somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সায়েদ কুতুব: শহীদ, চিন্তাবিদ নাকি বিপথগামী বিপ্লবী?

২৯ শে আগস্ট, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:৩৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


২৯শে আগস্ট, ১৯৬৬—এই দিনেই মিশরের কারাগারে ফাঁসিতে ঝোলানো হয় এক মানুষকে, যার লেখা ও চিন্তাধারা আজও ইসলামি রাজনীতিকে আলোড়িত করছে। তিনি সাইয়্যেদ কুতুব। জন্মেছিলেন ১৯০৬ সালে মিশরে, সাধারণ এক পরিবারে। শুরুর জীবন ছিল সাহিত্য, শিক্ষা ও সমালোচনার ভুবনে। কিন্তু শেষ জীবনে তিনি হয়ে ওঠেন মুসলিম ব্রাদারহুডের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক, যার কলম শুধু বই লেখেনি, বরং লাখো মুসলিম যুবকের মনে বিপ্লবের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল।

প্রথম জীবনে কুতুব ছিলেন মূলত সাহিত্য সমালোচক। কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পর তিনি লেখালিখি ও শিক্ষাজীবনে যুক্ত হন। পশ্চিমা সাহিত্যের ওপর তার দখল ছিল গভীর, এবং একসময় তিনিই পশ্চিমা শিক্ষা ও আধুনিকতার প্রশংসক ছিলেন। কিন্তু ১৯৪৮ সালে শিক্ষামূলক কাজে আমেরিকা সফর তার জীবনকে ওলটপালট করে দেয়। আমেরিকান সমাজে তিনি দেখলেন ভোগবাদ, উন্মুক্ত যৌনতা, বর্ণবৈষম্য এবং ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্নতা। এসব দেখে তিনি মনে করলেন, পশ্চিমা সভ্যতার ভিত ভেঙে পড়ছে। এখান থেকেই তার আদর্শিক রূপান্তর শুরু। কুতুব পশ্চিমা আধুনিকতাকে “জাহেলিয়াত” বলে আখ্যা দেন এবং বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে কেবল ইসলামী পুনর্জাগরণই মানবতার রক্ষাকবচ হতে পারে।

তার দর্শনের কেন্দ্রে ছিল দুইটি ধারণা: “জাহেলিয়াত” এবং “হাকিমিয়াত”। কুতুব বলেন, জাহেলিয়াত কেবল প্রাক-ইসলামি আরবের অজ্ঞতা নয়, বরং আধুনিক মুসলিম সমাজেও বিরাজ করছে। মুসলমানরাও যদি আল্লাহর বিধান বাদ দিয়ে মানুষের তৈরি আইন মেনে চলে, তবে তারা আসলে জাহেলি সমাজে বাস করছে। এর সমাধান হলো হাকিমিয়াত—শুধু আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা। মানুষের বানানো আইন, সংবিধান বা রাষ্ট্রব্যবস্থা তার কাছে অবৈধ। এই দৃষ্টিভঙ্গি তাকে এক ভয়ংকর রাজনৈতিক অবস্থানে নিয়ে যায়, যেখানে শান্তিপূর্ণ সংস্কারের জায়গা নেই; কেবল জিহাদের মাধ্যমেই জাহেলি সমাজকে ভেঙে ফেলা সম্ভব।

এই চিন্তাধারার সংঘর্ষ ঘটল জামাল আবদেল নাসেরের সাথে। ১৯৫২ সালে ফ্রি অফিসারস মুভমেন্ট যখন রাজতন্ত্রকে পতন ঘটায়, মুসলিম ব্রাদারহুড প্রথমে তাদের পাশে দাঁড়ায়। কিন্তু খুব দ্রুত নাসের স্পষ্ট করে দেন যে তিনি ধর্মনিরপেক্ষ আরব জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী, ইসলামী রাষ্ট্রে নয়। এখানেই শুরু হলো দ্বন্দ্ব। ১৯৫৪ সালে নাসের ব্রাদারহুডের ওপর দমন-পীড়ন শুরু করেন। কুতুবকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং প্রায় ১০ বছর তিনি জেলে ছিলেন। কারাগারে বসেই তিনি তার সবচেয়ে প্রভাবশালী বই 'মাআলিম ফিত তারিক' (Milestones) রচনা করেন, যা ইসলামপন্থী আন্দোলনের বাইবেল হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।

কুতুবের লেখা শুধু রাজনৈতিক স্লোগান ছিল না, বরং অস্তিত্বের প্রশ্ন। তার ভাষা ছিল আবেগময়, উসকানিমূলক এবং একরকম দিকনির্দেশক। তিনি বলেছিলেন, ইসলামকে কেবল নামধারী ধর্ম হিসেবে মানলেই হবে না; বরং জীবন ও রাষ্ট্রকে পুরোপুরি কুরআনের ছায়ায় নিয়ে আসতে হবে। এই ভাবনা বিপুল সংখ্যক তরুণকে আকৃষ্ট করেছিল, তবে একইসাথে মিশরের শাসকদের চোখে তাকে আরও ভয়ংকর করে তুলেছিল। অবশেষে ১৯৬৬ সালে নাসেরের সরকার ঘোষণা করল যে কুতুব রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র করছেন। আদালত ছিল নাটকীয়, সাজানো, আর রায় ছিল পূর্বনির্ধারিত। ২৯শে আগস্ট, ভোরে তাকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। তার মৃত্যু ব্রাদারহুডকে আরও বিপ্লবী করে তোলে এবং তাকে শাহাদাতের প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।

