
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন কালো অধ্যায় যোগ হয়েছে। সম্প্রতি 'মঞ্চ ৭১' নামের একটি নতুন সংগঠনের সভা থেকে সাবেক মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীসহ ১৫ জনকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে গ্রেফতার করা হয়েছে। এই ঘটনাটি দেশজুড়ে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। অনেকে বলছেন, ফ্যাসিস্টদের গ্রেফতার করা উচিত ছিল, আবার কেউ কেউ বলছেন মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে এমন আচরণ করা ঠিক হয়নি। এই ঘটনাটি অনেকগুলো প্রশ্ন সামনে এনেছে, যা আমাদের দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে আরও জটিলে করে তুলেছে।
ঘটনাটি ঘটে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে 'মঞ্চ ৭১' এর একটি সভায়। সেখানে ৮৭ বছর বয়সী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীসহ বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা উপস্থিত ছিলেন। সাংবাদিক মনজুর আলম পান্না ও মাহবুব কামাল-এর মতো গণ্যমান্য ব্যক্তিরাও সেখানে ছিলেন। সভার মূল আয়োজক হিসেবে ব্যারিস্টার জেড আই পান্নার নাম থাকলেও তিনি নিজে উপস্থিত ছিলেন না। আরও চমকপ্রদ ব্যাপার হলো, এই সভায় সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. কামাল হোসেনের উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও তিনি আসেননি।
সভা চলাকালীন সময়ে 'জুলাই যোদ্ধা' নামে পরিচিত বিএনপি-জামাত সমর্থক কিছু লোক হঠাৎ সেখানে এসে উপস্থিত হন এবং সিনিয়র সিটিজেনদের গায়ে হাত তোলেন। তারা তাদের 'ফ্যাসিস্ট' বলে হেনস্তা করে। প্রশ্ন উঠেছে, যেখানে ড. কামাল হোসেনের মতো ব্যক্তিত্বের উপস্থিত থাকার কথা ছিল, সেখানে নিরাপত্তা এত দুর্বল ছিল কেন? কোনো ধরনের নিরাপত্তা ছাড়াই বহিরাগতরা কীভাবে একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে ঢুকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারল?
এই ঘটনার পরপরই ড. কামাল হোসেনের দল গণফোরাম দাবি করে যে কামাল হোসেনের অনুমতি ছাড়াই তার নাম ব্যবহার করা হয়েছে এবং দলটির এই অনুষ্ঠানের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। এই বিষয়ে ড. কামাল হোসেন কিংবা ব্যারিস্টার জেড এআই পান্না কেউই কোনো মন্তব্য করেননি। ফলে এই সভার আসল উদ্দেশ্য কী ছিল, তা নিয়ে এক বিরাট ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে।
অভিযোগ উঠেছে, আবদুল লতিফ সিদ্দিকী 'মঞ্চ ৭১' এর ব্যানারকে ব্যবহার করে দেশকে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্র করছিলেন এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে উৎখাত করার জন্য অন্যদের প্ররোচিত করছিলেন। যদি এই অভিযোগ সত্যি হয়, তাহলে শুধু বক্তারা নন, মূল আয়োজক জেড এআই পান্না এবং ড. কামাল হোসেনকেও গ্রেফতার করা উচিত ছিল। এতে পুরো ঘটনাটি রহস্যময় হয়ে উঠেছে।
সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট করে জানানো উচিত, আসলে গ্রেফতারকৃতদের অপরাধ কী ছিল? সন্ত্রাস দমন আইনে গ্রেফতার করাকে অনেকেই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে করছেন। এই আইনটি আগের সরকারের আমলে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করার হাতিয়ার হিসেবে সমালোচিত হয়েছিল। বিএনপি তখন এই আইনকে 'কালো আইন' আখ্যা দিয়েছিল, কারণ এটি নির্দিষ্ট প্রমাণ ছাড়াই গ্রেফতার ও দীর্ঘ কারাবাসের সুযোগ দেয়। ৮৭ বছর বয়সী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর মতো ব্যক্তিদের সরকার পতনের ক্ষমতা আছে বলে মনে হয় না, তাহলে সরকার কেন ভয় পাচ্ছে?
