somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

খলিলুরের উত্থান ও জসীমের পতন : কোন পথে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ?

২৩ শে মে, ২০২৫ রাত ১০:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির অন্দরমহলে যেন এক লুকানো ভূমিকম্প ঘটে গেছে। পররাষ্ট্রসচিব মো. জসীম উদ্দিনকে সরিয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে এমন এক অভ্যন্তরীণ টানাপোড়েন, যার গভীরে রয়েছে পাকিস্তানপন্থী লবির চক্র, ‘ছায়া-উপদেষ্টা’দের আধিপত্য, এবং বাংলাদেশের কূটনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে দ্বন্দ্বময় দৃষ্টিভঙ্গির সংঘর্ষ।

২০২৪ সালের ১৭ এপ্রিল ঢাকায় অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ-পাকিস্তান পররাষ্ট্রপর্যায়ের দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে জসীম উদ্দিন বাংলাদেশের পক্ষ থেকে একটি সাহসী এবং ঐতিহাসিক দাবি উত্থাপন করেন। তিনি সাফ জানিয়ে দেন, ১৯৭১ সালের পূর্বে অখণ্ড পাকিস্তানের জাতীয় সম্পদ থেকে বাংলাদেশের প্রাপ্য ৪.৩২ বিলিয়ন ডলার এবং ১৯৭০ সালের ভোলার ঘূর্ণিঝড়ে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ঘোষিত ২০০ মিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক সহায়তা ফেরত দিতে হবে। আরও গভীরে গিয়ে তিনি ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের দ্বারা সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চাওয়ার দাবিও তোলেন। এই অবস্থান ছিল এক ধরনের রাষ্ট্রীয় স্মৃতিকথা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার প্রয়াস—যা এক শ্রেণির প্রশাসনিক লবির জন্য হয়ে ওঠে অস্বস্তির কারণ।

এই ঘটনার পরপরই জসীম উদ্দিনকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মূল কর্মকাণ্ড থেকে সরিয়ে ধীরে ধীরে ‘অকার্যকর’ করে ফেলা হয়। মন্ত্রণালয়ের সচিব (পূর্ব) নজরুল ইসলাম যখন ১৫ মে টোকিওতে পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকে নেতৃত্ব দেন—পররাষ্ট্রসচিবের অনুপস্থিতিতে—তখন থেকেই দৃশ্যত স্পষ্ট হয়, জসীমকে অন্তঃসারশূন্য করে ফেলা হয়েছে। সরকারি ব্যাখ্যা অবশ্য বলছে, তিনি ‘নিজেই সরে যেতে চেয়েছেন’। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, এটি ছিল কৌশলগত ‘অব্যাহতি’। কারণ, সরকারের ভেতরে একটি সক্রিয় শক্তি—যাদের দৃষ্টিভঙ্গি হলো, অতীতের ক্ষত না খুঁড়ে 'সহজ সম্পর্কনীতি' অনুসরণ করা, বিশেষ করে পাকিস্তানের সঙ্গে। তাদের মতে, ভূরাজনীতিতে দক্ষিণ-পন্থী কৌশলই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ।

এই লবির শক্তিমত্তা বোঝা যায় একটি চমকপ্রদ ভারসাম্যহীনতা থেকে। পুরো কৃষি খাতের জন্য নেই কোনো ডেডিকেটেড উপদেষ্টা। বিদ্যুৎ, রেল, সড়ক—তিনটি বৃহৎ মন্ত্রণালয় মিলিয়ে আছেন মাত্র একজন উপদেষ্টা। অথচ শুধু পররাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে চারজন উপদেষ্টা-সহকারী কাজ করছেন:

১. তৌহিদ হোসেন – প্রধান পররাষ্ট্র উপদেষ্টা
২. খলিলুর রহমান – রোহিঙ্গা ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা
৩. লুৎফে সিদ্দিকী – আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশেষ দূত
৪. সুফিউর রহমান – পররাষ্ট্রবিষয়ক বিশেষ সহকারী (নিয়োগপ্রাপ্ত, তবে এখনো যোগ দেননি)

এই প্রাতিষ্ঠানিক গঠন একটি প্রশ্ন তুলে দেয়—এটা কি একটি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জনসমর্থন পেয়ে ক্ষমতায় বসা সরকারের পররাষ্ট্রনীতি, না কি কোনো সুগভীর বিদেশ-সংশ্লিষ্ট ছায়া-চক্রের এজেন্ডা বাস্তবায়নের কাঠামো ?

