somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

তালেবানরা দিন দিন ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠছে

২১ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:৫০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


কল্পনা করুন এমন একটি দেশের কথা যেখানে জামাল উদ্দিন আল-আফগানি (যার নামেই "আফগানি" আছে) নিষিদ্ধ। যেখানে মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহহাব : যার মতবাদ তালেবানদের অনুপ্রেরণা তারই বই *কিতাব আত-তাওহিদ* পড়া অবৈধ। যেখানে সাইয়িদ কুতুব ও আবুল আ'লা মওদুদীর মতো চিন্তাবিদরা "বিপজ্জনক" ঘোষিত। স্বাগতম আফগানিস্তানে, যেখানে জ্ঞানই সবচেয়ে বড় শত্রু। তালেবানের নতুন স্লোগান হতে পারে: "আমরা এতটাই ভালো কাজ করছি যে বই পড়লেই মানুষ জিহাদ করে বসবে !" হ্যাঁ, আপনি ঠিকই শুনেছেন : আফগানিস্তানের "মহান নেতারা" এতটাই সানন্দ শাসন করছেন যে ৬৭৯টি বই নিষিদ্ধ করতে হয়েছে। কারণ? মানুষ যদি জ্ঞান অর্জন করে, তাহলে প্রশ্ন করবে। আর প্রশ্নই তাদের সবচেয়ে বড় ভয়।

মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহহাবের কিতাব আত-তাওহিদ মূলত আল্লাহর একত্ব, শিরক চিনে ফেলা, বিদআত থেকে বাঁচা এবং যুক্তিভিত্তিক বিশ্বাসের পাঠ দেয়। কিন্তু তালেবান মনে করে এতে চিন্তার খোরাক আছে অতএব বিপজ্জনক। এমনকি ওয়াহহাবি লেখকের বইও তাদের কাছে নিরাপদ নয়; তারা বই নয়, কেবল তাদের মুরুব্বিদের মুখ্য বক্তব্যকেই গ্রহণ করে। একইভাবে আবুল আ'লা মওদুদীর কুরআনের চার সংস্কার বইটি ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের কথা বলে। বইটিতে ইসলামি পুনর্জাগরণের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষার গুরুত্ব, সামাজিক ন্যায় এবং রাজনৈতিক বিচার-বিচারের ওপর আলোকপাত আছে। তালেবানের দৃষ্টিতে এইসব ভাবনা তাদের কর্তৃত্ব নড়বড়ে করে । পাঠক নিজে বুঝে-শুনে ইসলাম পালন করলে তারা অনুশাসনের বাইরে চলে যাবে।

কুরআনের চার সংস্কার বইয়ে লেখক ব্যক্তিগত সংস্কার, সামাজিক সংস্কার, রাজনৈতিক সংস্কার ও অর্থনৈতিক সংস্কারের মতো বিষয় তুলে ধরে। তাহলে শাসনব্যবস্থার দৃষ্টিতে সবচেয়ে বড় অপরাধ কী? মানুষকে চিন্তা করতে শেখানো। মওদুদী বলেছেন শিক্ষার গুরুত্ব, বাস্তব সামাজিক-অর্থনৈতিক সংকটের সমাধান এবং কিভাবে ইসলাম সমন্বিতভাবে সমাজের সংস্কার ঘটাতে পারে । আর এ কারণেই তাকে 'বিপজ্জনক' বলা হয়েছে। তাদের কাছে শিক্ষিত মানুষ মানে অধিকার সচেতন মানুষ, আর অধিকার সচেতন মানুষ মানে তাদের শাসনের প্রতি হুমকি।

সাইয়িদ কুতুবের *সামাজিক ন্যায়বিচার* বইয়ে দরিদ্রের অধিকার, সম্পদের ন্যায্য বণ্টন এবং জনগণের দায়িত্ব নিয়ে কথাবার্তা আছে। কুতুব জনগণের কল্যাণ ও ন্যায়বিচারের ওপর জোর দিয়েছেন ; এগুলোই তালেবানের কাছে অগ্রহণযোগ্য কারণ এইসব আদর্শ মানুষকে তাদের কাছ থেকে ন্যায়বিচার দাবি করতে শেখায়। একজন রক্ষণশীল ইসলামি চিন্তাবিদের লেখা নিষিদ্ধ করা হয়েছে শুধু এই কারণে যে তিনি জনগণের অধিকার নিয়ে কথা বলেছেন।

