বাম চোখটা প্রচন্ড মাত্রায় লাফাচ্ছে টিনুর। এগুলো আবার ভালোই পাত্তা দিচ্ছে সে আজকাল- যদিও বাস্তব জীবনে অতিমাত্রায় তথাকথিত প্র্যকটিক্যাল সে, তবে প্রাকৃতিক উপস্বর্গ গুলো সে একদমই এড়িয়ে চলতে পারে না।
সারাটাদিন তার আজ অন্যান্য দিনের তুলনায় খুব ভালো ঘুম হয়েছে। সন্ধ্যার পর বাসার সবার সাথে সে যখন বের হয়, তখনো খুব উৎফুল্ল ছিল সে। সবাই যার যার মতো বিভিন্ন জায়গায় চলে যাওয়ার পর থেকেই তার এই বাম চোখ লাফানো টার শুরু। কোনো বিপদ অপেক্ষা করছে না তো আজ? চিন্তায় পড়ে গেল টিনু। বাসায় কি ফিরে যাবে সে? বাসায় ফিরে গেলে তো সে না খেয়েই কাল সকালে মরে যাবে। মাঝে মাঝে ভাবে সে, ইশ্, আমি যদি ওদের সন্তানদের মতো হতে পারতাম, তাহলে বাবা-মা কতো ধরনের খাবার বাসায় নিয়ে আসতে পারতো। আমার খাবার সবসময়ই আমার নিজের গিয়ে খেয়ে আসতে হতো না।
টিনুর বাম চোখটা এখনো লাফাচ্ছে ক্রমাগত- যেন ব্যান্ডের ড্রাম বাজাচ্ছে কেউ। চিন্তা করতে করতে সামনে তনুর সাথে দেখা। তনু তার বড়।
"কি রে, এভাবে ঘুরাঘুরি করছিস ক্যানো?" জিজ্ঞেস করলো তনু।
"আমাকে নিয়ে তোমার চিন্তা না করলেও চলবে। খেয়ে দেয়ে তো দেখছি এই সন্ধ্যাতেই পেট ফুলিয়ে এসেছো। রাতে কি করবে?" জবাব টিনুর।
"তোর মতো না কি, শুটকী? খেতে যোগ্যতা লাগে, বুঝলি? যা ভাগ।" বলে অস্বাভাবিকভাবে ফুলে ফেঁপে উঠা দেহটাকে টলাতে টলাতে চলে গেল তনু।
যোগ্যতার কথাটা খুব গায়ে লাগল টিনুর। আসলেই তো তাই- তার বয়সের তার সঙ্গীরা সবাই কতো সাবলীলভাবে খেয়ে আসতে পারে এমনকি তার ছোটরাও- কোন মিস হয় না কারো। শুধুমাত্র তার বেখেয়ালীপনাই তার অযোগ্যতার জন্য দায়ী- ভাবে সে। প্রতিদিনই একটু আধটু যা-ও খায়, তাও আবার সেই গভীর রাতে। এই সন্ধ্যারাতে খেতে যাওয়ার সাহস পর্যন্ত সে করতে পারে না। এই তো, তনু কি সুন্দর এই সন্ধ্যারাতেই কোন অঘটন ছাড়াই নিজ যোগ্যতা প্রমাণ করে খেয়ে আসল। মনটাই তেঁতিয়ে উঠল টিনুর।
নাহ, আজ সন্ধ্যারাতেই খাবো, যেভাবেই হোক- চিন্তা করলো টিনু। সামনের জানালা দিয়েই ঢুকল সে। এখানে আগেও কয়েকদিন এসেছে সে। বাসার ছেলেটা খুব ভালো। খেতে দেখলেও তাকে কিছুই বলে না। অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে তার দিকে। কিন্তু, অন্যরা সবাই খুবই নিষ্ঠুর- দেখলেই তেড়ে আসে।
ঘরে ঢুকেই ছেলেটাকে শুয়ে থাকতে দেখল সে। সে ঠিক ভেবে পেলো না, এই সময়ে ছেলেটা শুয়ে আছে কেনো। কারন ওরা সাধারনত এই সময়ে শোয় না। ছেলেটার মাথার কাছে এক মহিলা বসে আছেন। মহিলাটাকেও আগে কয়েকবার দেখেছে টিনু।
নাচতে নাচতে চারদিক ঘুরে ছেলেটার কাছাকাছি এলো টিনু। এখন কেনো জানি মনটা ভালো লাগছে তার- যদিও বাম চোখের ছন্দটার মোটেও পতন হচ্ছে না। কি জানি এক অজানা আশঙ্কায় ডুবে গেল টিনু। নাহ, এতো কিছু চিন্তা করলে হয় না। খুব সাবধানে মহিলাটার দিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে ছেলেটার কপালে এসে বসলো টিনু। আজ বড়ই উত্তপ্ত লাগছে জায়গাটা কেন জানে না টিনু।
আজ তাকে দেখাতেই হবে তার যোগ্যতা- ভাবল টিনু ............ শূঁড়টা বের করে ঢুকিয়ে দিল ছেলেটার কপালে - আহ, কি শান্তি ............ এক মাতাল অনুভবের দোলা বয়ে গেল টিনুর সারা দেহে ........................ কি শান্তি, কি সুখ ........................ তনুকে অন্তত দাঁতভাঙা জবাব দেবে সে ........................ তাঁর চেয়েও বেশী ফুলে ফেঁপে উঠবে খানিক বাদে .................................... বাম চোখটা ক্রমাগত লাফিয়েই চলছে তার।
চটাস শব্দে ঘুম ভাঙল রাশেদের।
"উফফ, মা এইভাবে কেউ মশা মারে? মাথাটা তো ছিঁড়ে যেতো এখনই। যাও প্লীজ। জ্বর সেরে গেছে আমার।"
"কি বলিস, একটু আগেও তো অনেক জ্বর ছিল।"
"এখন নেই মা। তুমি যাও তো। ভাল্লাগছে না কিছু। প্লিজ যাও।"
মা চলে যাওয়ার পর রাশেদ তার বালিশের পাশে পড়ে থাকা এই একটা মশার মৃতদেহ খুবই যত্নের সাথে দুই আংগুল দিয়ে তুলে একটি বইয়ের পাতার ভিতর রেখে বই চাপা দিয়ে রেখে দিল। জ্বর আসলেই নেই, কিন্তু কি জানি একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে কোথাও। কপালের ঠিক কোন এক বিন্দুতে যেন সমস্ত জ্বর টাই আগ্নেয় গিরির ম্যাগমার মতো জড়ো হয়েছে, যখন তখনই লাভা হয়ে বেরিয়ে পড়বে। দপ দপ করছে রাশেদের মাথাটা।