“হ্যালো.. মুনা?” ফোনের ওপাশে পংকজের কাঁপাকাঁপা কণ্ঠ।
“হ্যাঁ।”
“মুনা.. অপু আর নেই!”
“নেই মানে কি?” মুনার কথাটা বুঝতে অসুবিধা হলো। “ও তো আজ সারাদিন আমার সাথেই ছিল।”
“তোকে পৌঁছে দিয়ে ফেরার পথেই অ্যাক্সিডেন্টটা হয়েছে...” এইটুকু বলেই পংকজ কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো।
মুনাও আর বাকিটা শোনার অপেক্ষায় রইলনা। উদ্ভ্রান্তের মতন ছুটতে লাগলো। ওকে ওর অপুর কাছে এখন যেতেই হবে। ওর বিশ্বাস ও অপুর কাছে গেলেই পংকজের কথা মিথ্যা প্রমাণিত হবে। তাই মুনা দ্রুত ছুটতে লাগলো। কিন্তু পথ যেন আজ ফুরোতেই চাচ্ছেনা...।
.
প্রচন্ডরকম ছটফট করতে করতে ঘুম ভাঙ্গল মুনার। দেখলো ঘামে ওর সারা শরীর এমনকি বিছানার চাদরটাও ভিজে গেছে। কেন এমন স্বপ্নটা দেখলো সে? অস্থিরভাবে ফোনটা হাতে তুলে নিল। রাত বাজে আড়াইটা। ডায়াল লিস্টের প্রথম নাম্বারটাতেই কল দিলো। এক রিং হতে না হতেই ভেসে এল সেই অতি পরিচিত কণ্ঠস্বর। হাজার হাজার কণ্ঠের ভীড়েও এই কণ্ঠটা চিনতে মুনার একটুও ভুল হবেনা।
“কি হয়েছে ‘মন’?” অপুর সেই পরিচিত ডাক।
“আ-আমি খুব খারাপ একটা স্বপ্ন দেখেছি। আমার খুব ভয় লাগছে।”
“স্বপ্ন তো স্বপ্নই। বাস্তব না। এ নিয়ে এত ভয় পাচ্ছো কেন?”
“স্বপ্নটা আমি তোমাকে নিয়ে দেখেছি।”
“সারাদিন যাকে নিয়ে ভাবো রাতে তাকে নিয়েই স্বপ্ন দেখবে এটাই তো স্বাভাবিক। নাকি অন্য কাউকে দেখতে চাও স্বপ্নে?” বলেই হাসতে শুরু করলো অপু।
“তোমার সাথে সিরিয়াস কিছু বলাই বৃথা। এত রাত অবধি জেগে আছো কেন শুনি?” মুনার কণ্ঠে কপট রাগ।
“আমি জেগে না থাকলে ভয় পেয়ে কাকে ফোন দিতে বলো? আচ্ছা বলো তো আমাদের দেখা হয়না কতদিন হলো?”
“কি জানি! মনে হয় দুই সপ্তাহ।” অনিশ্চিত কণ্ঠে বললো মুনা।
“উহু। ষোলদিন।”
বিব্রতবোধ করলো মুনা। ও সারাক্ষণ অপুকে নিয়ে টেনশনে থাকে। অথচ ওইই ভুলে গেছে দিনক্ষণ। এতদিন অপুকে না দেখে থেকেছে বলেই বোধহয় এমন একটা বিচ্ছিরি স্বপ্নটা দেখলো। প্রথমে ওর নিজের পরীক্ষা ছিল; তারপর ও যে কোচিং সেন্টারটাতে পড়ায় সেখানের স্টুডেন্টদের পরীক্ষা ছিল। তার উপর অপুও ঢাকার বাইরে ছিল তিনদিন। ওদের ব্যান্ডের একটা প্রোগ্রাম ছিল। তাই এই দীর্ঘ বিরহ!
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুনা বললো-
“চলো, কাল সারাটাদিন আমরা একসাথে থাকি।”
“জো হুকুম! এখন তাহলে ঘুমাও।”
“আর তুমি?”
“আমি একটা নতুন সুর তুলছিলাম। তবে মনে হচ্ছে এখন আর হবেনা। আমার ‘মন’এর মন খারাপ থাকলে আমি গিটার বাজাই কিভাবে?”
.
লালমাটিয়ায় যে হোস্টেলটাতে মুনা থাকে তার মালিক ‘আন্টি’ খুব কড়া। রাত নয়টার মাঝে মেয়েরা হোস্টেলে না ফিরলে খুব বকাঝকা করেন। অপুর বাইক যখন হোস্টেল থেকে একটু দূরে মুনাকে এনে রাখলো তখন ঘড়িতে বাজে সোয়া নয়টা। অন্যদিন হলে মুনা খুব অস্থির হয়ে থাকতো আন্টির ভয়ে। কিন্তু আজ ও নিজেই দেরি করছে। অপুকে ছাড়তে চাইছেনা কিছুতেই। ব্যপারটাতে অপু অবাক হলেও কিছু বললো না।
মুনা বাইকের পাশে দাঁড়িয়ে হঠাৎ বলে উঠলো, “তোমাকে ভালবাসি।”
“কি অদ্ভুত! আমরা প্রায় দু’বছর ধরে একে অপরকে ভালবাসি অথচ আজকের আগে কখনো বলিনি।” অপুর কণ্ঠে বিস্ময়।
“কারন কখনো বলার দরকার পড়েনি।” মুনা লাজুক হেসে বললো।
“হ্যাঁ! প্রথম আমি যেদিন তোমাকে প্রপোজ করলাম সেদিন ‘ভালবাসি’ কথাটুকুও না বললেও তুমি কিভাবে যেন বুঝে গিয়েছিলে! ব্যপারটা আজও আমার কাছে একটা বিস্ময়.. কিভাবে বুঝেছিলে?”
