(১)
সকাল হতে না হতেই রুমের দরজায় টোকা। ঘুম ঘুম চোখে হাতড়ে খুঁজে বালিশের পাশে রাখা মোবাইলে সময় দেখলাম সকাল এগারটা। কি একটা বিশ্রী ধরনের জীবন-যাপনে অভ্যস্ত হয়ে গেছি- সারারাত জেগে সারাদিন পড়ে পড়ে ঘুমানো।
আবার দরজায় টোকা। খুব বিরক্ত হয়ে টলতে টলতে বিছানা থেকে নেমে দরজার ছিটকানি খুললাম। আমার সামনে অত্যন্ত প্রবীণ একজন লোক খুবই আপন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন, চোখের মধ্যে অদ্ভুত এক ধরনের মায়া- যে দৃষ্টি এড়ানো প্রায় অসম্ভব। ঘুম কেটে গেল একদম। সালাম দিয়ে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে লোকটাকে জিজ্ঞেস করলাম,
“আপনি কি কাউকে খুঁজছেন?”
অসলে কি বলে সম্বোধন করব বুঝতে না পেরে এভাবেই জিজ্ঞেস করলাম প্রশ্নটা। লোকটা আসলে আমার দিকে না, কি জানি একটা অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে বারবার রুমের ভিতর তাকানোর চেষ্টা করছিলেন। এমন এক দৃষ্টি যেন জায়গাটা তাঁর খুব চেনা।
“বাবা, আমি কি একটু ভিতরে আসতে পারি?”
এবার ঘুম ভাঙানোর বিরক্তিটা আমায় একটু পেয়ে বসল, কিন্তু লোকটার ঐ অদ্ভুত মায়া-দৃষ্টিকে ছাপিয়ে আমি আমার বিরক্তি প্রকাশ করতে পারলাম না।
রুমে এনে আমার বেডে উনাকে বসালাম, টেবিল ফ্যানটা উনার দিকে ঘুরিয়ে দিলাম। আমার দৃষ্টি অগ্রাহ্য করে ঐ মায়া-কারা উদাসী দৃষ্টিতে পুরো রুমটাকে একবার দেখে আমার বেডের উপর চোখ বুলিয়ে হঠাৎ একটা প্রশান্তির হাসি হেসে উনি বললেন,
“বাবা, এই বেডটাতে তুমি থাক?”
আমি বললাম, “জ্বি”
উল্লেখ্য, শহীদুল্লাহ হলের এই ২১০ নং কক্ষে আমি থাকি গত দু’মাস যাবৎ। সিঙ্গেল রুম বলে নিজের মতোই থাকি, বন্ধুবান্ধবের উৎপাত-ও কম হয়। পড়াশুনা করি, না হয় ইন্টারনেটে পড়ে থাকি আর ঘুমাই- সিঙ্গেল রুমে আসার পেছনে এটিও একটি অন্যতম কারন।
উনি বললেন, “বাবা, আমিও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম এবং আমিও এই রুমেরই বাসিন্দা ছিলাম। অনার্স ফাইনালের পর ১৯৬৫ সালে আমি এই রুম ছেড়ে দিই।”
আমার মনের মধ্যে তখন হঠাৎ করে এক অদ্ভুত মায়া, এক অদ্ভুত টান এসে ভর করল। খুবই অবাক হলাম এক নিমেষে। আমি আর কিছু বললাম না। উনি বিছানা থেকে উঠলেন। আমার রুমের দরজায় হাত বুলালেন, দেয়ালের চুনকামের উপর দিয়ে হাত বুলালেন, আমার লকারের কাঠের উপর দিয়ে হাত বুলালেন, ঘার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পুরো রুমটাকেই কয়েকবার করে দেখলেন, উপরের সিলিং এর দিকে হা করে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষন। যেন অনন্তকাল কেটে যাচ্ছে, সময় মনে হচ্ছে স্থির। আমি মুগ্ধ নয়নে দেখছি তাঁর এই ছোট্ট ঘরটাতে শিশুসুলভ বিচরণ।