সরকারের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণের অভিযোগও উঠেছে। ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত সাংবাদিক মাহবুব কামাল কীভাবে ছাড়া পেলেন, তা নিয়েও প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। তিনি নিজেকে আওয়ামী লীগের সমর্থক নন বলে দাবি করলেও তার প্রয়াত বন্ধু বিভুরঞ্জন সরকারের শেষ লেখায় বলা হয়েছে যে মাহবুব কামাল শেখ হাসিনার কাছ থেকে ফ্ল্যাট, টাকা সবই পেয়েছেন। এখন তিনি সরকারের বেশ সমালোচনা করেন, কিন্তু তাকে ছেড়ে দেওয়া হলো কেন? যুগান্তরের সাংবাদিক হওয়ায়? নাকি ভবিষ্যতে সরকারের সমালোচনা না করার শর্তে? যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে, তাদের বেশিরভাগই এখন সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলছেন।
আবদুল লতিফ সিদ্দিকী বাদে যারা আটক হয়েছেন সবাই মূলত আওয়ামী লীগের সাপোর্টার । তিনি নিজে সবশেষ ডামি ইলেকশনের এমপি হলেও ৫ই আগস্টের পর তার ভাই কাদের সিদ্দিকীর মতো সরব ছিলেন না। লতিফ সাহবের নামে কোনো মামলা ছিলো না । সরকার তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পায় নি । অভিযোগ থাকলে এই সভা পর্যন্ত তিনি আসতেই পারতেন না। এখন তাকে ইনটেরিম সরকারের বিরুদ্ধে যারা কথা বলছেন তাদের সাথে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে গ্রেফতার করা হলো। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, ২০০৯ সালে সন্ত্রাস দমনের নামে কালো আইন পাশ করার সময় তিনি শেখ হাসিনার কেবিনেটের মন্ত্রি ছিলেন । সে সময় লতিফ সাহেব কালো আইনের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ করেননি, আজ সেই আইনেই তাকে জেলে যেতে হচ্ছে।
সন্ত্রাস দমন আইনে গ্রেফতার হয়েছেন সাংবাদিক ও ইউটিউবার মনজুর আলম পান্না। চ্যানেল আই থেকে বহিষ্কৃত এই সাংবাদিক তার দালালি শিল্পের জন্য পরিচিত। আগস্টের শেষ দিকে তিনি রাজাকার গোলাম আজমের ছেলের সাথে ঝামেলায় জড়িয়েছিলেন। ভারতের এক গুজব মিডিয়ার বরাত দিয়ে পান্না সাহেব ভিডিও বানিয়েছিলেন যে আমান আজমি দেশকে পূর্ব পাকিস্তান বানানোর পরিকল্পনা করছেন এবং সেনাপ্রধান হতে চান। আমান আজমি সংবাদপত্রে বিবৃতি দিয়ে পান্নাকে ক্ষমা চাইতে বলেছিলেন, অন্যথায় তার ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার কথা জানিয়েছিলেন। এই গ্রেফতারকে অনেকেই আমান আজমির প্রতিশোধ হিসেবে দেখছেন।
আবার অন্যভাবেও চিন্তা করা যায়। মনজুর আলম পান্না, জেড এআই পান্নাসহ যারা এখন সরকারের সরাসরি বিরুদ্ধে কথা বলছেন, তারা পরিকল্পিতভাবে আবদুল লতিফ সিদ্দিকীকে দাওয়াত দিয়েছেন। তারা জানতেন যে জামাত-বিএনপি সমর্থকরা লতিফ সিদ্দিকীর প্রতি কী ধরনের আচরণ করতে পারে এবং তারা সেই খবর কোনোভাবে ফাঁস করে দিয়েছেন। যখন মনজুর আলম পান্নাকে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন তিনি বারবার বলছিলেন যে সাংবাদিককে গ্রেফতার করে মত প্রকাশকে রুদ্ধ করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে সরকারকে হেয় করার একটি উদ্দেশ্য দেখা যায়।
