
ডাকসু নির্বাচনে শিবিরের মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক পোস্ট থেকে প্রার্থী হয়েছেন তাসনিম জুমা। তার ব্যক্তিত্বে রয়েছে এক অদ্ভুত দ্বৈততা। একদিকে তিনি উদীচীর সাথে জড়িত, নজরুলের কবিতা আবৃত্তি করেন, জয় বাংলা স্লোগান দেন, জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক মানেন। অন্যদিকে শিবিরের সাথে থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এই দ্বৈততা আসলে আজকের বাংলাদেশের একটি বড় অংশের প্রতিনিধিত্ব করে। যারা একইসাথে লিবারেল এবং ইসলামিক দুটো পরিচয়ই বহন করেন। তাসনিম জুমার কথা শুনলে মনে হয় কোনো শাহবাগী কথা বলছেন, আবার শিবিরের প্যানেল সদস্যদের সাথে থাকলে তিনি হয়ে ওঠেন ইসলামিক মাইন্ডের।
সোশ্যাল মিডিয়ায় শাহবাগী চিন্তাধারার মানুষজন "শিবির ঠেকাও" আন্দোলনে নেমেছেন। সামুব্লগার অমি পিয়াল পর্যন্ত "স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি জামাত শিবিরকে ঠেকাতে" ছাত্রদলকে সাপোর্ট দিচ্ছেন। যারা নিজেদের সেকুলার দাবি করেন, তারা বলছেন জামাত শিবিরকে ভোট দিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাদরাসায় পরিণত হবে। এদিকে জামাত শিবির আগে থেকেই অনুমান করেছিল তাদের বিরুদ্ধে এমন ক্যাম্পেইন হবে। তাই প্রবাসী ইউটিউবার পিনাকি এবং ইলিয়াসকে দিয়ে জনসংযোগ চালিয়েছে। বোট আইডি দিয়ে অন্য প্যানেলের প্রার্থীদের মা মাসি তুলে গালি দিয়েছে। নিজেরা নিজেরা ভুয়া জরিপ করে শিবিরকে সকল জরিপে এগিয়ে রেখেছে। যেখানে ৪০ হাজার ভোটার ডাকসুতে যেখানে ৯০ হাজার লোক ভোট দিয়ে শিবিরকে জয়যুক্ত করেছে।
ডাকসু নিয়ে হাইপ এত বেশি যে হুজুর শায়েখ আহমাদুল্লাহ পর্যন্ত এ বিষয়ে কথা বলছেন। আবার ডাকসুতে যতগুলো প্যানেল আছে, কম বেশি সবগুলোর সাথেই শিবিরের যোগাযোগ রয়েছে। এদের মধ্যে কেউ জিতলে মূলত শিবিরই জিতবে এটাই বাস্তবতা। এখন প্রশ্ন হলো, কেন এই "শিবির ঠেকাও" প্রচারণা? শিক্ষার্থীদের যদি ইচ্ছা থাকে তারা শিবিরকে ভোট দেবে, নাহলে দেবে না। কেন এভাবে তাদের বিরুদ্ধে প্রচার চালানো হচ্ছে? শিবির যদি গুপ্ত রাজনীতি করে সাধারণ শিক্ষার্থী বেশে রিয়েল সাধারণ শিক্ষার্থীদের ম্যানেজ করে, তাহলে বাকি প্যানেলগুলো কেন পারছে না সেভাবে ম্যানেজ করতে?
