somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পাকিস্তানের জেনারেল আসিম মুনির এবং প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ ঢাকায় এলেই ষোলোকলা পূর্ণ হবে।

২২ শে আগস্ট, ২০২৫ রাত ১০:৩৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


২০২৫ সালের আগস্ট মাসে ঢাকায় পাকিস্তানি কূটনীতিকদের আনাগোনা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। পররাষ্ট্র সচিব, বাণিজ্যমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, এমনকি উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী সহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা একের পর এক ঢাকা সফর করছেন। নতুন হাইকমিশনারও দ্রুত এসে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। এক বছরের মধ্যে এত ঘন ঘন সফর দেখে মনে হয় যেন ইসলামাবাদে 'ঢাকা ট্যুরিজম উইক' চলছে। গত এক দশক ধরে সীমিত পর্যায়ে থাকা বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক হঠাৎ করেই কেন এমন সক্রিয় হয়ে উঠল? এটা কি নিছক বাণিজ্যিক আগ্রহ, নাকি এর পেছনে লুকিয়ে আছে গভীর ভূরাজনৈতিক কৌশল ?

বাংলাদেশে এখন ইনটেরিম সরকার ক্ষমতায়। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অনেক দেশের নেতারা ঢাকা সফর বাতিল বা স্থগিত করেছেন। সৌদি আরবের বাদশাহ বা ইতালির প্রধানমন্ত্রীর মতো বিশ্বনেতারা এ মুহূর্তে বাংলাদেশে আসা নিরাপদ মনে করছেন না। কিন্তু পাকিস্তান যেন উল্টো পথে হাঁটছে। অন্যরা যখন সাবধানতা অবলম্বন করছে, তখন তারা ঢাকায় কূটনীতিকদের ভিড় বাড়াচ্ছে। এটা কি শুধুই কাকতালীয় ? নাকি অস্থির পরিস্থিতিকেই তারা নিজেদের স্বার্থ হাসিলের সুবর্ণ সুযোগ হিসেবে দেখছে ? যখন কোনো দেশ দুর্বল ও অস্থির থাকে, তখন প্রতিবেশী দেশগুলো প্রায়শই নিজেদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে। পাকিস্তানও কি সেই কৌশলই অনুসরণ করছে?

১৫ বছরের বিরতির পর ঢাকায় এসেছেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব আমনা বালুচ। তার নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত হয়েছে পররাষ্ট্র দপ্তরের পরামর্শ সভা। তার আগমন এই বার্তা দেয় যে পাকিস্তান আর বাংলাদেশকে 'ইতিহাসের বন্ধ অধ্যায়' হিসেবে দেখে না, বরং একটি নতুন কূটনৈতিক অধ্যায় শুরু করতে প্রস্তুত। প্রশ্ন হলো, ১৫ বছর পর হঠাৎ এই আগ্রহ কেন? রাজনৈতিক অস্থিরতার এই মুহূর্তে হঠাৎ পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের আলোচনা কেন? কী এমন পরিবর্তন হয়েছে যে পাকিস্তান এখন বাংলাদেশকে 'গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার' মনে করছে?

পাকিস্তান সফরে এসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহসিন রাজা নাকভি মাদক ও সন্ত্রাস দমন, পুলিশ প্রশিক্ষণ এবং কূটনৈতিক পাসপোর্টে অন-অ্যারাইভাল ভিসার মতো বিষয়ে আলোচনা করেছেন। আপাতদৃষ্টিতে নিরাপত্তা ইস্যুতে সহযোগিতার নামে তারা আসলে পারস্পরিক আস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশের নাজুক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে পাকিস্তান নিজেদের 'বিশ্বস্ত অংশীদার' হিসেবে তুলে ধরতে চাইছে। কিন্তু এটা কি নিছক কাকতালীয়? নিরাপত্তা সহযোগিতার আড়ালে কি পাকিস্তানের ISI বাংলাদেশে কোনো গোপন নেটওয়ার্ক তৈরি করার চেষ্টা করছে? অন্তর্বর্তী সরকারের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তারা কি বাংলাদেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে?

