেছেন, " ইন্টেরিম সরকার বন্দর পরিচালনার দায়িত্ব বিদেশিদের হাতে দিবেই "। কারো মতবিরোধের তোয়াক্কা করা হবে না। দেশব্যাপী শুরু হয় সরকারের তীব্র বিরোধিতা! অফলাইন-অনলাইনে সবাই ইন্টেরিম সরকার কে মার্কিনের দালাল বলে গালি দিচ্ছে। অথচ বিগত আম্লিক সরকারের আমলে উক্ত বিদেশি কোম্পানিকে এই বন্দর পরিচালনার ব্যাপারে কার্যক্রম শুরু হয়েছিলো। কিন্তু সব গালি খাচ্ছে ইন্টেরিম সরকার। খোদ আম্লিক এখন বিশাল দেশপ্রেমিক সেজে ইন্টেরিম কে গালাগাল করছে। এদিকে সেনাবাহিনীর প্রধান এক্ষেত্রেও ইন্টেরিমের বিপক্ষে তাদের অবস্থান জানিয়েছে। নির্বাচিত সরকার ব্যতীত বন্দর অন্য দেশকে কেউ পরিচালনার জন্য দিতে পারবে না বলে মত জানিয়েছেন সেনাপ্রধান । যাদের ক্ষমতার উৎস একই কিন্তু তারা আজ কেন বিপরীত মুখী কথা বলছে ? একপক্ষকে ভিলেন বানিয়ে জনরোষের মুখে ফেলে অপর পক্ষকে কেন ব্যবহার করা হচ্ছে চাপ সৃষ্টির জন্য সেটা ভাবার যথেষ্ট অবকাশ আছে। সেনাবাহিনী স্বাধীন ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার অতন্দ্র প্রহরী আর অপর পক্ষ দেশ বিক্রিকারী ? মেটিকুলাস ডিজাইন অনুসারেই কাজ এগিয়ে চলছে !
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ, নির্বাচনের সময় ও সংস্কার নিয়েও খটকা আছে। সেনাপ্রধান তার ভাষণে বলেছেন সংস্কার ও জুলাই হত্যার জাতিসংঘের প্রতিবেদন নিয়ে সরকার কোনো আলোচনা করেনি । তিনি ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দিয়ে তার সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে চান। অন্যদিকে ইন্টেরিম সরকার চায় সংস্কার অজুহাত দেখিয়ে , অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে নির্বাচনকে পিছিয়ে দিতে। কারণ সরকারের কিংস পার্টির এখনো পরীক্ষা দেয়ার মতো প্রিপারেশন হয়নি। তাছাড়া আর কোনোদিন ক্ষমতার সাধ পাওয়া যাবে কিনা তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। বিভিন্ন অজুহাতে ক্ষমতা ধরে রাখতে পারলেই যত লাভ ! কিন্তু সেনাপ্রধানের বক্তব্য ইন্টেরিমের সাথে পুরোপুরি কন্ট্রাডিক্ট করছে। ইন্টেরিম সরকার আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করেছে কিন্তু পশ্চিমা উদার গণতান্ত্রিক বিশ্ব কোনো মন্তব্য করেনি। বাংলাদেশের মানুষ ধরেই নিয়েছে এত করাপশন-লুটপাট ও মানুষের মৌলিক অধিকার যারা ক্ষুন্ন করেছে তাদের পক্ষে আর কেউ কথা বলবে না। কিন্তু আজ হিউম্যান রাইটস ওয়াচ যে ধরণের মতামত দিয়েছে উহা সরকারের বিপক্ষে যায়। তারা ইন্টেরিম কে মানুষের মৌলিক অধিকার সংকুচিত করার জন্য দায়ী করছে। সরকার কি আওয়ামী লীগ কে নিষিদ্ধ করেছে কেবল একক সিদ্ধান্তে ? কারো সাথে পরামর্শ হয়নি ? পশ্চিমা বিশ্ব যখন নিষিদ্ধ করা হয় তখন কেন চুপ ছিলো ? এখন কেনই বা কথা বলছে ? ইউরোপীয় ইউনিয়ন সংস্কারের পক্ষে বলছে আবার অস্ট্রেলিয়ার সিনেটররা সুস্পষ্ট নির্বাচনী রোডম্যাপ কেন চাইছেন ?
বাংলাদেশের রাজনীতির উপর রাজনীতিবিদদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। উহা পরিচালিত হচ্ছে একক বা সংখ্যাগরিষ্ঠ বিদেশি শক্তি দ্বারা। তারা আমাদের দেশ নিয়ে নানা মুখী তৎপরতায় ব্যস্ত। একই শক্তির উৎস দুইটি ভিন্ন এনটিটিকে দিয়ে দুই পক্ষকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা চলছে। এভাবে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ নামক দেশটির গন্তব্য কোথায় গিয়ে থামে তাই এখন দেখার বিষয় !
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে মে, ২০২৫ রাত ৯:২৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।






