
নির্বাচনের সময় আমাদের প্রিয় নেতারা হয়ে ওঠেন জীবন্ত কবি গুরু। সোনার বাংলা গড়ব থেকে প্রতিটি ঘরে বিদ্যুৎ সবই শোনায় রবীন্দ্রনাথের গানের মতো । ২০১৮ সালের প্রচারণায় যখন বলা হয়েছিল : ২০২৪-এর মধ্যে গ্যাস-বিদ্যুৎ সবার ঘরে পৌঁছে যাবে তখন মঞ্চে তালি পড়েছিল ঝড়ের মতো। কিন্তু ক্ষমতায় বসার সাথে সাথেই কবি মারা গেলেন, জন্ম নিল এক নিরস সরকারি কেরানি যিনি কিনা ফাইল ঘেঁটে বলছেন: “প্রশাসনিক জটিলতা আছে।"
নেতারা কখনো University of Lies থেকে পাশ করেননি, কিন্তু মনে হয় তারা সেখান থেকে গোল্ড মেডেল পেয়েছেন। একবার এক মন্ত্রী বললেন, “চালের দাম কমেছে”। পরের দিন বাজারে গিয়ে দেখা গেল, কমেছে শুধু সরকারি পরিসংখ্যানে। এই পারফরম্যান্স দেখে বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলোও ঈর্ষান্বিত। সরাসরি মিথ্যা পরিবেশন তেতো, তাই তারা বানান সত্য-মিথ্যার চা । এক কাপ চায়ে এক চামচ সত্য, দশ চামচ মিথ্যা, আর অনেকটা চিনি (মধুর কথাবার্তা)। যেমন: মাথাপিছু আয় বেড়েছে যা সত্য, কিন্তু সেই আয়ের বেশিরভাগ ঢাকায় গুটিকয়েক লোকের হাতে; মিথ্যা হলো সবাই সমানভাবে লাভবান।
১৯৯৮ সালে জন ট্রাভোল্টার "প্রাইমারি কালারস" সিনেমায় একটা চরিত্র বলেছিল: "নেতা হতে হলে মিথ্যা বলতে হয়, পরে ভালো কাজ করে সেটার প্রায়শ্চিত্ত করা যায়।" আমাদের নেতারা এই ফর্মুলার প্রথম অংশটা (মিথ্যা বলা) এত নিখুঁতভাবে আয়ত্ত করেছেন যে, দ্বিতীয় অংশটা (প্রায়শ্চিত্ত) একেবারে ভুলে গেছেন। এটা অনেকটা রেসিপি দেখে রান্না করতে গিয়ে শুধু লবণ দেয়া, আর চিনি দিতে ভুলে যাওয়ার মতো।
তৃতীয় বিশ্বের বিশেষত্ব হলো, এখানে রাজনীতিবিদরা সাধারণ মানুষ থেকে রূপান্তরিত হয়ে যান "রাজনৈতিক দেবতা"য়। তাদের প্রতিটি কথা হয় ধর্মগ্রন্থের আয়াত, প্রতিটি সিদ্ধান্ত হয় ঐশী আদেশ। এবং সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো এই দেবতারা কখনো ভুল করেন না ! যদি মনে হয় ভুল হয়েছে, তাহলে সেটা আমাদের বোঝার ভুল। দেবতার ভুল হওয়া তো অসম্ভব !
আমাদের নেতাদের একটি বিশেষ রোগ আছে : "Error Acknowledgment Allergy" বা "ভুল স্বীকার অ্যালার্জি"। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি নিজের ভুল স্বীকার করার সময় তীব্র চুলকানি, গলায় ব্যথা এবং মাথা ঝিমঝিম করার অনুভূতি পান। তাই তারা সব ভুলকে বলেন "গুজব", "বিভ্রান্তি" বা "শত্রুদের ষড়যন্ত্র"। এই রোগের কোনো চিকিৎসা নেই, কারণ রোগীরা মনে করেন তারা সুস্থ!
ফরাসি দার্শনিক দিদেরত ঠিকই বলেছেন, মানুষ মিথ্যা প্রশংসা গোগ্রাসে গিলে ফেলে। আমাদের জনগণের পেট এত শক্তিশালী যে তারা যে কোনো পরিমাণ মিথ্যা হজম করতে পারে। রিজারভ বেড়েই চলেছে শুনে তালি দেয়, কিন্তু বাজার থেকে চাল কিনতে গিয়ে কাঁদে। দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ শুনে জয়ধ্বনি দেয়, কিন্তু বিদেশে চাকরির জন্য দালালের কাছে টাকা দিয়ে সব হারায় । এটা এক অনন্য প্রতিভা!
গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটল ২৪০০ বছর আগে বলেছিলেন, গণতন্ত্রে চতুর দরিদ্ররা রাজনীতি ব্যবহার করে ধনী হয়। আমাদের দেশে এই ভবিষ্যদ্বাণী এত নিখুঁতভাবে পালিত হয়েছে যে, মনে হয় আমাদের নেতারা এরিস্টটলের গোপন শিষ্য। নির্বাচনের সময় গরিব জনতার সন্তান, ক্ষমতায় থাকার দশ বছর পর উন্নয়নের ঠিকাদার। এই রূপান্তর দেখে জাদুকর গোপাল ভাঁড়ও লজ্জা পেতেন। এরিস্টটল যদি আজ বেঁচে থাকতেন, হয়তো নিজের বইয়ের নতুন সংস্করণ বের করতেন যার শিরোনাম হতো, “রাজনীতিবিদের মিথ্যা: এক অনন্ত পুঁজি বিনিয়োগ”।
আমাদের নেতাদের অতিরিক্ত মিথ্যার কারণে দেশের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে, বিদেশি কূটনীতিকরা আমাদের সরকারি পরিসংখ্যান দেখে মুচকি হাসেন। আমাদের মন্ত্রীদের বক্তৃতা বিদেশি টিভি চ্যানেলে "Comedy Hour" এর অংশ হিসেবে দেখানো হয়। UNESCO আমাদের দেশকে "Creative Statistics" এর জন্য বিশেষ পুরস্কার দেওয়ার কথা ভাবছে।
পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোনো জাতির উদাহরণ নেই যারা মিথ্যার ভিত্তিতে দীর্ঘকাল সমৃদ্ধ ছিল। কিন্তু আমাদের নেতারা ইতিহাসকে নতুন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন। তারা প্রমাণ করতে চান যে, মিথ্যার উপর ভিত্তি করেও একটি জাতি উন্নয়নের মহাসড়কে এগিয়ে যেতে পারে। যদিও এখনো পর্যন্ত এই পরীক্ষার ফলাফল পেন্ডিং অবস্থায় রয়েছে।
বিশেষ সতর্কতা: এই লেখাটি সম্পূর্ণভাবে ব্যঙ্গাত্মক। যদি কোনো রাজনীতিবিদ এতে নিজেকে চিনতে পারেন, তাহলে বুঝতে হবে হয় আমাদের পর্যবেক্ষণ যথার্থ, নয়তো এটা শুধুই কাকতালীয় মিল। তবে যদি কেউ রেগে যান, তাহলে সেটাও একধরনের স্বীকারোক্তি !
। । সকল পাপের জননী' মিথ্যাচারই রাজনৈতিক হাতিয়ার - দৈনিক ইত্তেফাকের লেখা থেকে অনুপ্রাণিত । ।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই আগস্ট, ২০২৫ দুপুর ১:৫১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