তাতিম্মাত আল-বায়ান তারিখ আল-আফগান: আফগানিস্তানের গৌরবময় ইতিহাস, পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে রুদ্ধচাহিদা আর মুসলিম ঐক্যের আহ্বান নিয়ে একটি গৌরবোজ্জ্বল অন্বেষণ। কিন্তু তালেবানের অভিযোগ: "আফগানি মানুষকে চিন্তা করতে শেখায়, প্যান-ইসলামিক চিন্তা করতে বলেছে, এমনকি বিবর্তনবাদ স্বাগত জানিয়েছে এবং সর্বোপরি আফগানিস্তানের ইতিহাস নিয়ে গর্ব করতে শেখায়।" এই গর্বটাই তাদের সবচেয়ে অপ্রীতিকর মনে হয়, কারণ জাতিগত/জাতীয় ইতিহাস মানুষকে স্বাধীনভাবে ভাবতে শেখায় এবং স্বাধীনভাবে ভাবা তাদের নিয়ন্ত্রণে আনে না।

আমি ব্যক্তিগতভাবে বিস্মিত কেন তালেবানরা "গ্লোবাল জিহাদের জনক" হিসেবে পরিচিত আবদুল্লাহ আজ্জামের বই নিষিদ্ধ করলো? তালেবানের যুক্তি: "আজ্জাম যুক্তি দিয়ে জিহাদের ব্যাখ্যা করেছেন, বিভিন্ন পরিস্থিতিতে নিয়ম বলেছেন, এমনকি তাকফির নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন । এইসব পড়লে মানুষ বুঝে-শুনে জিহাদ করবে, অন্ধভাবে আমাদের কথা মানবে না।" অর্থাৎ এমনকি একজন জিহাদি চিন্তাবিদের লেখাও যদি মানুষকে বিশ্লেষণ করতে শেখায়, তাও তাদের কাছে অপরাধ।

ইরানি শিয়া বুদ্ধিজীবী আলী শারিয়াতি, মোর্তেজা মোটাহারি ও রামিন জাহানবেগলুর লেখা ৩১০টি বইও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কারণ তারা গণতন্ত্র, নারী অধিকারের পক্ষে কথা বলেছেন এবং বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনাকে উৎসাহিত করেছেন। এমনকি ইউসুফ আল-কারাদাওয়ির The Lawful and the Prohibited in Islam নিষিদ্ধ হয়েছে কারণ তিনি যুক্তি দিয়ে হালাল-হারামের ব্যাখ্যা দিয়েছেন এবং সামাজিক বাস্তবতার প্রেক্ষিতে ধর্মীয় রায়কে ব্যাখ্যা করেছেন। উনার বইয়ের মূল 'অপরাধ' : মানুষকে "কেন হালাল? কেন হারাম?" জিজ্ঞাসা করতে শেখানো এবং নারী-পুরুষের শিক্ষা-অধিকার সম্পর্কেও সহনশীল ব্যাখ্যা দেওয়া।

তালেবান নিজেদের আদর্শগতভাবে দেওবন্দি ঐতিহ্যের অনুসারী দাবি করলেও, তারা ওয়াহাবি প্রতিষ্ঠাতার বইও নিষিদ্ধ করেছে। তাদের যুক্তি আশ্চর্যজনকভাবে সোজা: "আমরা কারো বই পড়ি না, আমরা শুধু আমাদের মুরব্বিদের কথা শুনি।" ফলে আর ধর্মীয় গ্রন্থ বা চিন্তাবিদদের ভিন্ন ব্যাখ্যা টলানোই চলবে না । কোনো কিছুরই স্বাধীন বিশ্লেষণ আর স্থান নেই। কিছু ক্ষেত্রে তাদের কট্টরতা ISIS-K–এর প্রত্যাশা পুরণে মরিয়া । "তালেবান যথেষ্ট কট্টর নয়"—এই ধারণা থেকে নিজেদের আরো কঠোর প্রমাণ করার জন্য সব বই নিষিদ্ধ করার প্রবণতা বাড়ে।

