somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জেনারেল এম.এ.জি. ওসমানী: অমীমাংসিত প্রশ্নগুলো

০২ রা সেপ্টেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:০৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


আজ ১ সেপ্টেম্বর। এই দিনে জন্ম নিয়েছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল মোহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানী। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে তাঁর নাম এক অনিবার্য আলোচনার অংশ। কিন্তু সেই আলোচনায় যেমন শ্রদ্ধা আছে, তেমনি আছে অসংখ্য প্রশ্ন ও বিতর্ক, যেগুলোর উত্তর আজও স্পষ্টভাবে মেলেনি।

সবচেয়ে আলোচিত রহস্যগুলোর একটি হলো ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। রেসকোর্স ময়দানে যখন পাকিস্তানি সেনারা আত্মসমর্পণ করছিল, তখন মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে ওসমানীর উপস্থিতি প্রত্যাশিত ছিল। অথচ তিনি সেখানে ছিলেন না। অনেকেই বলেন, সামরিক প্রটোকলের কারণে কর্নেল পদমর্যাদার একজন অফিসারকে লেফটেন্যান্ট জেনারেলের সমমর্যাদায় দাঁড় করানো যেত না। অন্যদিকে কেউ কেউ মনে করেন, তাঁকে ইচ্ছাকৃতভাবেই বাদ দেওয়া হয়েছিল। এই সিদ্ধান্ত আসলে কার ছিল ? ভারতের, মুজিবনগর সরকারের, নাকি তাঁর নিজের এ নিয়ে ইতিহাস আজও নীরব।

তাঁকে ঘিরে আরেকটি অভিযোগ হলো তিনি ছিলেন “ডেস্ক জেনারেল”। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি বেশিরভাগ সময় কলকাতায় থেকে টেবিলে বসে যুদ্ধ পরিচালনা করতেন, সরাসরি ময়দানে যেতেন কম। অনেক সেক্টর কমান্ডার তাঁর এই ভূমিকাকে সীমাবদ্ধ বললেও সমর্থকেরা বলেন, সর্বাধিনায়ক হিসেবে তাঁর মূল দায়িত্বই ছিল সমন্বয় করা ; ভারত, মুজিবনগর সরকার এবং মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করা। প্রশ্ন থেকে যায়: তিনি কি কমান্ডারদের স্বাধীনতা সীমিত করেছিলেন, নাকি সেটিই ছিল যুদ্ধের বাস্তব চাহিদা?

ভারতীয় সেনাদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নিয়েও বহু জল্পনা। তিনি কি সম্পূর্ণ ভারতীয় কমান্ডের অধীনে কাজ করতেন, নাকি কিছুটা হলেও স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন? যুদ্ধকালীন সময়ে ভারতের ওপর নির্ভরশীলতা তিনি হয়তো মেনে নিয়েছিলেন, কিন্তু স্বাধীনতার পরই ভারতের প্রভাব নিয়ে তাঁর অসন্তোষ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ফলে প্রশ্ন ওঠে, তিনি কি শুরু থেকেই ভারতীয় ভূমিকাকে অনিচ্ছাসত্ত্বেও মেনে নিয়েছিলেন, নাকি তখন সেটিই ছিল অনিবার্যতা?

স্বাধীনতার পর তাঁর জীবন আরও বেশি বিতর্কিত হয়ে ওঠে। ১৯৭২ সালের এপ্রিলে সেনাবাহিনী থেকে তাঁর বিদায় অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়। সরকার তখন জেনারেল পদ বিলুপ্ত করে, ফলে ওসমানী অবসরে যেতে বাধ্য হন। এটি কি প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত ছিল, নাকি তাঁকে সরিয়ে দেওয়ার কৌশল ?

একইভাবে শেখ মুজিবের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কও নাটকীয়ভাবে বদলে যায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁরা ছিলেন ঘনিষ্ঠ সহযোগী, কিন্তু পরবর্তীতে ভারত নীতি, সেনাবাহিনী পুনর্গঠন এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তাঁদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়। শেখ মুজিব যখন একদলীয় শাসনব্যবস্থা ‘বাকশাল’ চালুর সময় ওসমানী প্রকাশ্যে বিরোধিতা করেন। এটি কি কেবল গণতান্ত্রিক নীতির প্রতি তাঁর অবিচল অবস্থান, নাকি বঙ্গবন্ধুর প্রতি ব্যক্তিগত ক্ষোভ ?

শেখ মুজিব হত্যার পর ওসমানীর রাজনীতিতে প্রবেশ আরও বড় বিতর্কের জন্ম দেয়। তিনি যুক্ত হন জাসদের সঙ্গে, যে দল তখন সশস্ত্র বিপ্লব ও উগ্র আন্দোলনের কারণে আলোচিত ছিল। অনেকেই মনে করেন এটি ছিল তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অভাবের প্রমাণ, আবার অন্যদের মতে, তিনি কেবল বিকল্প গণতান্ত্রিক শক্তি খুঁজছিলেন। এই সিদ্ধান্ত কি দেশের জন্য ক্ষতিকর ছিল, নাকি সত্যিই তখনকার অস্থির সময়ের প্রেক্ষিতে এটি ছিল তাঁর সৎ বিশ্বাস এ নিয়ে মতভেদ আছে।

ওসমানীর জীবনের অনেক অমীমাংসিত রহস্য আজও গবেষণার অপেক্ষায়। ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণের দিন তিনি আসলে কোথায় ছিলেন, তাঁর মানসিক অবস্থা কেমন ছিল সেই তথ্য পুরোপুরি জানা যায়নি। ভারতের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কও এক অদ্ভুত টানাপোড়েনে ভরা যুদ্ধে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা গ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু স্বাধীনতার পর ভারত-বিরোধী অবস্থানও নিয়েছিলেন।

সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হয়তো তাঁর রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে। তিনি কি সত্যিই ক্ষমতার শীর্ষে যেতে চেয়েছিলেন ? নিজেকে শেখ মুজিবের বিকল্প হিসেবে কল্পনা করেছিলেন কি ? নাকি কেবলই দেশের স্বার্থে লড়াই করতে চেয়েছিলেন, রাজনীতি ছিল তাঁর কাছে গৌণ ?


-
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা সেপ্টেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:১০
১৪টি মন্তব্য ১৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৪৪



বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

কেন বিএনপি–জামায়াত–তুরস্ক প্রসঙ্গ এখন এত তপ্ত?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে একটি পরিচিত ভয়–সংস্কৃতি কাজ করেছে—
“র”—ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে রাজনীতিতে গুজব,... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিশ্চিত থাকেন জামায়েত ইসলাম এবার সরকার গঠন করবে

লিখেছেন সূচরিতা সেন, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৪২


আমাদের বুঝ হওয়ার পর থেকেই শুনে এসেছি জামায়েত ইসলাম,রাজাকার আলবদর ছিল,এবং সেই সূত্র ধরে বিগত সরকারদের আমলে
জামায়েত ইসলামের উপরে নানান ধরনের বিচার কার্য এমন কি জামায়েতের অনেক নেতা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×