বেশ কিছুক্ষন কেটে যাওয়ার পর আমরা আমার বেড-এ এসে বসলাম। প্রায় ঘন্টা দুই উনার সাথে গল্প করলাম। উনার মুখ থেকেই শুনলাম উনাদের সময়কার কিছু উত্তপ্ত ঘটনার কথা, তখনকার সময়ের পরিচ্ছন্ন ছাত্র রাজনীতির কথা। তন্ময় হয়ে শুনলাম উনাকে। তারপর দু’জন একসাথে দুপুরের খাবার খাওয়ার পর উনি আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন- আমাকে দিয়ে গেলেন এক বিশাল অভিজ্ঞতার ঝুলি আর উপদেশের বুলি।
(২)
উনি চলে যাওয়ার পরই আমার ভিতর কি জানি এক পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। আমার মনে হচ্ছে না আমি এখন ২০১০ সালের বাসিন্দা, বরঞ্চ বারবার মনে হচ্ছে আমি বাস করছি ১৯৬৫ সালে।
হলে ঢোকার আগে চেক করলাম পোষ্ট বক্স, বাড়ি থেকে কোন চিঠি আসল কি না; যদিও চিঠি নামক বস্তুটার প্রতি আমি একেবারেই অভ্যস্ত নই, জীবনে কেউ আমাকে চিঠি লিখে নি- তারপরও। আনমনে হাঁটতে হাঁটতে রুমের সামনে এসে চাবি ঘুরালাম। অদ্ভুত লাগছে পরিবেশটা। বাড়ির জন্য খু-উ-ব টেনশন হচ্ছে। অনেক দিন যাবৎ কোন খবর পাচ্ছি না কারো, কোন চিঠিও আসছে না অনেকদিন ধরে। পরীক্ষাটা শেষ হলেই এবার বাড়ি যাব। মা’র জন্য একটা শাড়ি নিয়ে যাব। ছোট ভাইটাকে দেখতে ইচ্ছে করছে খুব। এতোদিনে নিশ্চই ও অনেক বড় হয়ে গেছে। ছোট বোনটাকেও বিয়ে দিতে হবে তাড়াতাড়ি, পরে নানাজনে নানা কথা বলা শুরু করবে। বাবার কবরটাও বাঁধাতে হবে এবার বাড়ি গিয়ে। মা’কে এখনই একটা চিঠি লিখে দিই বরং।
কাকের উৎপাত খুব বৃদ্ধি পেয়েছে ইদানীং। রুমের জানালায় এসে বসে থাকে নির্ভয়ে। এমন একটা কাকের চিন্তা হয় মাঝে মধ্যে যেটি কিনা প্রতিদিনই আমার মা-ভাইবোনের কাছে গিয়ে তাদের খবর নিয়ে আসতে পারতো!
হঠাৎ মোবাইলের রিংটোনে সম্বিৎ ফিরে পেলাম। আমি তো আমার টেবিলেই বসে আছি, ওই তো জানালায় একটি কাক উদাসভাবে বসে আছে, সামনেই আমার কম্পিউটার, ইচ্ছা করলেই তো আমার বাসার সবাইকেই এখন দেখতে পারি, কত ভিডিও, কত ছবি- অভাব নেই। ইচ্ছা করলেই তো ভিডিও চ্যাট পর্যন্ত করতে পারি আম্মুর সাথে। উফফ, আম্মুই তো ফোন দিয়েছে দেখছি। থাক, এখন আর কথা বলব না, আজ সকালেই তো বললাম। এত ঘন ঘন কথা বলতে ভালো লাগে না। ঐ একই কথা- টেপ রেকর্ডারের মতো বলেই যাবে- ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করছি কি না। জীবনটা কতোই না সহজ!
হঠাৎ আনমনে চিন্তা করি, প্রায় পঞ্চাশ বছরে জীবনটা কতোই না পরিবর্তিত হয়ে গেছে। কতোই না সেকেলে ছিল সে সময়কার মানুষরা। প্রায় পঞ্চাশ বছরের আগের সে সময়কার একজন কেবলই মায়ার টানে আমার রুমে ছুটে এলেন। রুমের পরিবর্তন হয় নি কিছুই, কেবল গড়িয়েছে সময়ের চাকা। আমরাই বা আমাদের পঞ্চাশ বছর পরের সময়ের থেকে কতোই না জানি পিছিয়ে আছি। আমিও হয়তো বা কোন এক সময় লাঠিতে ভর করে ঝাপসা চোখে হাতড়ে খুঁজে খুঁজে ঠিকই একবার মায়ার টানে ফিরে আসব এই রুম-এ, অভিজ্ঞতার ঝুলি আরও কতোই না সমৃদ্ধ থাকবে তখন; তখনও হয়তো বা আনমনে একটি কাক বসে থাকবে ভাঙা শিকের ঐ জানালার উপর- নির্ভয়ে- সবই যেন এক অদ্ভুত মায়া !