চার দিনের সফরে ঢাকায় এসে বাণিজ্যমন্ত্রী জাম কামাল খান ব্যবসায়ী মহলের সঙ্গে বৈঠক করেছেন এবং বিভিন্ন শিল্প এলাকা পরিদর্শন করেছেন। পাকিস্তান জানে যে বাংলাদেশের ফার্মাসিউটিক্যাল ও টেক্সটাইল বাজার দক্ষিণ এশিয়ার জন্য 'গেমচেঞ্জার'। তাই এই সফরের লক্ষ্য কেবল বাণিজ্য নয়, বরং অর্থনৈতিক সম্পর্কের মাধ্যমে রাজনৈতিক সেতুবন্ধন তৈরি করা। রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়ে যেখানে বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকি নিতে ভয় পায়, সেখানে পাকিস্তানি বাণিজ্যমন্ত্রী এসে চুক্তি করছেন। এর আসল উদ্দেশ্য কি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সফলতায় অংশীদার হওয়া, নাকি রাজনৈতিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে এই অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করার পথ খোঁজা ?

উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারের ঢাকায় আগমন একটি প্রতীকী পদক্ষেপ। পাকিস্তান বোঝাতে চাইছে যে তারা বাংলাদেশের নতুন সরকারকে উচ্চ মর্যাদা দিচ্ছে এবং দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে প্রস্তুত। কিন্তু এই 'উচ্চ মর্যাদা' দেওয়ার উদ্দেশ্য কী? যখন অন্যান্য দেশের নেতারা বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে সফর স্থগিত করছেন, তখন পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী এসে সমঝোতা স্মারক সই করবেন ঢাকায় এসে। এটা কি সত্যিই বন্ধুত্বের হাত বাড়ানো, নাকি দুর্বল মুহূর্তে অন্তর্বর্তী সরকারকে পাকিস্তানের পক্ষে টানার চেষ্টা ? নতুন সরকারের 'বৈধতা' দিয়ে পাকিস্তান আসলে কী পেতে চায়?

আগের হাইকমিশনার সৈয়দ মারুফ হঠাৎ ছুটিতে চলে যাওয়ার পর নতুন হাইকমিশনার ইমরান হায়দারকে দ্রুত ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। এই তাড়াহুড়োর মধ্যে একটি বার্তা লুকিয়ে আছে : বাংলাদেশে পাকিস্তানের স্বার্থ এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক পরিবর্তনের সময়ে এই দ্রুত বদল কি নিছক প্রশাসনিক ব্যাপার? নাকি নতুন পরিস্থিতিতে আরও অভিজ্ঞ ও প্রভাবশালী কূটনীতিকের প্রয়োজন অনুভব করেছে পাকিস্তান? নতুন হাইকমিশনারের প্রথম কাজই হতে পারে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক তৈরি করা।

এক বছরে একটি দেশ থেকে এতজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার একসঙ্গে অন্য দেশে যাওয়া সাধারণ কূটনৈতিক প্র্যাকটিস নয়। এটি আসলে 'Diplomatic Blitzkrieg' একটি সমন্বিত কূটনৈতিক আক্রমণ। শেখ হাসিনার পতনের পর যে রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়েছে, পাকিস্তান সেই সুযোগ নিচ্ছে। তারা জানে, এখনই সময় 'স্ট্রাইক করার'। অন্তর্বর্তী সরকার এখনো পুরোপুরি স্থিতিশীল নয়, পররাষ্ট্রনীতি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। এই মুহূর্তে পাকিস্তান তাদের অবস্থান মজবুত করতে চাইছে।

এই তৎপরতার সবচেয়ে বড় উদ্দেশ্য ভূরাজনীতি। পাকিস্তান ভালো করেই জানে, বাংলাদেশে ভারতের প্রভাব কেমন। তাই একসঙ্গে এত সফর করে তারা একটা স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে: ঢাকার রাজনীতিতে তারা একটি সক্রিয় খেলোয়াড় হতে চায়। আফগানিস্তানে তালেবানের সঙ্গে তাদের রিলেশন , চীনের সঙ্গে CPEC প্রকল্প এবং এখন বাংলাদেশে হঠাৎ আগ্রহ এসব কি কেবলই কাকতালীয় ঘটনা? রাজনৈতিক অস্থিরতার এই সময়ে পাকিস্তানের এত তৎপরতা একটি কৌশলগত বার্তা দেয়। তারা চায় বাংলাদেশের নতুন নেতৃত্ব যেন বোঝে যে ভূরাজনৈতিক সমীকরণে পাকিস্তানও এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর।