যখন ইসলামের প্রখ্যাত পণ্ডিতদের বইই নিষিদ্ধ, তখন প্রশ্ন আসে ইসলাম কীভাবে শেখানো হবে ? তালেবানের উত্তর: "আমরা যা বলি, সেটাই ইসলাম। প্রশ্ন করবেন না।" তাদের অনুমোদিত বিষয়সমূহ হল: তালেবানের কথা শুনা; প্রশ্ন না করা; চিন্তা না করা; অন্ধ আনুগত্য প্রদর্শন। কারণ তারা বুঝে—শিক্ষিত মানুষ অধিকারের ব্যাপারে সচেতন হয়, বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা তাদের কর্তৃত্বের জন্য হুমকি সৃষ্টি করে। তাই যেকোনো ধরনের মুক্তচিন্তা, বিতর্ক বা শিক্ষার প্রসারই তাদের টিকে থাকার ব্যর্থ সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দেয়।

যে দেশে জামাল উদ্দিন আল-আফগানির মতো প্যান-ইসলামিক চিন্তাবিদদের বই নিষিদ্ধ, সেই দেশের ভবিষ্যৎ কী হতে পারে? যখন ইসলামের সবচেয়ে বড় পণ্ডিতদের গ্রন্থগুলো "বিপজ্জনক" বলে গণ্য হয়, তখন প্রকৃত ইসলাম কীভাবে টিকে থাকবে? তালেবান ইসলামের রক্ষক নয়, বরং তারা জ্ঞানের শত্রু। তারা ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠছে কারণ তারা জানে যে শিক্ষিত ও সচেতন মানুষের সামনে তাদের অযৌক্তিকতা ও দুর্বলতা সহজেই ধরা পড়ে যাবে।

আজকের আফগানিস্তানে বই পড়া অপরাধ, চিন্তা করা বিদআত, প্রশ্ন করা কুফর এবং শিক্ষা নেওয়া হারাম। তালেবানের একমাত্র স্লোগান হওয়া উচিত: "জ্ঞানই শত্রু, অজ্ঞতাই মুক্তি!" তালেবান আসলে নিজেদের ক্ষমতার রক্ষক। আর এজন্যই তারা সবচেয়ে বেশি ভয় পায় মানুষের মস্তিষ্কে থাকা সেই ছোট্ট জিনিসটিকে, যার নাম "মস্তিষ্ক"।

নোট: ছবিটি মুসলিম দুনিয়ার চেগুয়েভারা হিসাবে পরিচিত আবদুল্লাহ আজ্জামের । তিনি 'গ্লোবাল জিহাদের জনক' হিসেবে পরিচিত, বিশেষ করে সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধের সময় তার ভূমিকার জন্য, এবং ওসামা বিন লাদেনের মেন্টর ছিলেন ।তিনি ছিলেন একজন ফিলিস্তিনি-জর্ডানীয় ইসলামবাদী জিহাদিস্ট ও ধর্মতাত্ত্বিক, সালাফি আন্দোলনের অন্তর্ভুক্ত ।


সর্বশেষ এডিট : ২১ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৫ রাত ১০:৫৬
১৭টি মন্তব্য ১৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৪৪



বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

কেন বিএনপি–জামায়াত–তুরস্ক প্রসঙ্গ এখন এত তপ্ত?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে একটি পরিচিত ভয়–সংস্কৃতি কাজ করেছে—
“র”—ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে রাজনীতিতে গুজব,... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিশ্চিত থাকেন জামায়েত ইসলাম এবার সরকার গঠন করবে

লিখেছেন সূচরিতা সেন, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৪২


আমাদের বুঝ হওয়ার পর থেকেই শুনে এসেছি জামায়েত ইসলাম,রাজাকার আলবদর ছিল,এবং সেই সূত্র ধরে বিগত সরকারদের আমলে
জামায়েত ইসলামের উপরে নানান ধরনের বিচার কার্য এমন কি জামায়েতের অনেক নেতা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×