
জ্ঞানীরা বলেন, "আপনি যত বেশি চুপ থাকবেন আপনার তত ভুল কম হবে।" মুখ খুললেই বিপদ! কিন্তু আমাদের দেশের সরকারি কর্তাব্যক্তিরা যেন এই নিয়মের ঠিক উল্টোটা মানেন। তারা মনে করেন, "যত বেশি কথা বলবেন, তত বেশি জনপ্রিয় হবেন।"
বাংলাদেশের সরকারে থাকা ব্যক্তিবর্গের জন্য "কম কথা বলার সুবিধা সংক্রান্ত ট্রেনিং কোর্স" চালু করা অত্যন্ত জরুরি। এই কোর্সে দেখানো হবে সরকারি মানুষদের বক্তব্য সাধারণ মানুষ কী চোখে দেখে এবং সময় বুঝে কথা বলার কৌশল। এছাড়া আর কোনো সমাধান নেই। কারণ যারা সরকার গঠন করেন ও মন্ত্রী নিয়োগ দেন, তাদের সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। ফলে আবোলতাবোল বক্তব্য দিয়েও এমপি-মন্ত্রীরা বহাল তবিয়তে থেকে যান।
আজকে নিউজে দেখলাম, আমাদের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বাংলার দ্বিতীয় ফাটাকেষ্ট জাহাঙ্গীর স্যার বলছেন, "বাজারে সব সবজির দাম বাড়তি হলেও সবচেয়ে প্রয়োজনীয় সবজি আলুর দাম কম !" জেনে রাখা ভালো, স্যার কিন্তু কৃষি উপদেষ্টা হিসাবেও দায়িত্ব পালন করছেন। স্যারকে এতদিন পর নিউজে দেখে খুশিতে তাক ধিনা ধিন নাচতে মন চাইলো। দেশে যখন মব-সন্ত্রাস করে কিশোরকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়, তখন স্যারকে হারিকেন দিয়ে খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু যেই চান্স এলো ক্রেডিট দেখানোর, তখনই স্যার মিডিয়ায় হাজির হয়ে বলে ফেললেন, "কিন্তু বাজারে আলুর দাম কম!" স্যার যদি কষ্ট করে কয়েকটি আলুর রেসিপি শেয়ার করতেন, তাহলে জনগণ তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে উনার জন্য দোয়া করতো বলে আমার বিশ্বাস।
বাংলাদেশে বিগত ১৫/১৭ বছর ধরে সরকারের বিভিন্ন দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গের মুখে বাহুল্য বক্তব্য শুনে জনগণ অভ্যস্ত হয়ে গেছে। এতটা ধারাবাহিকভাবে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে বাহুল্য বক্তব্য অতীতে দেখা যায়নি। ১/১১ সরকারের সময় বিটিভিতে শিল্পী মমতাজ নাচ এবং গানের তালে তালে আমাদের শেখাতেন "ভাতের বদলে আলু খান। ভাতের বদলে আলু খেলে নাকি বেশি পুষ্টি!" এদিকে বিজ্ঞান বইতে পড়েছি ভাত/রুটি/আটা সব সেইম। তাই কীভাবে তিনবেলা আলু খেয়ে আমার শরীরের সব পুষ্টি চাহিদা পূরণ হবে, সেটা বুঝতে পারতাম না।
যাই হোক, কেয়ারটেকার সরকার শেষ হতে না হতেই দশ টাকা কেজি চালের স্বপ্নে বিভোর হয়ে শেখ হাসিনার যুগে প্রবেশ করলাম। কিন্তু সেখানেও হতাশা ছাড়া কিছুই মিলল না। বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খান গবেষণা করে বের করলেন, "আমরা ভাত বেশি খাচ্ছি, তাই দাম বেড়ে গেছে চালের। এখন থেকে ভাত কম খেতে হবে।" একদিকে ফারুক খানের গবেষণা, অন্যদিকে শেখ হাসিনার এক্সপেরিমেন্ট দেখে দিন কাটাচ্ছি। পেয়াজের দাম বাড়লে এক্সপেরিমেন্ট, গোরুর মাংসের দাম বাড়লে কাঁঠালের বার্গারের রেসিপি এক্সপেরিমেন্ট, টমেটোর দাম বাড়লে সংরক্ষণের সবক, ডিমের দাম বেড়ে গেলে আগে কেন কিনে রাখিনি তার জন্য শেখ হাসিনার কাছে জনগণকে জবাবদিহিতা করতে হতো।
