somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সংস্কার না মানলে কুরআন অবমাননা করা হবে ?

০১ লা জুন, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:৪৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামির মতো দলগুলোর রাজনীতি বিশ্লেষণ করলে একটা গভীর সংকট চোখে পড়ে: এদের কাছে দল ও ধর্মের পার্থক্য প্রায় নেই বললেই চলে। ফলে দলীয় বিরোধিতা মানেই হয়ে ওঠে ধর্মবিরোধিতা। আপনি জামায়াতের রাজনৈতিক অবস্থানের বিরোধিতা করলেন? আপনি 'ইসলামের শত্রু', 'মুরতাদ', কিংবা 'ইসলামবিদ্বেষী গাদ্দার'—এই ভাষার ব্যবহারই বলে দেয়, এদের কাছে রাজনৈতিক মতভেদ মানে ঈমান-আক্বিদার লড়াই।

এজন্যই জামায়াতে ইসলামির মতো দলের পক্ষে প্রতিপক্ষের প্রতি গণতান্ত্রিক সহনশীলতা দেখানো চাইলেও সম্ভব না। কারণ তাদের কাছে দল আর ধর্ম এক। ফলে দলের বিরোধীতাকে এরা ধর্ম বিরোধীতা হিসেবে দেখে এবং প্রতিপক্ষকে ধর্ম বিরোধী হিসেবে ট্রিট করে। এটা শুধু একজনের হুট করে বলা কোন কথা না। মিশরে আরব বসন্তের পর ঠিক এরকমই হয়েছিলো। মুসলিম ব্রাদারহুড মুখে সহনশীলতা আর ইনক্লুসিভনেসের কথা বলে ভোটে জিতে ক্ষমতায় গিয়ে সামান্য বিরোধীতাকেও ধর্ম বিরোধীতা হিসেবে ট্রিট করে অল্প কিছু দিনের মধ্যেই গণতন্ত্রকামী মানুষের প্রবল অজনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল।

এটা কেবল মিশরের অভিজ্ঞতা নয়—এটা আইডেন্টিটি পলিটিক্সের মধ্যে লুকিয়ে থাকা এক ‘ধর্মীয় টোটালিটারিজম’-এর চিহ্ন। হান্না আরেন্ড্ট টোটালিটারিয়ান রাজনীতির যেটা মূল চিহ্ন হিসেবে দেখিয়েছেন তা হলো—কোনো একক মতাদর্শের নামে বহুস্বরকে দমন করা। একমাত্র ‘সত্য’ যেটি রাষ্ট্রঘোষিত, সেটিই টিকে থাকবে, বাকিরা বা তো “গণবিরোধী”, বা “ধর্মবিরোধী”।

জামায়াতও এই চর্চায় এক্সপার্ট। তারা এখনও ১৯৭১ সালের গণহত্যার দায় অস্বীকার করে যায়- ক্ষমা চাওয়া তো দূরের কথা! অথচ যেসব দেশ গণতন্ত্র চর্চার পথে এগিয়েছে, তারা এক পর্যায়ে এসে ‘ঐতিহাসিক আত্মশুদ্ধি’ করেছে—জার্মানির নাৎসি-পরবর্তী দুঃস্মৃতির বিচার, দক্ষিণ আফ্রিকার 'ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন', রুয়ান্ডার গণহত্যা ট্রায়াল—সবই এই আত্মসমালোচনামূলক চর্চার অংশ। কিন্তু জামায়াত কি সেই পথে হাঁটতে আগ্রহী? মোটেই না। বরং তারা তাদের ইতিহাসকে বীরত্বগাঁথায় রূপ দিতে চায়। এটাই তো গ্রামসির সেই 'hegemony'-র কৌশল: ইতিহাসকে এমনভাবে লিখো, যাতে মানুষ ভুলে যায় কী ঘটেছিল, আর বিশ্বাস করে কী ঘটেনি।

এদের কাছে গণতন্ত্র মানে “ভোট যতদিন আমাদের দরকার”—তারপর রাষ্ট্রযন্ত্রের পূর্ণ দখল। মুসলিম ব্রাদারহুড মিশরে সেই চর্চা করেছিল। মুখে ইনক্লুসিভ, ভিতরে এক্সক্লুসিভ। ক্ষমতায় গিয়ে তারা রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতিটি স্তরে নিজেদের নিয়োগ দেয়—মতপ্রকাশের স্বাধীনতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়, বিরোধীদের ওপর ‘ইসলামবিরোধী’ তকমা সাঁটানো হয়। মিশেল ফুকো বলেছিলেন, “Power produces truth. যারা ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করে তারা যেই ‘সত্য’ নির্মাণ করে, সেটাই হয় একমাত্র গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা। ফলে, আপনি যদি বলেন, “ধর্মের নামে অপরাজনীতি চলতে পারে না”—তারা আপনাকে বলে, “আপনি ধর্মবিরোধী। "