সবচেয়ে বেশি আলোচনা এখন ঘিরে আছে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমানকে। রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে তিনি জাতিসংঘের সঙ্গে যৌথভাবে ‘রাখাইন করিডর’ এবং ‘সেফ জোন’ তৈরির প্রস্তাব দেন। জসীম উদ্দিন এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন—এটি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে। উনার মতে করিডোর দেয়া হলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন আরো কঠিন হয়ে পড়বে। এই মতপার্থক্যই জসীমের পতনের মূল কারণ বলে কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়। এমনকি, ক্ষমতাসীন অন্তর্বর্তী সরকারে অধ্যাপক ইউনূসের পদত্যাগ-চিন্তার কারণ নাকি বিএনপির খলিলুর রহমানকে অপসারণের দাবীর প্রতিক্রিয়া বলে গুঞ্জন রয়েছে। প্রশ্ন ওঠে—একজন ‘বিতর্কিত উপদেষ্টা’কে কেন্দ্র করে যদি সরকার টলে যায়, তবে কে চালায় রাষ্ট্রযন্ত্র?

জসীম উদ্দিনের সরে যাওয়া কোনো ব্যক্তিগত প্রশাসনিক ঘটনা নয়। এটি একটি আদর্শিক পররাষ্ট্রনীতির পতন, এবং তার জায়গায় এক ধরনের আপসপ্রবণ ‘ছায়া কূটনীতি’র উত্থান। যেখানে অতীতের রক্তক্ষয় ভুলে ‘সৌহার্দ্য’র নামে আপস হয়, সেখানে ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি যেন কেবল জাতীয় দিবসের বক্তৃতায় সীমাবদ্ধ। পররাষ্ট্রনীতিতে জাতীয় স্মৃতি, বিচার, এবং দায়িত্ববোধকে একপাশে রেখে যদি কেবল জিওপলিটিক্যাল মেকানিকস হয় নীতি, তবে সেই রাষ্ট্র আর কতোটা এগোবে?

বাংলাদেশ এখন একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে—যেখানে পররাষ্ট্রনীতির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্বন্দ্ব একদিকে ইতিহাসকে, অন্যদিকে বাস্তবতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এই দ্বন্দ্ব শুধু একজন জসীম উদ্দিনের নয়, এটি স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পতন উত্তর পররাষ্ট্রচিন্তার আত্মপরিচয়ের প্রশ্ন। "ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ" কী আদর্শে চলবে —ঐতিহাসিক ন্যায়বিচারে, না ছায়া-শক্তির সঙ্গে সমঝোতায়—এটাই এখন সবচেয়ে জরুরি প্রশ্ন।


সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে মে, ২০২৫ রাত ১০:১৮
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ইউনুস সাহেবকে আরো পা্ঁচ বছর ক্ষমতায় দেখতে চাই।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪৪


আইনশৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি পুরো ১৫ মাস ধরেই ছিলো। মব করে মানুষ হত্যা, গুলি করে হত্যা, পিটিয়ে মারা, লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার করতে না পারা, পুলিশকে দূর্বল করে রাখা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির যাত্রা কবরে, খুনি হাসছে ভারতে...

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৬

হাদির যাত্রা কবরে, খুনি হাসছে ভারতে...

শহীদ ওসমান বিন হাদি, ছবি অন্তর্জাল থেকে নেওয়া।

হ্যাঁ, সত্যিই, হাদির চিরবিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার এই মুহূর্তটিতেই তার খুনি কিন্তু হেসে যাচ্ছে ভারতে। ক্রমাগত হাসি।... ...বাকিটুকু পড়ুন

'জুলাই যোদ্ধারা' কার বিপক্ষে যুদ্ধ করলো, হ্তাহতের পরিমাণ কত?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৫১



সর্বশেষ আমেরিকান ক্যু'কে অনেক ব্লগার "জুলাই বিপ্লব" ও তাতে যারা যুদ্ধ করেছে, তাদেরকে "জুলাই যোদ্ধা" ডাকছে; জুলাই যোদ্ধাদের প্রতিপক্ষ ছিলো পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, ছাত্রলীগ; জুলাই বিপ্লবে টোটেল হতাহতের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিকে মারল কারা এবং ক্রোধের আক্রশের শিকার কারা ?

লিখেছেন এ আর ১৫, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:০৩

হাদিকে মারল কারা এবং ক্রোধের আক্রশের শিকার কারা ?


হাদিকে মারল জামাত/শিবির, খুনি নাকি ছাত্রলীগের লুংগির নীচে থাকা শিবির ক্যাডার, ডাকাতি করছিল ছেড়ে আনলো জামাতি আইনজীবি , কয়েকদিন হাদির সাথে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির হত্যাকান্ড ও সরকারের পরবর্তি করণীয়!

লিখেছেন আহলান, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:৫১

হাদির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। সে দেশকে ভালোবেসে, দেশের মানুষকে ইনসাফের জীবন এনে দিতে সংগ্রাম করেছে। তাকে বাঁচতে দিলো না খুনিরা। অনেক দিন ধরেই তাকে ফোনে জীবন নাশের হুমকি দিয়ে এসেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×