মেয়েদের যদি শিবিরের ছেলেদের ভালো লাগে, এতে সমস্যা কোথায়? কোচিং সেন্টারগুলোতে শিবিরের যে আধিপত্য, সেটা কীভাবে ঠেকানো যাবে? শুধু মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বলে কি শিবির ঠেকানো যাবে যদি নিজের আদর্শই ঠিক না থাকে? শেখ হাসিনা শিবির দমন করতে কত মামলা করেছে, হামলা করেছে। "তাজকিরাতুল আউলিয়া" বইকে জঙ্গি বই বানিয়ে শিবিরের কর্মী গ্রেফতার করেছে। কিন্তু শিবির কি দমন হয়েছে? বরং এখন সমাজের গভীরে, ইন্টেলেকচুয়াল সেক্টরেও শিবির পৌঁছে গেছে।
যারা সেকুলার কিন্তু টাকার কাছে নিজের ইমান বিক্রি করে দিয়েছেন, তাদেরকেও শিবির কাজে লাগাচ্ছে। গত ১৭ বছরে শিবির হাজার হাজার অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট তৈরি করেছে। সেকুলাররা হয় ঘুমিয়ে ছিল, নাহয় আওয়ামী লীগের পা চেটেছে। মেয়েদের ভোট বিশাল ফ্যাক্টর হবে ডাকসুতে বলা হচ্ছে। এখন মেয়েরা যদি ইসলামী ছাত্রী সংস্থা দিয়ে প্রভাবিত হয়, দোষ তো সেকুলার মেয়েদের। তারা কেন আকর্ষণ করতে পারলো না? চট্টগ্রাম এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের আধিপত্য হওয়ার কারণে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড কমে গেছে। সামনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও এমন হতে পারে।
তাতে কী হয়েছে? এখনকার কতজন শিক্ষার্থী পড়ার বাইরে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড করার সুযোগ পায়? খেলার জন্য মাঠ নেই, বইয়ের দাম বেড়েই চলেছে, সাংস্কৃতিক অর্গানাইজেশন কমে গেছে প্রচুর। নামকরা কালচারাল অর্গানাইজেশনগুলো সব রাজনৈতিক পার্টির দালালি করেছে। দেশে কিন্ডারগার্টেনের সংখ্যা কমে গেছে কেন? প্রাইভেট মাদ্রাসার শিক্ষা এত বেড়ে গেল কেন? স্কুলে কী পড়াশোনা কিংবা সাংস্কৃতিক অ্যাক্টিভিটিস হয়? ছোট ছোট স্কুলের ছেলেরা সিগারেট খাচ্ছে, প্রেম করছে, আড্ডাবাজি করছে, মারামারি করছে আর ইভটিজিং করছে।
ছেলেপুলে খারাপ হয়ে যাচ্ছে দেখে মাদ্রাসার শিক্ষার প্রসার হচ্ছে। ইভটিজিংয়ের দৌরাত্ম্য এত বেড়েছে যে সনাতন ধর্মের রক্ষণশীল নারীরাও মনে করছেন বোরখা পরলে মেয়ে নিরাপদ থাকবে। সবাই তো চাইবে তার মেয়েটা সুস্থভাবে বেড়ে উঠুক। এটা করা সম্ভব হয়ে উঠল না কেন? এখন সেকুলার মহাশয়রা শিবির ঠেকাতে মাঠে নেমেছেন। কিন্তু শিবিরকে মুক্ত পরিবেশে তাদের রাজনীতি করতে দিতে হবে। তারা যে ভিক্টিম ছিল সেটা দেখিয়ে পাবলিকের বিপুল সহানুভূতি আদায় করেছে।
যখন কোনো দল ক্ষমতায় থাকে, তখন বিরোধী মতাদর্শের মানুষের সাথে কী আচরণ করে তার মাধ্যমে আসল রূপ ফুটে ওঠে। শিবির ডাকসু জিতলে যদি রিয়েল সাধারণ শিক্ষার্থীরা ভাবে তারা ভালো কিছু পাবে, তাদের আপনি ঠেকানোর কে? কে রিয়েল ফ্যাসিস্ট সেটা বুঝতে হলেও শিবিরকে আলোর মাঝে রাজনীতি করতে দিতে হবে, কোনো ইলেকশনে জিতলে সেটা মেনে নিতে হবে। আইডিওলজিকে দমন-পীড়ন দিয়ে শেষ করা যায় না। ভালো আইডিওলজি মানুষের কাছে প্রচার করুন, দেখান। মানুষ শিবিরকে রেড কার্ড দেখাতে সময় নেবে না।
দেশের একটা বিশাল তরুণ প্রজন্মকে শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগ ছোট থেকে যাতে আওয়ামী লীগ এবং শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি সফট কর্নার থাকে সেজন্য প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ দিয়েছে। কিন্তু লাভ হয়নি। জোর করে কোনো মতাদর্শ দিয়ে আইডিওলজি গ্রহণ বা বর্জন করা যায় না। শিবিরকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করুন। হেরে গেলে মেনে নিন এবং স্বীকার করুন। "গার্বেজ আইডিওলজির" সাথে যদি পারছেন না, তাহলে আপনার আইডিওলজি কতটুকু মানসম্পন্ন - সেটা নিয়ে ভাবুন।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:৪৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



