এমনিতে গ্লাসের দিকে তাকানো হয় না। ক্যান জানি ভাল্লাগে না। গতকাল গ্লাসে তাকিয়ে হঠাত দেখি কয়েকটা চুল এক্কেবারে শুভ্র হয়ে গেছে, দাঁড়িগুলোও বেয়াড়া বেয়াড়া হয়ে গেছে। নিজেকে নিজের কাছে অচেনা অচেনা মনে হচ্ছিল। নিউরনে তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে, স্মৃতি থাপ্পড় মারছিল অবয়বে।
আমি তো সেই ছেলে যে কী না ভাইয়াদের সাথে মাদরাসায় গিয়ে পেছনে বসে বসে আলিফ-বা-তা এইসব পড়তাম। ভাইয়ার ক্লাসে জোরে জোরে পড়ানো হত, ‘করিমা ববক্সা এবার হা লিমা/ কে হাস্তম আছিরে কমন দে হাওয়া’। সেই ফরিদুদ্দিন আত্তার, শেখ সাদি প্রমুখের ফার্সি শেয়ারগুলো এখনও কানে বাজছে যেন! তখন বয়স বড়জোর তিন থেকে সাড়ে তিন। অন্যসবার মতো আমার প্লে-নারসারি-কেজি এইসব পড়ার সৌভাগ্য হয় নি। ঘরের সাথে লাগানো ছিল মাদরাসা, সেখানেই মনে হয় ক্লাস টু থেকে পড়াশোনা শুরু। তারপর আসতে আসতে চলতে থাকে দিন। পূর্ণিমার রাতে বাড়ীর উঠোনে সেই এলাহি কাণ্ড। কত্ত রকমের খেলাধুলা! বড় ভাইয়ারা শীতের রাতে যেত খেজুরের রস চুরি করতে, তারপর তা দিয়ে শিরনী। আবার কখনো কখনো চলতো নারিকেল চুরির মহোৎসব। এমনও ঘটেছে যে, যাদের গাছের নারিকেল চুরি হচ্ছে সে সাথে আছে কিন্তু জানে না। বরষায় সেই টিনের চালের শব্দ, এমন মায়াবী শব্দ দুনিয়াতে আর দ্বিতীয়টি আছে কি না সন্দেহ আছে। যেন বিতফেনের নবম সিম্ফনি।
এভাবে ঘরের মাদরাসায় ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়লাম। তারপর আম্মু আর বড় ভাইয়ার স্বাদ জাগল আমাকে শহরের ভালো একটা স্কুলে পড়াবে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। আমিও ভর্তি হয়ে গেলাম সেন্ট প্ল্যাসিড’স হাই স্কুলে। নগরীর পাথরঘাটায়। গির্জা স্কুল নামে অধিক পরিচিত। ভর্তি পরীক্ষা দেই নি। এখনও মনে আছে ১২ হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে ভর্তি হয়েছিলাম ক্লাস ফাইভে। আম্মু তার গয়না বিক্রি করে সে টাকা জোগাড় করেছিল। কারণ আব্বু চায় নি, আমি এত দূরে শহরে গিয়ে পড়াশোনা করি। আর এত দূরে আমাকে আনা-নেওয়া কে করবে। এত্ত সকালে কীভাবে যাবো। আর বরষাতে কর্ণফুলীর ঢেউগুলোও ফুলে ফেঁপে উঠে। এমন অনেক অজুহাত দিয়ে আব্বু আমাকে ভর্তি করাতে রাজী ছিল না। তারপরেও আম্মু নাছোড়বান্দা হয়ে ভর্তি করিয়েছিল। মার্চের কোনোএক উষ্ণ সকালে আমার পদার্পণ হয়েছিল স্কুলে। স্কুল ক্যাম্পাস দেখে তো মনে খুশির জোয়ার বয়ে গিয়েছিল। এত্ত সুন্দর স্কুলও থাকে!
ফেলেসকাল আঁটটা থেকে স্কুল ছিল। ঘুম থেকে উঠতে হত সাড়ে ছয় টায়। তারপর সাতটার দিকে বের হতাম। পনের মিনিট লাগতো হেঁটে ঘাটে আসতে। তারপর সাম্পান দিয়ে পার হতে লাগতো মিনিমাম দশ মিনিট। সকালে আমার পথের সঙ্গী হিসেবে থাকতো কিছু গার্মেন্টস কর্মী আর সবজি বিক্রেতা। পার হয়ে বাংলাবাজার থেকে রিকশায় যেতাম স্কুলে। বিশ মিনিট মতো লাগতো।