এভাবে গবেষণা ও এক্সপেরিমেন্ট দেখতে দেখতে ইউনুস স্যারের যুগে প্রবেশ করলাম। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে তেমন কোনো প্রত্যাশা ছিল না। দেশকে স্থিতিশীল পর্যায়ে নিয়ে এসে একটা ভালো নির্বাচন দিয়ে চলে যাবেন এমনটাই ভেবেছিলাম। কিন্তু ইন্টেরিম সরকার দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার স্বপ্ন দেখা শুরু করল।
পূর্বের সরকারের পতনের পর সিন্ডিকেট কিছুটা ভয় পেয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়। এতে জিনিসপাতির দাম কমে যায়। কিন্তু সরকার এই বিষয়টাকে তাদের বিরাট সাফল্য বলে প্রচার শুরু করে। চালের দাম অবশ্য কমে না। জনসাধারণ আগেও কিছু বলত না দাম বাড়লে কিংবা কমলে, এখনও কিছু বলছে না। দাম কমলে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পর্যাপ্ত পরিমাণে কিনে, আর দাম বাড়লে কেনাকাটা কমিয়ে দেয়। কেউ গণভবন কিংবা যমুনায় গিয়ে ককটেল ফুটাতে যায় না। বিরোধী দলগুলো কোনোদিন পারেনি জনগণের সমস্যা কী সেটা বোঝার। তাই জনগণ তাদের উপর সরকারি দলের নির্যাতন হলে দেখেও না দেখার ভান করে।
সরকারের এক বছর যেতে না যেতেই দাম কমার সাফল্য নিয়ে যে বয়ান সেটা চুপসে যেতে থাকে। এমনিতেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণে মানুষের মধ্যে অস্বস্তি রয়েছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়া। জনসাধারণ চুপচাপ সহ্য করছে। এর মাঝে যখন তারা দেখে কৃষি উপদেষ্টা ও খাদ্য উপদেষ্টাকে পুরাতন রোগে পেয়ে বসেছে, তখন সত্যিই হতাশা অনুভব করে। খাদ্য উপদেষ্টা বলছেন চালের দাম বেশি কারণ মানুষের পাশাপাশি গোরু-ছাগল খাচ্ছে। আর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা তো আত্মসুখে বিভোর হয়ে বলেই ফেললেন "কিন্তু বাজারে আলুর দাম কম!"
জাপানে বেশ কয়েক বছর ধরে চালের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। জনগণ সরকারের উপর নাখোশ। সরকারের এক মন্ত্রীকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয় চালের দাম কেন বেশি, তখন তিনি বলেন, "আমার জানা নেই কারণ মানুষ আমাকে ফ্রিতে চাল দেয়।" পরদিনই সেই মন্ত্রীকে বরখাস্ত করা হয়। কিউবায় এক মন্ত্রী দেশের গরিব মানুষের সংখ্যা কেন বাড়ছে জানতে চাইলে জবাব দেন, "দেশে কোনো ভিক্ষুক নেই, সব শত্রুদের অপপ্রচার।" উনাকেও বরখাস্ত করা হয়।
বাংলাদেশে আপনি এমন ঘটনা ঘটতে পারে স্বপ্নেও দেখবেন না। দেশে সরকারি কর্মকর্তাদের একটিই বিশেষত্ব - যেকোনো সমস্যার জন্য জনগণকেই দায়ী করা। দাম বেড়েছে ? জনগণ বেশি খাচ্ছে। দাম কমেছে? সরকারের কৃতিত্ব। হয়তো একদিন আমাদের দেশেও "আলুর দাম কম" বলার জন্য জবাবদিহিতা করতে হবে। সেদিন পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকলাম।
"আলু খান, সুস্থ থাকুন !" - সরকারি প্রচার
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে আগস্ট, ২০২৫ বিকাল ৫:৫৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



