
জুলাই অভ্যুত্থানের পর দায়িত্ব নেয়া ইন্টেরিম সরকার একবছর শাসনকাল পার করেছে। কতটুকু সফল আর কতটুকু ব্যর্থ সেটা ইতিহাস বিচার করবে। এই গণঅভ্যুত্থানের শুরুটা হয়েছিল কোটা আন্দোলন দিয়ে তথা বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন হিসাবে। অভ্যুত্থানের পর দেখা গেল ছাত্রনেতাদের দাবীর সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। তবে দাবী দাওয়া যদি কল্যাণমুখী ও মানুষের কাজে লাগে তবে আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু আমাদের জুলাই বিপ্লবীরা কেবল নিদিষ্ট কিছু বিষয় কে ফোকাস করে এগুলেন। ইন্টেরিম সরকার তাদের অনুসরণ করে এগুতে শুরু করলো। জুলাই অভ্যুত্থান থেকে নানা মানুষের নানা চাহিদা। কিন্তু খুব কম রাজনৈতিক দল ও অভ্যুত্থানের সক্রিয় অংশ নেয়া মানুষজন কে দেখলাম বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও নাগরিকের ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা নিয়ে কথা বলতে । অভ্যুত্থানের পূর্বে যারা বিচারহীনতার সংস্কৃতি নিয়ে কথা বলে শেখ হাসিনার বিরাগভাজন হয়েছেন তারা নিজেদের অনুকুল সময়ে তেমন উচ্চবাচ্য করছেন না। এদের মাঝে আসিফ নজরুল স্যার কে বিশেষ ভাবে মনে পড়ে । তিনি শেখ হাসিনার আমলে বিচারহীনতা নিয়ে প্রচুর সমালোচনা করতেন। এখন স্যার আইন উপদেষ্টা হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন কিন্তু বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বাংলাদেশ কে মুক্তি দিতে উনার কোনো যথাযথ পদক্ষেপ চোখে পড়ছে না ।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিএনপির মহাসচিব হিসাবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করছেন। শেখ হাসিনার আমলে প্রায় সময় দেখতাম নতুন আইন হুকুমের আসামী হিসাবে মির্জা ফখরুল কে জেলে নেয়া হচ্ছে। আরো দেখতে পেতাম বিদেশ থেকে আনা নতুন ময়লার গাড়ি ভাংচুরের মামলায় মির্জা ফখরুল সাহেব কে গ্রেফতার দেখানো হচ্ছে। খুব অবাক লাগতো আবার হাসিও পেত ফখরুল সাহেব উনার বৃদ্ধ বয়সে ময়লার গাড়ি ভাংচুর করে দেশের বিরাট ক্ষতি করে ফেলেছেন। এক কথায় মামলার মেরিট খুবই দূর্বল ছিলো। এগুলো জাস্ট পলিটিক্যাল হ্যারেসমেন্ট করার হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত হতো। খুব করে চেয়েছিলাম এবং এখনো চাই অভ্যুত্থানের পর বিচারহীনতা ও ভুয়া মামলায় বাংলাদেশের একজন নাগরিক যাতে হয়রানির শিকার না হয়। রাজনৈতিক সরকার আসলে কতটুকু সে চাওয়া তারা পূরণ করতে পারবে সেটা নিয়ে সংশয় আছে কারণ আওয়ামী লীগ বিরোধী দলকে ভুয়া মামলা দিয়ে যে দৌড়ের উপর রেখেছিলো একই ভাগ্য হয়তো তাদেরকে বরণ করতে হবে। কিন্তু ইন্টেরিম সরকার অন্তত পরবর্তী সরকার কে দেখিয়ে যেতে পারতো যে দেখো কিভাবে মামলা ও বিচার করতে হয় । কিন্তু তারা পুরাতন বিচারহীনতার সংস্কৃতি টিকে থাকুক মনে হয় এমনটাই চায় ।
গতকাল ১৫ই আগস্ট শেখ মুজিবের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ধানমন্ডিতে এক রিকশাচালকের ফুল দেয়াকে কেন্দ্র করে অদ্ভুত কান্ড ঘটেছে। খুব সম্ভবত অটোরিকশা চালক আজিজুর রহমান নামে একজন ধানমন্ডিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতে গিয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকীতে। একজন শ্রমজীবী মানুষ শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকীতে ফুল দিতে যাওয়ার কেইস খুব ইন্টারেসটিং। সে একজন অটো রিকশা চালক। হতে পারে সে আওয়ামী লীগের কোনো প্রত্যন্ত অঞ্চলের কর্মী বা সমর্থক যে কিনা কাজের সন্ধানে ঢাকায় এসেছে অথবা পালিয়ে এসেছে। অটো রিকশা চালকদের মাঝে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের সাপোর্টার যদি বেশি থাকে সেটা অবাক হওয়ার কিছুই নেই। অটোরিকশা বাংলাদেশে চালুই হয়েছে শেখ হাসিনার সময়ে। এমনও হতে পারে তার পূর্বপুরুষ আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলো। সে যাই হোক না কেন সে ফুল দিতে এসেছে তাকে সেখানে বাধা তো দিয়েছেই বলদের দল সাথে ফ্রী গণপিটুনি দিয়েছে। লোকটা বারবার বলতে শুনলাম : শেখ হাসিনাকে ফেরাতে নয় বরং শেখ মুজিবুর রহমান কে শ্রদ্ধা জানাতে তার হালাল টাকায় ধানমন্ডি ৩২ নং এর বাড়িতে গিয়েছে। বলদের দল দাবী করেছে, তাকে আওয়ামী লীগ এক মাস ট্রেনিং দিয়েছে এই কাজ করার জন্য; তার অটোরিকশা ভাংচুর করা হয়েছে। ভেবেছিলাম ঘটনা এখানেই শেষ কিন্তু আজিজুর রহমানের জন্য আরো সারপ্রাইস ওয়েট করছিলো।