এভাবেই একটা ভাষা তৈরি হয়, যেটার মধ্যে ভিন্নমতের কোনো ঠাঁই থাকে না। ফুকোর কথায়, এই ডিসকোর্স আসলে ক্ষমতার একধরনের ছদ্মবেশ—সত্যের ভাষ্য নির্মাণ করে তারা তাদের ‘অসত্য’ ক্ষমতাকে বৈধতা দেয়। অন্যদিকে জামায়াত এবং তৎসদৃশ দলগুলো যখন “সংস্কার প্রস্তাব” দেয়, বা “গণতান্ত্রিক কাঠামোর” কথা বলে, তখন তারা আসলে একটি কৌশলগত ছায়াপথে হাঁটে। যেমন টার্কিশ AKP বা ইরানি শাসনব্যবস্থার ‘ছদ্ম-গণতন্ত্র’—যেখানে নির্বাচন আছে, কিন্তু বিকল্প নেই। এই যে ভিন্নমতের বিরুদ্ধে ‘ সো কল্ড ঈমানী যুদ্ধ’ চালানো হয়—তা কোনো আধুনিক রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক চর্চার ধারক হতে পারে না। জামায়াতের এই রাজনৈতিক ইসলাম এমন এক ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করে যেখানে ধর্ম হয়ে ওঠে *power apparatus*—এক ধরনের দমনমূলক শাসনকাঠামো, যেটি নির্বাচন দিয়ে শুরু হলেও শেষ হয় মতান্ধ ফ্যাসিবাদে।

আমরা যদি বাস্তবতা দেখি, তাহলে স্পষ্টভাবে বুঝি—এরা গণতন্ত্র চায় না, এরা চায় ভোটের বৈধতা নিয়ে নিজেরা রাষ্ট্র হয়ে যেতে। দলকে ধর্ম বানিয়ে ফেলা, ভিন্নমতকে ধর্মদ্রোহী ট্যাগ দেওয়া, অতীতের অপরাধের ক্ষমা না চাওয়া এবং ফুকো ও আরেন্ড্টের বিশ্লেষণে বোঝা যায়—এই রাজনীতি আসলে আধুনিকতার বিপরীতমুখী এক ধর্মীয় কর্তৃত্ববাদ। এটা ধর্ম নয়, এটা ‘ধর্ম কে ব্যবহার করা পাওয়ার স্ট্রাকচার’।

আপনি জামায়াতের ভোটাধিকার নিয়ে প্রশ্ন তুললে তারা বলবে, "আমরা তো গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি!" কিন্তু তারা কখনো বলবে না—"আমরা ৭১-এ ভুল করেছিলাম, আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত।" তাদের কাছে ইতিহাসও দলীয়, ধর্মও দলীয়, আর আপনি? আপনি শুধু কাফের, কারণ আপনি বেশি প্রশ্ন করেন।


সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জুন, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:৫২
১৫টি মন্তব্য ১৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ইউনুস সাহেবকে আরো পা্ঁচ বছর ক্ষমতায় দেখতে চাই।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪৪


আইনশৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি পুরো ১৫ মাস ধরেই ছিলো। মব করে মানুষ হত্যা, গুলি করে হত্যা, পিটিয়ে মারা, লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার করতে না পারা, পুলিশকে দূর্বল করে রাখা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির যাত্রা কবরে, খুনি হাসছে ভারতে...

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৬

হাদির যাত্রা কবরে, খুনি হাসছে ভারতে...

শহীদ ওসমান বিন হাদি, ছবি অন্তর্জাল থেকে নেওয়া।

হ্যাঁ, সত্যিই, হাদির চিরবিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার এই মুহূর্তটিতেই তার খুনি কিন্তু হেসে যাচ্ছে ভারতে। ক্রমাগত হাসি।... ...বাকিটুকু পড়ুন

'জুলাই যোদ্ধারা' কার বিপক্ষে যুদ্ধ করলো, হ্তাহতের পরিমাণ কত?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৫১



সর্বশেষ আমেরিকান ক্যু'কে অনেক ব্লগার "জুলাই বিপ্লব" ও তাতে যারা যুদ্ধ করেছে, তাদেরকে "জুলাই যোদ্ধা" ডাকছে; জুলাই যোদ্ধাদের প্রতিপক্ষ ছিলো পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, ছাত্রলীগ; জুলাই বিপ্লবে টোটেল হতাহতের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিকে মারল কারা এবং ক্রোধের আক্রশের শিকার কারা ?

লিখেছেন এ আর ১৫, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:০৩

হাদিকে মারল কারা এবং ক্রোধের আক্রশের শিকার কারা ?


হাদিকে মারল জামাত/শিবির, খুনি নাকি ছাত্রলীগের লুংগির নীচে থাকা শিবির ক্যাডার, ডাকাতি করছিল ছেড়ে আনলো জামাতি আইনজীবি , কয়েকদিন হাদির সাথে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির হত্যাকান্ড ও সরকারের পরবর্তি করণীয়!

লিখেছেন আহলান, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:৫১

হাদির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। সে দেশকে ভালোবেসে, দেশের মানুষকে ইনসাফের জীবন এনে দিতে সংগ্রাম করেছে। তাকে বাঁচতে দিলো না খুনিরা। অনেক দিন ধরেই তাকে ফোনে জীবন নাশের হুমকি দিয়ে এসেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×