অনেকে ভাবতে পারেন, পাকিস্তানি কূটনীতিকদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখা স্বাভাবিক, যেমন ভারতের সঙ্গে রাখা হয়। কিন্তু এই যুক্তির কয়েকটি দুর্বলতা আছে। প্রথমত, ভারত এভাবে একসঙ্গে এত মন্ত্রী পাঠায় না। তাদের কূটনীতিক সফরগুলো পরিকল্পিত এবং দীর্ঘমেয়াদী কৌশলের অংশ। দ্বিতীয়ত, পাকিস্তানের ইতিহাস ভিন্ন। ১৯৭১ সালে যে দেশ বাংলাদেশের জন্মের বিরোধিতা করেছিল, তাদের হঠাৎ 'বন্ধুত্বের হাত বাড়ানো' কি সত্যিই নির্দোষ? রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়ে এমন সক্রিয়তা আরও সন্দেহজনক করে তোলে। তৃতীয়ত, আফগানিস্তান এবং তালেবান ফ্যাক্টর। পাকিস্তনের এখনও তালেবানের সঙ্গে যোগাযোগ আছে। তাদের হঠাৎ বাংলাদেশের প্রতি আগ্রহ কি কেবল বাণিজ্যিক? এর সঙ্গে কি র‍্যাডিক্যালিজমের কোনো সংযোগ আছে?

ঢাকায় পাকিস্তানি কূটনীতিকদের এই ব্যস্ত সফর নিছক বাণিজ্য আলোচনা নয়, বরং দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতির এক নতুন অধ্যায়ের ইঙ্গিত। পাকিস্তান তার ৫৪ বছরের 'হারানো প্রেম' ফিরে পাওয়ার চেষ্টায় নেমেছে। আর বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা তাদের কাছে সুবর্ণ সুযোগ হিসেবে ধরা দিয়েছে। অন্যান্য দেশ যখন অস্থির পরিস্থিতিতে দূরত্ব বজায় রাখছে, তখন পাকিস্তান উল্টো পথে হাঁটছে। এই কৌশল কি সফল হবে? আমরা কি এই সক্রিয়তাকে কেবল অর্থনৈতিক সুযোগ হিসেবে দেখব, নাকি এর আড়ালে লুকিয়ে থাকা রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশে জড়িয়ে পড়ব ? ইতিহাসের শিক্ষা হলো যখন পাকিস্তান হঠাৎ করে 'বন্ধুত্বের হাত' বাড়ায়, বিশেষ করে রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়ে, তখন সেই হাতে কী লুকানো আছে তা ভালো করে দেখে নেওয়া উচিত।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে আগস্ট, ২০২৫ দুপুর ১২:১৬
১২টি মন্তব্য ১২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৪৪



বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

কেন বিএনপি–জামায়াত–তুরস্ক প্রসঙ্গ এখন এত তপ্ত?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে একটি পরিচিত ভয়–সংস্কৃতি কাজ করেছে—
“র”—ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে রাজনীতিতে গুজব,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুহূর্ত কথাঃ সময়

লিখেছেন ফাহমিদা বারী, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৩৭



সামুতে সবসময় দেখেছি, কেমন জানি ভালো ব্লগাররা ধীরে ধীরে হারিয়ে যায়! যারা নিয়মিত লেখে, তাদের মধ্যে কেউ কেউ প্রচণ্ড নেগেটিভ স্বভাবের মানুষ। অন্যকে ক্রমাগত খোঁচাচ্ছে, গারবেজ গারবেজ বলে মুখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিশ্চিত থাকেন জামায়েত ইসলাম এবার সরকার গঠন করবে

লিখেছেন সূচরিতা সেন, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৪২


আমাদের বুঝ হওয়ার পর থেকেই শুনে এসেছি জামায়েত ইসলাম,রাজাকার আলবদর ছিল,এবং সেই সূত্র ধরে বিগত সরকারদের আমলে
জামায়েত ইসলামের উপরে নানান ধরনের বিচার কার্য এমন কি জামায়েতের অনেক নেতা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×