somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভাতৃত্বের অপরাধবোধ

১৫ ই জানুয়ারি, ২০১৫ দুপুর ২:৫৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পরন্ত বিকেলের মৃদু বাতাস শরীরে এসে লাগছিল।এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম নীল আকাশটার দিকে।কোন যে দৃষ্টিভ্রমে হারিয়ে গিয়েছিলাম খেয়াল ছিল না। হঠাত কাঁচের চুরির ঝংকারে বাস্তবে ফিরলাম।
-কি ভাবছেন?
-কিছুনা। তারপর কি যেন বলছিলে?
-এর মধ্যেই ভূলে গেছেন? আপনাকে নিয়ে আর পারলাম না। এত্ত মনভোলা কেন আপনি? কি জানি কবিরা হয়ত এমনই হয়।
-না আসলে তেমন কিছুনা। বল তুমি আমি শুনি।
-এখন তো চা ছাড়া গল্প জমবেনা! বাসায় চা-পাতি আছে?
-আছে তুমি থাক আমি চা করে আনি।
-না আপনি বসে বসে মেঘ দেখুন, আমি আজ আপনাকে চা করে খাওয়াব।
নিশাত চলে যাওয়ার পর আকাশের দিকে তাকাই।কেমন এক বিষন্নতা আমাকে গ্রাস করে।মেয়েটির সাথে পরিচয় হয়েছিল একুশে বই মেলায়। আমার লিখা একটা বই ছেপেছিল সেবার। খুব উৎসাহ নিয়ে গেলাম মেলায়। আলোক প্রকাশনীর স্টলের কাছে জেতেই থমকে দাঁড়ালাম-
-এক্সকিউজ মি!
-আমাকে বলছেন?
-জী! আপনাকেই। আপনি নিশ্চই মি স্বাধীন!
-জী!তবে আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না!
-আমি নিশাত; ফার্মাসীর দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছি।আপনার একটা লিখা বেরিয়েছে এবারের মেলায় তাইনা?
-জী! তবে আপনি আমাকে চিনলেন কি করে?
-পৃথিবীটা গোল। কাওকে খুঁজে বের করা এত কঠিন নয়। আচ্ছা আপনি বিরক্ত হচ্ছেন নাতো ?
-না। আসলে ঠিক তা নয়।
-আচ্ছা আমরা কি কোথাও বসতে পারি?
-কিছু মনে করবে না। আসলে আমার কিছু কাজ ছিল।
-আচ্ছা ঠিক আছে ,আমরা না হয় অন্যকোন দিন কথা বলব।
-আসি তাহলে!
মেয়েটি চলে যাওয়ার পরে কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে যাই।অতীত নামক আলেয়ার মায়াজালে জড়িয়ে পড়ি।চার বছর আগে একটা সড়ক দুর্ঘটনার স্মম্মুখীন হয়েছিলাম। আমাদের বাসের সাথে মালবাহী একটি ট্রাকের সংঘর্ষে বাস খাদে পরে যায়। আমি আর আমার বোন স্বচ্ছ চট্টগ্রাম যাচ্ছিলাম ওর চবি তে ভর্তরিা জন্য।দুর্ঘটনায় আমি জানালা দিয়ে ছিটকে পড়ে জ্ঞান হারাই। জ্ঞান ফেরার পর নিজেকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে আবিস্কার করি।কিন্তু নিয়তি স্বচ্ছকে ক্ষ্মা করেনি। আমার বুকটা খালি করে নিয়ে গেছে ওকে। আর দিয়ে গেছে সীমাহীন শূন্যতা। স্বচ্ছের সাথে নিশাতের চেহারার অনেক মিল। বিশেষ করে চোখেরঃকেমন যেন মায়ায় ভরা,টলটলে-মনে হয় এখ্যুনি কেঁদে ফেলবে।
কাপের শব্দে ভ্রম ভাংলো।
-আপনি এত অগোছালো কেন বলুনতো? চিনি আর চা-পাতি পেতে আমাকে রীতিমত তল্লাশী চালাতে হয়েছে।
আমি মৃদু হাসি। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে দূর পাল্লার দু’টি ঘুড়ি দেখতে পাই। একটি আরেকটিকে ধরার চেষ্টা করছে, কিন্তু অপরটি ধরা দিচ্ছেনা।