কুতুবের চিন্তাধারা যতটা প্রভাবশালী ছিল, তার সীমাবদ্ধতাও ততটাই স্পষ্ট। তার সমালোচকরা প্রধানত তিনটি বিষয়ে তার ভুল ধরিয়ে দেন। প্রথমত, কুতুব পশ্চিমা সমাজের কেবল ভোগবাদ ও নৈতিক অবক্ষয় দেখেছিলেন। তিনি পশ্চিমা গণতন্ত্র, বিজ্ঞান, মানবাধিকার এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতির মতো গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো উপেক্ষা করেছিলেন। এই একপেশে দৃষ্টিভঙ্গি ইসলামি যুবকদের মধ্যে পশ্চিমা-বিদ্বেষ তৈরি করেছিল। দ্বিতীয়ত, কুতুব আধুনিক শিল্প ও অর্থনীতির গুরুত্বকে পুরোপুরি উপেক্ষা করেছিলেন।

তিনি মিশরের দারিদ্র্য বা শিল্পায়নের মতো বাস্তব সমস্যাগুলোর সমাধানে কোনো কার্যকর পরিকল্পনা দেননি। তৃতীয়ত, কুতুব তার বই 'ইসলামে সামাজিক ন্যায়বিচার'-এ জাকাত ও উত্তরাধিকারের মতো সুনির্দিষ্ট শরিয়াহ বিধানগুলো পরিবর্তনের পক্ষে মত দেন এবং চার মাজহাবের অস্তিত্বকে অস্বীকার করেন। ঐতিহ্যবাহী ইসলামি পণ্ডিতরা তার এই মনোভাবকে মৌলিক ধর্মীয় জ্ঞানের পরিপন্থী বলে মনে করেন।

কুতুবের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব তাই এক দ্বিমুখী বাস্তবতা। একদিকে তিনি মুসলিম বিশ্বে ‘শহীদ’ হয়ে ইসলামি পুনর্জাগরণের প্রতীক। অন্যদিকে তার রচনা থেকে প্রেরণা নিয়েছে আল-কায়েদা, আইএসআইএস-এর মতো সহিংস জিহাদি সংগঠন। তার জাহেলিয়াত ও হাকিমিয়াত ধারণাকে তারা নিজেদের সহিংসতাকে বৈধতা দেওয়ার হাতিয়ার বানিয়েছে। এর ফলেই আজ কুতুবকে ঘিরে বিতর্ক থামেনি। কেউ তাকে নবজাগরণের দিকপাল মনে করেন, আবার কেউ বলেন তিনি উগ্রবাদের জনক।

শেষ পর্যন্ত সাইয়্যেদ কুতুবের জীবন আমাদের সামনে এক দ্বৈত শিক্ষা রেখে যায়। তিনি দেখিয়েছেন, কলম বন্দুকের মতোই শক্তিশালী হতে পারে। কিন্তু একইসাথে প্রমাণ করেছেন, একপেশে দৃষ্টিভঙ্গি যখন বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে, তখন তা বিপ্লব নয়, বিভাজনের জন্ম দেয়। তার মৃত্যুদণ্ড মিশরে ইসলামি রাজনীতিকে থামাতে পারেনি, বরং আরও চরমপন্থার বীজ বপন করেছে। আজও প্রশ্নটা একই থেকে গেছে—কুতুব কি শহীদ, না কি তিনি এমন এক দর্শনের জনক, যা পরবর্তীকালে মুসলিম বিশ্বকে সহিংসতার অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে?
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে আগস্ট, ২০২৫ রাত ১২:৫৭
১২টি মন্তব্য ১২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৪৪



বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

কেন বিএনপি–জামায়াত–তুরস্ক প্রসঙ্গ এখন এত তপ্ত?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে একটি পরিচিত ভয়–সংস্কৃতি কাজ করেছে—
“র”—ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে রাজনীতিতে গুজব,... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিশ্চিত থাকেন জামায়েত ইসলাম এবার সরকার গঠন করবে

লিখেছেন সূচরিতা সেন, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৪২


আমাদের বুঝ হওয়ার পর থেকেই শুনে এসেছি জামায়েত ইসলাম,রাজাকার আলবদর ছিল,এবং সেই সূত্র ধরে বিগত সরকারদের আমলে
জামায়েত ইসলামের উপরে নানান ধরনের বিচার কার্য এমন কি জামায়েতের অনেক নেতা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×