সরকারও দুধে ধোওয়া তুলসি পাতা নয়। এত কিছু সংস্কার করার কথা বললেও কোনো 'কালো আইন' বাতিল করেনি। এর আগেও সৌদি দূতাবাসের চাপে মডেল মেঘনাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল কালো আইনে, এবার গ্রেফতার করা হলো 'মঞ্চ ৭১' এর লোকজনকে। বিএনপি এখন সম্পূর্ণ চুপ। আওয়ামী লীগ আমলে যারা এসব কালো আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতেন, তারা এখন সুবিধাজনক সময়ে এর কোনো প্রতিবাদ করছেন না। এটাই বাংলাদেশের নোংরা রাজনীতি। গ্রেফতারকৃতরা যতই 'ফ্যাসিস্ট' হোক না কেন, আইনটি তো কালো। বিএনপি যে আবার কোনোদিন এই কালো আইনের শিকার হবে না, তার কোনো গ্যারান্টি নেই। সবাই কেবল সুযোগ বুঝে নিজেদের জন্য বিচার চায়, জনগণের কথা কেউ ভাবে না।
এবার আসি আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর কথায়। তিনি জামিন চাইবেন না কারণ এই সরকারের জামিন দেওয়ার ক্ষমতা নেই বলে তিনি মনে করেন। তার এই কথা কিছুটা সত্যি। চিন্ময় প্রভুকে যেভাবে আটক করে রাখা হয়েছে, তা নিয়ে ভবিষ্যতে প্রশ্ন উঠবে। কিন্তু স্পিকার আব্দুল হামিদ, সাবের হোসেন চৌধুরী, এবং একজন সাবেক মন্ত্রীকে জামিন দেওয়া হয়েছে। তাহলে আবদুল লতিফও জামিন পেতে পারতেন। কিন্তু তিনি সরকার এবং বিচার ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চান। মজার বিষয় হলো, ২০১৮ সালে উনার প্রিয় দল আওয়ামী লীগের আমলেই দুদকের মামলায় জামিন পাননি। তখন তো আদালত এবং সরকার সবই তাদের ছিল।
২০২৪ সালের 'ডামি' নির্বাচনে টাঙ্গাইল-৪ আসন থেকে তিনি এমপি হয়েছেন। অর্থাৎ, ২০১৩-১৪ সালে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত হলেও তিনি মনে প্রাণে আওয়ামী লীগ। তার ইগো আগেও দেখা গিয়েছে, তিনি পকেট গেট দিয়ে কারাগারে ঢুকবেন না বলে জেদ ধরেছিলেন। হয়তো এসব ভেবেই জেড এআই পান্না গং তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের যেসব সমর্থক শেখ হাসিনার আমলে লতিফ সিদ্দিকীকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্তে খুশি ছিলেন, তারা এখন দোয়া করছেন যে আবদুল লতিফের এই ঘটনার উসিলায় যেন আওয়ামী লীগের আবার পায়ের নিচে মাটি শক্ত হয়।
সরকার পক্ষ এবং তার বিরোধীরা পরস্পরকে ঘায়েল করার জন্য নানা ধরনের চাল চালছে। শেষ পর্যন্ত কী হয়, তা দেখার বিষয়। তবে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ষড়যন্ত্র আর প্রতিষড়যন্ত্রের খেলা এখনো চলমান। আবদুল লতিফ সিদ্দিকী এই খেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ গুটি কিনা, সেটাই এখন দেখার বিষয়। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, আইনের শাসন এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ রক্ষার ক্ষেত্রে এই ঘটনা একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা হয়ে উঠেছে। সময়ই বলে দেবে কে আসলে ষড়যন্ত্রের শিকার আর কে ষড়যন্ত্রকারী।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে আগস্ট, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:০৫

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