“বলবো। একদিন তোমাকে ঠিকই আমি এই সিক্রেটটা বলবো।” চোখে রহস্য নিয়ে বললো মুনা।
“আমি তোমাকে ভালবাসি মন। এখন থেকে সবসময় বলবো.. ওকে?”
কিছু না বলে মাথাটা শুধু একপাশে কাত করলো মুনা।
“এখন রুমে যাও। নাহলে পরে তোমার আন্টি রেগে গিয়ে আমদের বিয়েটাই না ভেঙ্গে দেয় সিনেমার ভিলেনদের মতন।”
“আচ্ছা। আসি। সাবধানে যেও। পৌঁছে ফোন দিও। আর বাইক বেশি জোরে চালিও না।”
“তোমার জন্যে তো বাইক এখন ধীরেই চালাই।”
মুনা একটু হেসে চলে গেল। কিন্তু ওর চোখের বিষন্নতাটুকু অপুর নজর এড়ায়না। আজ সারাদিন মুনা ওর সাথে ছিল। কিন্তু তবু যেন ছিলোনা বলে মনে হলো অপুর।
.
ঘরে এসে মুনা অপুর ফোনের অপেক্ষা করতে করতে পুরনো কথা মনে করতে লাগলো। কত ভিন্ন ছিল ওদের দু’জনের চলার পথ। স্কুল টিচারের মেয়ে মুনা বিশ্ববিদ্যালয়ে সবে ভর্তি হয়েছে। পৃথিবীটা তখনও বড্ড অচেনা। আর অপু একটি উঠতি ব্যান্ডের ভোকাল। তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। ওই ব্যান্ডেরই ড্রামার পংকজ ছিল মুনার ক্লাসমেট। একদিন ভার্সিটির একটা প্রোগ্রামে মুনা-অপুর প্রথম দেখা। সব মেয়েরা অপুর ভক্ত। সারাক্ষণ অপুকে ঘিরে তাদের মাতামাতি। তাদের টপকে সাদাসিধে মুনার নির্লিপ্ত চোখজোড়া অপুকে আটকে ফেলে। পংকজের মাধ্যমে পরিচয়। তারপর অপুর একপা দু’পা করে মুনার মনের কাছাকাছি এগিয়ে আসা। মুনা বুঝেও বুঝতে চায়না অপুর নিরব আগ্রহ।
এক রাতে মুনা স্বপ্নে দেখে অপুকে। প্রথমবারের মতো। অপু এক অজানা নদীর তীরে বসে মুনাকে বলছে, “মুনা, আমার বুকের ভিতর এক অস্থির প্রজাপতির ওড়াউড়ি। এই প্রজাপতিটা আমাকে ঘুমাতে দেয়না.. গান বাঁধতে দেয়না। তুমিই পারো তাকে থামাতে।”
“আমি? কিভাবে?” মুনা স্বপ্নের মাঝেই অবাক হয়।
“তুমিই যে সেই প্রজাপতি, মুনা।”
এমন অদ্ভুত স্বপ্নে মুনা হতবিহ্বল হয়ে যায়। যার এত মেয়ে ফ্যান সে কেন তার প্রতি দূর্বল হবে? কিসব চিন্তাভাবনা। নিজের উপরই বিরক্ত হয় মুনা। তবে তাকে ভীষণভাবে চমকে দিয়ে একদিন ঠিকই প্রপোজ করে বসে অপু। স্বপ্নের মতন কোন নদীর তীরে বসে নয়। ভার্সিটির ভীড় গমগমে ক্যাফেটেরিয়ায় বসে চারপাশের সবকিছু অগ্রাহ্য করে অপু বলে উঠে, “মুনা, আমার বুকের ভিতর এক অস্থির প্রজাপতির ওড়াউড়ি..”
মুনা না বলে থাকতে পারেনি। মুচকি হেসে বললো, “আমি জানি, সেই প্রজাপতিটা আমিই...”
.
এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে চোখ লেগে গিয়েছিল মুনার টেরই পায়নি। জেগে গেল ফোনের রিংটোনের শব্দে। নিশ্চই অপু। পৌঁছে ফোন দেয়ার কথা। কিন্তু ফোনটা হাতে নিয়ে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চাইলো ওর। ভিতরের একটা সত্তা প্রবলভাবে নিষেধ করা সত্ত্বেও মুনা ফোনটা রিসিভ করলো।
“হ্যালো.. মুনা?” ফোনের ওপাশে পংকজের কাঁপাকাঁপা কণ্ঠ...