somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হলুদ সাংবাদিকতার ইতিহাস ও একে ঘিরে আমার বর্তমান পর্যবেক্ষণ

১০ ই জুন, ২০২৪ রাত ৯:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



বর্তমান সময়ে 'হলুদ সাংবাদিকতা' কথাটার সাথে পরিচিতি নেই, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। এসব মানুষের মধ্যে যারা আবার একটু বিবেকের ধার ধারেন, তারা বরং এ বিষয়টা নিয়ে বেশ বিরক্ত-ই। এখন এমন অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে সাংবাদিকদের তুলনায় হলুদ সাংবাদিকরাই যেন পরিমাণে বেশি। তো বর্তমান সময়ে দাপট দেখিয়ে বেড়ানো এই হলুদ সাংবাদিকতার শুরুর এক কাহিনি আছে- এ কাহিনি উনবিংশ শতকের শেষাংশের ইতিহাস, দুটো প্রতিযোগী পত্রিকার ঠোকাঠুকির ইতিহাস।

১৮৮৯ সালে জোসেফ পুলিৎজারের (জ্বি, বর্তমানে এ ব্যক্তির নামেই 'পুলিৎজার পুরস্কার' প্রচলিত রয়েছে) অধিকৃত পত্রিকা ওয়ার্ল্ড ধারাবাহিকভাবে "Hogan's Alley" নামে একটি ব্যঙ্গচিত্র ছাপাতে শুরু করে। এ ব্যঙ্গচিত্রের 'বিষয় ছিল শহরের জনাকীর্ণ অঞ্চলের বসতবাড়িগুলোর জীবনযাত্রা, আর এর মূল চরিত্র- আলখেল্লা পরিহিত একটি ফোকলা শিশু'। ১৮৯৩ সালে যখন সংবাদপত্র মুদ্রণে রঙের ব্যবহার শুরু হয়, তখন পরীক্ষামূলকভাবে ফোকলা শিশুটির আলখেল্লায় একটু হলুদ রঙের ছোপ লাগিয়ে দেয়া হলে সে Yellow Kid of Hogan's Alley বা 'হোগানের গলির হলুদ বাচ্চা' নামে ব্যাপক সাড়া ফেলে আর তার বদৌলতে ওয়ার্ল্ড পত্রিকার বিক্রি তুমুল হারে বেড়ে যায়।

এরপরে ১৮৯৫ সালে মার্কিন সংবাদপত্র জগতের অন্যতম প্রকাশক William Randolph Hearst নিউইয়র্কের আরেকটি সংবাদপত্র জর্নাল কিনে নিয়ে ওয়ার্ল্ড-এর সঙ্গে তীব্র প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হন। তখন তিনি প্রতিযোগিতার প্রমাণস্বরূপ ওয়ার্ল্ড-এর সম্পাদকগোষ্ঠীর অনেককেই অধিক বেতনের বিনিময়ে নিজের পত্রিকায় নিযুক্ত করেন। এদের মধ্যে সেই Yellow Kid of Hogan's Alley-এর নির্মাতা Richard. F. Outcault-ও ছিলেন। তখন একই সাথে জর্নালে Outcault-এর আঁকা Yellow Kid ব্যঙ্গচিত্র ও ওয়ার্ল্ডে ভিন্ন এক চিত্রকরের আঁকা Yellow Kid ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশিত হতে থাকে।

কিন্তু এ দুই পত্রিকার মধ্যকার প্রতিযোগিতা ক্রমশই ফোকলা শিশু থেকে বেরিয়ে এসে অন্যান্য সংবাদের ক্ষেত্রেও বিস্তৃতি লাভ করতে থাকে। কে কত বেশি অতিরঞ্জিত সংবাদ উপস্থাপন করে পাঠক আকৃষ্ট করতে পারে- এই যেন হয়ে ওঠে এদের মূল লক্ষ্য। এদের এমন বিকৃত প্রতিযোগিতা পর্যবেক্ষণ করে সমসাময়িক প্রেস কাগজের সম্পাদক Ervin Wardman বিরক্ত হয়ে এ দুটি কাগজকেই 'Yellow Press' নামে নিন্দিত করেন। তাঁর নামকরণের প্রথম অংশটির উদ্ভব-ইতিহাস সেই হলুদ শিশুর ব্যঙ্গচিত্র কেন্দ্রিক প্রতিযোগিতাকে চিহ্নিত করলেও পরবর্তীতে এটি 'দায়িত্বজ্ঞানহীন সস্তা চটুল উত্তেজক খবর প্রচারের সমর্থক' হয়ে দাঁড়ায়।