পুলিশ আজিজুর রহমান কে গ্রেফতার করে। আজকে তাকে আদালতে হাজির করা হয়। আর তখনই প্রকাশ পেলো আজিজ মিয়াকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে এক পুরাতন জুলাই হহত্যাচেষ্টা মামলায়। ২০২৪ সালের ৪ঠা আগস্ট নিউমার্কেট-সায়েন্সল্যাব এলাকায় জুলাই আন্দোলনের মিছিলে হামলা হয়। অভিযোগ হচ্ছে: গুলি, পেট্রোল বোমা ও হাতবোমা ছোড়া, গুলিবিদ্ধ হন এক তরুণ আরিফুল ইসলাম। পরে তিনি সুস্থ হন এবং ২০২৫ সালের দোসরা এপ্রিল প্রায় আটমাস পর থানায় মামলা দায়ের করেন। সেখানে প্রায় একশত জনকে আসামি হিসাবে দেখানো হয়েছিলো। এক বছর পর ফুল দিতে আসা সাধারণ রিকশাচালক আজিজুর কে সেই মামলার আসামী দেখানো হলো। পুলিশের ভাষ্য হচ্ছে প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানে তার সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেছে। প্রত্যক্ষদর্শী কিভাবে আজিজুর রহমানকে একবছর পর চিনতে পারলেন? এতদিনে কেন তাকে খুজে পাওয়া গেল না ? আজিজুর রহমান যদি ধানমন্ডি ৩২ এ না যেতেন, তাহলে কি এই মামলায় জড়ানো হতো ? তার অপরাধ ছিলো ভুল সময়ে ভুল জায়গায় থাকা; মামলাটি করা হয়েছে তার রাজনৈতিক কর্মকার্ন্ডের কারনে, আসল অপরাধের জন্য নয়।
আজিজুর রহমান কে যারা মেরেছে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি? নাকি প্রেসার গ্রুপ বলে তাদের কার্যক্রমকে বৈধতা দিয়েই যাবে ইন্টেরিম সরকার ? আগে দেখতাম বিরোধী দল কর্মসূচি দিলেই হেলমেট বাহিনী পুলিশ কে সহায়তা করার জন্য মাঠে থাকতো এখন দেখছি মব বাহিনী সে দায়িত্ব হাতে তুলে নিয়েছে। যারা এতদিন ওয়াজ করতেন আর যারা এখন নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের আলাপ তুলছে তারা এই ঘটনা নিয়ে কি ভাবছে মিডিয়া তাদের সে প্রশ্ন করবে না। আমরা বনাম ওরা মানসিকতা কি পরিহার করা গেল? গণতন্ত্র ফিরিয়ে দেয়ার নামে ক্রমশ দেখতে পাচ্ছি সহিংসতা কে জনগণের ইচ্ছা হিসেবে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা শুরু হয়েছে। এটাকে উন্নত বিশ্বের লোকজন গনতান্ত্রিক মূল্যবোধের অবক্ষয় হিসাবে দেখে। তবে ইন্টেরিম সরকার যদি নতুন ধরণের গণতান্ত্রিক ফিলোসফি উন্নত বিশ্বকে পাশ কাটিয়ে প্রতিষ্ঠা করতে চায় তবে সেটা আলাদা বিষয়।
ইন্টেরিম সরকার এই ঘটনায় রিকশাচালক কে গ্রেফতার করে মুলত নিষিদ্ধ দলের নেতা কর্মীর পাশাপাশি কি সাধারণ জনগণকে কোনো বার্তা দিতে চেয়েছে ? মানুষের মনের ইচ্ছে কি এভাবে দমিয়ে রাখা সম্ভব ? আজিজুর রহমান যদি সত্যিই কোনো অপরাধ করে থাকেন তাহলে সেটার বিচার হোক। ১৫ই আগস্ট শোক দিবস পালন করা যাবে না সরকার থেকে কোনো আইনি বিধিনিষেধ পাশ করতে দেখলাম না। তাহলে কিসের উপর ভিত্তি করে একজন মানুষকে এক বছর আগের পুরাতন মামলায় গ্রেফতার দেখানো হচ্ছে? একই অপরাধের জন্য একবার গণপিটুনি আবার কারাবাস ভোগ করা সমাজে বিচারহীনতার সংস্কৃতি যে এখনো বিদ্যমান সেটাই আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো। একজন রিকশাচালক ধানমন্ডি ৩২ নাম্বারে ফুলের তোড়া নিয়ে পালটা অভ্যুত্থান ঘটাবে সেই ভয়ে ইন্টেরিম মনে হয় কেপে উঠেছিল। এত কাপাকাপির কিছু নেই। যতদিন আছেন ক্ষমতায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখলেই জনগণ সন্তুষ্ট থাকবে। এর চেয়ে বেশি প্রত্যাশা ইন্টেরিমের কাছে কেউ করে না।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই আগস্ট, ২০২৫ দুপুর ১:০৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



