somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নিশ্চুপতা

২১ শে আগস্ট, ২০২০ রাত ৯:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



বাজার করতে গিয়ে এই ভরা শ্রাবণের বন‍্যায় গুলি গুলি বেগুন ছাড়া আর কিছুই পেল না শ‍্যামল। একে তো করোনার লকডাউন, তার ওপর বৃষ্টি। "ওদিকে উত্তুরে নাকি বন‍্যে হচ্ছে। সব পঁচে গেছে। কাচা বাজারে এখন আগুন।"__বিড়বিড় করে সে।

ভেবেছিল আগে-ভাগেই কিছু কিনে নেবে।
কিন্তু বৃষ্টিতেই রিক্সার কদর বাড়ে কিনা, ভাড়া কিছু বেশিই পেল। সময় মতো আর বাজার করার সময়টা ঠিক হয়ে উঠল না।
এক মনে ভাবল একটা মুরগি নেয়। দাম শুনে স্ফুট স্বরে বলে ___"একটা টাচ ফোন কিনতি হবে। এখন অ‍্যাঁতো খরচ কললে হবি নে। কমলের কী যেন ক্লাসে নাগবে।" চট্ করে আজকাল আর অনেক কিছুই সে মনে করতে পারে না। বয়স হলে নাকি সব আস্তে আস্তে কমতে থাকে।

মরচে ধরা তালাটা খুলতে খুলতে ভাবলো, "আজ তাইলে অ‍্যাখনো কেউ আসেনি!"
তারপর কল পাড়ে হাত-মুখ ধুয়ে, উনুনে আলু-বেগুন সেদ্ধ করে সে গিলতে বসলো। খেয়ে আবার রিক্সাটা নিয়ে বেরুবে।

ভাতে তরকারি মাখিয়ে প্রথম নোলা মুখে দিয়েই বিকূট স্বাদে মুখটা বিকৃত হল ওর। "কী তেঁতো! "ওয়াক্...থুহ্...!"___ ফেলে দিল মুখের সবটা। সারাদিনের কাজের শেষে ক্ষিধেতে পেটে চোঁ চোঁ করছে। এমনিতেই মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে আছে। তার ওপর এই স্বাদ! সব লাত্থি দিয়ে ফেলে দিতে ইচ্ছে হল।

সেই রাগে থালার ভাত-তরকারিটুকু ফেলে দিতে উদ্ধত হয়েও ফেলে দেয়া হল না। এই স্বাদ, এই অবস্থা... ওর কেমন যেন চেনা চেনা লাগে।

কেউ একজন যেন বলেছিল, "অন সিজনের গুলি বেগুন তিতা হয়।" কে কে...হাতড়ে ভাবতে ভাবতে স্মৃতির ধুলো জমা বছর বিশ-পঁচিশেক আগের দিনের একটা ছবি ভেসে আসে চোখের সামনে।

ভাঙাচোরা ধুলে ভরা এক কুঁড়ে ঘরের দুপুর বেলা। তিনটে হাড় জিরজিরে প্রাণি আহারে উদ্ধত। চামড়া পুড়ে তামাটে রঙ নিয়েছে বুড়ো প্রাণিটার। সেদিনও আলু-বেগুনের সিদ্ধ ঘাটি আর ভাত ছিল থালায়।

মুখে এক নোলা দিয়েই "ওয়াক থু" করে ফেলে দিল ছোকরা গোছের ছেলেটা।

"কী রান্দি ছো, অ‍্যাঁ?"___ অদূরে বসা তল্লা বাঁশের মতো শ্রীহীন স্ত্রীলোকটিকে উদ্দেশ্য করে দাঁতে দাঁত চেপে বলল সে। "তেঁতো...গেলা যায় না!"__নটখট স্বাদে মুখ বাঁকিয়ে আছে সে।
স্ত্রীলোকটি পাশের বুড়ো প্রাণিটির দিকে চাইল। "কী গো! তেঁতো লাগছে?__রাজ‍্যের জিজ্ঞাসা যেন চোখে মুখে। "তুমি তো খাচ্ছো দিব‍্যি!"__ সান্ত্বনা পেতে চাইছে যেন।

বুড়োর খাওয়া দেখে স্বাদের গুরুতর হেরফের হয়েছে কিনা_ বোঝার উপায় নেই। মুখ তুলে নির্বিকার ভাবে বললে, "কই না তো? তেঁতো নাগছে না তো!" যেন খুব স্বাদ হয়েছে তেমনি "...উমম..." শব্দ করে মুখের অবশিষ্টটুকু গিলে পূর্ব কথার জের ধরে বললে,
"তোর পাতে কিছু পড়িছ্ কিনা দ‍্যাখ! ভালোই তো নাগছে।"

"হ‍্যাঁয়...ওটুক ফেলে দে আরেকটু নে।"___তড়িঘড়ি করে স্ত্রীলোকটি। "তোর বাবা তো দিব‍্যি খাচ্ছে!"

ছেলেটি আরেকটু ঘন্ট নিয়ে মুখে দিয়েই ফেলে দিল। "তোমার মুখি কোনো স্বাদ নেই। খাও গে তুমি!"__বাপকে উদ্দেশ‍্য করে বলে উষ্মা ভরে থালা ঠেলে দিয়ে উঠে গেল।

"হ বাজান। বুড়ো হলি মনে হয় সব স্বাদ কমি যায়!"__বুড়ো নিজের খাওয়ায় মন দেয়।

তারপর অনেকটা সময় চলে গেছে। আনমনে ছোট্ট একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়ে...
আচমকা কী যেন মনে হতেই শ‍্যামল আঙুল গোণা শুরু করে। আর কী সব হিসাব নিকাশ করে বিড়বিড় বিড়বিড় করে।

"বাজানের বয়স... আমার বয়স... কমলের বয়স হিসেব কল্লে...।"
শ‍্যামলের হিসেব মেলে না। বয়স বাড়লে কেমনে মানুষের স্বাদ কমে! তার তো এখন তেঁতোই লাগল!

"বাজান কি তালি মিছা কতা কইছিল...
নাকি সইত‍্য চাপা পইড়া যায়? বয়সের ভারে..."
ভাবতে ভাবতে বুড়ো বাপের সেদিনের সেই মুখ নিচু করে একমনে খেয়ে যাওয়া আর নিজ ছেলের ছবি ভেসে ওঠে শ‍্যামলের ছলছল দু'চোখে।
কেমন যেন অসম্ভব ভারী কী একটা কিছু চারপাশটা তখন নিশ্চুপতার চাদরে মুড়ে দিয়ে গেছে!
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে আগস্ট, ২০২০ রাত ৯:৫৭
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×