আর সে থেকেই এ দ্বিতীয় অর্থ প্রকাশ করেই 'হলুদ সাংবাদিকতা' শব্দগুচ্ছ পৃথিবীব্যপী ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তবে এর উদ্ভবস্থল নিউইয়র্ক-ই হোক আর এটি সারা বিশ্বভ্রমরণ-ই করুক, হলুদ সাংবাদিকতার বিস্তৃত ব্যবহার আমাদের সোনার বাংলাদেশর মতো করে আর কোথাও হয়েছে কিনা সন্দিহান। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যত 'খবরে'র খবর পাওয়া যায়, তার বেশিরভাগ-ই হলুদ সাংবাদিকতার বৈশিষ্ট্য বেশ ভালোভাবেই পূর্ণ করে। চটকদার, বিচ্ছিন্ন শিরোনাম; ব্যক্তিগত জীবনের ঘনিষ্ঠ ঘটনার- যার সঙ্গে পাঠকসাধারণের কোনো সম্পর্ক নেই-বীভৎস অনাবৃতকরণ; জনসাধারণের রুচিকে সুচিন্তিতভাবে অধঃপতিত করার উদ্দেশে অশ্লীল ভাষা ও অশ্লীল ইঙ্গিতপূর্ণ ভাষার ব্যবহার হরহামেশাই দেশীয় সংবাদমাধ্যমগুলোতে চোখে পড়ে।

কয়েক বছর আগেও এই হলুদ সাংবাদিকতার বিচরণ অনলাইন ভূঁইফোড় সংবাদ মাধ্যমগুলোতেই বেশি লক্ষ্য করা যেত। এ কারণে অনেক জনসাধারণ-ই অনলাইনে পাওয়া কোনো সংবাদ সহজে বিশ্বাস করতেন না; বরং নিশ্চয়তার জন্য দেশের কতিপয় দৈনিক সংবাদপত্র ও বিশ্বাসযোগ্য কিছু টেলিভিশন চ্যানেলের উপরে নির্ভর করতেন। তবে বর্তমানে এ হলুদ সাংবাদিকতা এতটাই দাপিয়ে বেড়াচ্ছে যে কোন সংবাদটা যে হলুদ না, তা-ই বরং যাচাই করে নিতে হয়। সংবাদটা হলুদ না হলেও পাঠককে বিভ্রান্ত করে আকৃষ্ট করার জন্য শিরোনামটা অন্তত হলুদ হয়েই থাকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। আর এর প্রধানতম কারণ হতে পারে বর্তমান সময়ে পত্রিকাগুলোর ক্লিক-বেইজড ব্যবসায়ীক প্রবণতা। পাঠক একটা উদ্ভট শিরোনাম দেখে লিঙ্কে ক্লিক করবে, এতে ওই নির্দিষ্ট পত্রিকার ওয়েবসাইটের ভিউ বৃদ্ধি পাবে এবং সে ভিউ থেকে আয় বৃদ্ধি হবে- এই এক ট্রেন্ডই যেন শেষ করে দিল গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতার গৌরবান্বিত মহিমা।

সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয়টা হলো, এ ধরণের নিম্নমানের কৌশলের ব্যবহার আজ আর শুধু ভূঁইফোড় সংবাদমাধ্যমের মধ্যে আবদ্ধ নেই। এ দেশের ভরসাযোগ্য অনেক টেলিভিশন চ্যানেল ও প্রতিষ্ঠিত পত্রিকাও চোখ বুঁজে এ পথেই চলছে। ভিউ পাওয়ার জন্য এরা বিচ্ছিন্ন শিরোনামের ব্যবহার থেকে শুরু করে তথাকথিত টিকটকারদের সাক্ষাৎকার, তাদের ব্যক্তিগত জীবনের নিয়মিত খবরাখবর উপস্থাপন, ছোটপর্দা-বড়পর্দার অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিষ্প্রয়োজনীয় তথ্যাদির হালনাগাদীকরণসহ বিভিন্ন দৃষ্টিকটু কৌশল অবলম্বন করেই চলেছেন। আর এমন সংবাদের নিয়মিত উপস্থাপনে এটা স্পষ্ট যে, এই কাজের সাথে কোনো নির্দিষ্ট পত্র-পত্রিকার এক-দুইজন না, বরং ছোট থেকে বড় সব কর্মকর্তাই বেশ ভালোভাবে অবহিত এবং তারা সজ্ঞানেই এ কাজগুলো করে চলেছেন।

আমার মনে শুধু একটাই প্রশ্ন জাগে- এরা কি নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল না? এদের একটু অনুশোচনা হয় না নিজেদের দায়িত্বে এভাবে ফাঁকতাল দিয়ে উদ্দেশ্য হাসিল করে নেয়ার জন্য? আগে মানুষ পুলিশকে গালি দিত, এখন মানুষ সমান হারে সাংবাদিকদেরও গালি দেয়। অথচ আজন্মকাল এ পেশাকে একটি সম্মানীয় পেশা হিসেবে জেনেই বড় হয়েছি। কিন্তু সম্মান ধরে রাখতে না পারলে কে দেবে তাকে সম্মান?

তথ্যসূত্র- বুদ্ধিজীবীর নোটবই//সুধীর চক্রবর্তী

ছবি- ইন্টারনেট
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জুন, ২০২৪ রাত ১০:২০
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শোকের উচ্চারণ।

লিখেছেন মনিরা সুলতানা, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ সকাল ১০:১৬

নিত্যদিনের জেগে উঠা ঢাকা - সমস্তরাত ভারী যানবাহন টানা কিছুটা ক্লান্ত রাজপথ, ফজরের আজান, বসবাস অযোগ্য শহরের তকমা পাওয়া প্রতিদিনের ভোর। এই শ্রাবণেও ময়লা ভেপে উঠা দুর্গন্ধ নিয়ে জেগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

যা হচ্ছে বা হলো তা কি উপকারে লাগলো?

লিখেছেন রানার ব্লগ, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ দুপুর ১:২৮

৫ হাজার মৃত্যু গুজব ছড়াচ্ছে কারা?

মানুষ মারা গিয়েছে বলা ভুল হবে হত্যা করা হয়েছে। করলো কারা? দেশে এখন দুই পক্ষ! একে অপর কে দোষ দিচ্ছে! কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

আন্দোলনের নামে উগ্রতা কাম্য নয় | সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যবাদকে না বলুন

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ বিকাল ৫:২৭



প্রথমেই বলে নেয়া প্রয়োজন "বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার সমস্ত অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে" ধীরে ধীরে দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসছে। ছাত্রদের কোটা আন্দোলনের উপর ভর করে বা ছাত্রদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

কোন প্রশ্নের কি উত্তর? আপনাদের মতামত।

লিখেছেন নয়া পাঠক, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৬

এখানে মাত্র ৫টি প্রশ্ন রয়েছে আপনাদের নিকট। আপনারা মানে যত মুক্তিযোদ্ধা বা অতিজ্ঞানী, অতিবুদ্ধিমান ব্লগার রয়েছেন এই ব্লগে প্রশ্নটা তাদের নিকট-ই, যদি তারা এর উত্তর না দিতে পারেন, তবে সাধারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

চাকুরী সৃষ্টির ব্যাপারে আমাদের সরকার-প্রধানরা শুরু থেকেই অজ্ঞ ছিলেন

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ রাত ৯:০৭



আমার বাবা চাষী ছিলেন; তখন(১৯৫৭-১৯৬৪ সাল ) চাষ করা খুবই কষ্টকর পেশা ছিলো; আমাদের এলাকাটি চট্টগ্রাম অন্চলের মাঝে মোটামুটি একটু নীচু এলাকা, বর্ষায় পানি জমে থাকতো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×