নিশাতে সাথে পরিচয় হবার পর থেকে ওর প্রতি স্পর্শকাতর অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছে। সবই ওর মাঝে স্বচ্ছের চোখ আর স্বচ্ছের মতো জেদের কারণেই। ও কাছে থাকলে ভালো লাগে।কেন যেন ওর মাঝে স্বচ্ছকে খুঁজে পাই। আগে স্বচ্ছকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখতাম।এখন তা কমে এসেছে।
হঠাত ও বলল-
-আপনার বাসায় কেউ থাকেনা? বিয়ে না হয় করেননি বুঝলাম।
-বাবা-মা গ্রামের বাসায় থাকেন আর এখানে থাকি আমি আর…………।
কন্ঠনালীতে কথা আটকে যায়।স্বচ্ছের কথাটা মাথায় আসতেই মাথাটা একটা জমাট বাঁধা কুঠুরির মতো মনে হতে থাকে।
-আপনি আর?
-না কিছুনা। তুমি কিন্তু খুব ভাল চা বানাও!
-থাক আর বলবেন না। চা না ছাই।
-বিকেল পেড়িয়ে গেল; বাড়ি যাবেনা?
-না। আজ আপনার সাথে সূর্যাস্ত দেখব, তারপর যাব।
আমার বুকটা ধক করে ওঠে। স্বচ্ছ আর আমি প্রতিদিন ছাদে সূর্যাস্ত দেখতাম। বাতাসে উবে যাওয়া মুড়ি ছিল আমাদের নিত্যদিনের সংগী। যতই নিশাতকে দখি ততোই স্বচ্ছের হাতছানি দেখতে পাই। সূরযাস্তের পর নিশাত চলে গেল।
দিন কাটতে থাকে।লিখালিখি আর প্রকাশনা নিয়ে ব্যস্ত থাকি। নিশাতের আমার বাসায় আসা-যাওয়া বেড়েছে। প্রায়ই কিছু না কিছু রান্না করে নিয়ে আসবে। এসে হয় আমাকে বকা দিবে নয়তো নিজে মুখ গোমড়া করে বসে থাকবে। এইত কয়দিন হল পাঞ্জাবি ছেড়ে শার্ট পড়া ধরেছি।নিয়মিত শেভ করতে হয়। নিশাতের ‘স্বচ্ছ’ময়তা যেন আমাকে জেকে বসেছে। ও না আসলে ভাল লাগেনা।
একরকম সুখেই কেটে যাচ্ছিল দিন। বিধাতার মনে হয় তা সহ্য হলনা। আমার সাথে তার কোল্ড ওয়ারটা বিশেষ পুরোনোই বলতে হবে। ১৪ই জানুয়ারী পুরান ঢাকায় ‘শাকরাইন’ উৎসব হয়। এটা মূলত ঘুড়ি উৎসব। নানা রকম ছোট-বড় শতশত ঘুড়িতে আকাশ ছেয়ে থাকে।
ছাদে বসে ছিলাম। নিশাত এল। অবাক হয়ে দেখলাম ওর হাতে একটা ঘুড়ি।
-আসেন ঘুড়ি উড়াই।
স্বচ্ছ যেন আমাকে আঁকড়ে ধরল।
-আজ ভাল লাগছেনা।
নিশাতের মুখটা শুকনা দেখায়। আমি বিব্রতবোধ করি। কিছুকাল নিরবে কাটে। ছাদের রেলিং ধরে নিশাত অন্যমনস্ক মনে বাইরে তাকিয়ে থাকে। হঠাত নিরবতা ভাঙে-
-আপনার সাথে কিছু কথা ছিল!
-হুম। বল!
-বাসা থেকে আমার জন্য পাত্র দেখছে।
-ভাল তো।
-ভাল মানে?
আমার ভ্রম ভাঙে। নিষাতের ‘স্বচ্ছ’ময়তার জন্য আমি ওর ভিতরের নিশাতকে দেখতে পাইনি।ওয় মনে কি আছে না আছে তা বোঝার চেষ্টা করিনি।অসহায় লাগে নিজেকে।
-আজ আমার বিশেষ ভাল লাগছেনা।তুমি বরং আজ যাও, অন্যএকদিন কথা বলব।
-কি হল আবার আপনার?
-কিছুনা। তুমি যাও।
শুকনো মুখে নিশাত চলে যায়।পুরো সন্ধেটা কেমন যেন কাটে! ঘড়র কাটা যেন অসুরের খড়গের সাথে লড়ে অবশেষে হার মানে।
দুদিন হয় নিশাত আসেনা।কেমন যেন লাগে! রাগ করলো নাকি? ও তো আর জানেনা স্বচ্ছ সম্পর্কে! নিজের চিরাচরিত টেবিল চেয়ারে বসি। কিছু লিখব বলে কলম তুলে নেই। কি যেন একটা গরমিল দেখি টেবিলে। আমার ডায়রীটা নেই। সেখানে স্বচ্ছ ও নিশাত সম্পর্কে অনেক কিছু লিখেছিলাম, স্বচ্ছের কিছু ছবিও ছিল। নিশাত কি ডায়রীটা নিয়ে গেল? নিজেকে নিরূপায় মনে হয়। ডায়রীটা পড়ার পর ওর অনুভূতি কি হবে এটা ভেবে আমার ভিতরটা হুহু করতে থাকে। ওকে ফোন দেই।আনরিচেবল দেখায়। আমার মাথাটা শুণ্য হয়ে আসে। অর জন্য খারাপ লাগতে থাকে। রাতে ঘুম এলোনা, এপাশ-ওপাশ করতে করতে চলে যায়।ঠিক করলামন সকালেই অর বাসায় যাব।
সকাল আটটার দিকে ছুটলাম ওর বাসার দিকে।পৌছুতেই অবাক হলাম। অনেক ভীড়।পুলিশের গাড়ি দেখা যাচ্ছে। কৌতুহুলী হলাম। বাড়িতে ঢুকতেই কান্নার আওয়াজ কানে এল। শুনলাম নিশাত গতকাল রাতে সুইসাইড করেছে। অনুভূতি হারিয়ে গেল। অর ঘরে গেলাম যেখানে ওকে রাখা হয়েছে। পা লোহার মতো ভারি লাগছিল।চারিদিকে স্বজনদের হাহাকার। টেবিলে আবিস্কার করলাম ডায়রীটা। এ ঘটনায় পাছে আমার কিছু হয় আশঙ্কা করে মানবতার মুখে কুলুপ এটে স্বার্থপরের মত গা ঢাকা দিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম।
কয়েকদিন গেল। সাহস হচ্ছিলনা, তারপরও একদিন সাহস করে ডায়রীটা খুললাম। সব ঠিকঠাকই আছে কিন্তু শেষপাতায় একটি লেখার ওপর চোখ আটকে গেল-
“আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি স্বচ্ছ হতে পারিনি। স্বচ্ছ হয়ত ক্ষমা করবেনা। অন্তত আপনি করুন।”(নিশাত)
পুনশ্চঃ অনেকদিন কেটে গেছে। সবই ঠিক আছে। শুধু নিশাত আর আসেনা। বকা দেয় না। অভিমান করেনা। স্বপ্ন দ্দেখা বেড়ে গেছে; প্রায়ই দেখি- একজোড়া চোখ তাকিয়ে থাকে আমার দিকে।অপরাধবোধ কাজ করে আমার মাঝে। চোখদুটো স্বচ্ছের না নিশাতের দ্বিধায় পড়ে যাই। নিষ্পাপ, মায়াভরা,টলটলে দুচোখ অভিযোগ নিয়ে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে……।।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে জানুয়ারি, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:৪৪
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মামুনুলের মুক্তির খবরে কাল বৃষ্টি নেমেছিল

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৪৯


হেফাজত নেতা মামুনুল হক কারামুক্ত হওয়ায় তার অনুসারীদের মধ্যে খুশির জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ তো বলল, তার মুক্তির খবরে কাল রাতে বৃষ্টি নেমেছিল। কিন্তু পিছিয়ে যাওয়ায় আজ গাজীপুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ অপেক্ষা

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২৩



গরমের সময় ক্লাশ গুলো বেশ লম্বা মনে হয়, তার উপর সানোয়ার স্যারের ক্লাশ এমনিতেই লম্বা হয় । তার একটা মুদ্রা দোষ আছে প্যারা প্রতি একটা শব্দ তিনি করেন, ব্যাস... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদে মসজিদে মোল্লা,ও কমিটি নতুন আইনে চালাচ্ছে সমাজ.

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

গত সপ্তাহে ভোলার জাহানপুর ইউনিয়নের চরফ্যাশন ওমরাবাজ গ্রামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। লোকটি নিয়মিত মসজিদে যেত না, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েনি, জানা গেল সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল, স্বীকারোক্তিতে সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×