somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দেশে 'সন্ত্রাস' বিরোধী অভিযান ও চলমান 'ক্রসফায়ার' প্রসঙ্গ- (চতুর্থ অংশ)

২৫ শে জানুয়ারি, ২০১০ রাত ১১:০৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

তারা কি প্রতিষ্ঠা করতে চায়?

এবার আমরা কৃষি বিপ্লব বলতে আলোচিত কমিউনিস্ট পার্টিগুলো ঠিক কোন ধরনের সম্পত্তি-সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা বা সমাজ বির্নিমানের কথা বলে থাকে, তার উপরে সংক্ষিপ্ত পরিসরে কিছু আলাপচারিতা সেরে নিতে পারি। তবে তাদের প্রসঙ্গে যাওয়ার পূর্বে আমাদের কৃষি নিয়ে যে সব তথ্য- উৎপত্তি চালু রয়েছে তার প্রতিও অল্প বিস্তর দৃষ্টিপাত করা দরকার, চলমান আলোচনার স্বার্থ থেকে।

আমাদের দেশের অসংখ্য অর্থনীতিবীদ ও সমাজ গবেষকদের মতে, বাংলাদেশ ভৌগোলিক আয়তনের বিচারে পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ একটি দেশ। এখানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করেন ৯২০ জন মানুষ। আজো দেশের তিন-চতুর্থাংশ মানুষেরই বাস গ্রামে। সেই বিবেচনায় জনগণের প্রধান অংশের আয়ের উৎস আজো ভূমি।

২০০৫ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী দেশের মোট জনসংখ্যার মধ্যে ৬ কোটি ৫০ লাখ দরিদ্র। যাদের প্রধানাংশের বাস আবার গ্রামে। এই গ্রামীণ জনসংখ্যার মধ্যে ৫৫ শতাংশ হচ্ছেন ভূমিহীন বা অর্থনৈতিক বিবেচনায় ভূমিহীন। এর সঙ্গে রয়েছে আরো ৩১ শতাংশ প্রান্তিক চাষী। সব মিলিয়ে গ্রামীণ জনগোষ্ঠির ৮৬ শতাংশ হচ্ছেন দরিদ্র। গ্রামীণ অর্থনীতিতে এই ৮৬ শতাংশ মানুষই প্রত্যক্ষ ও প্রধানভাবে গা গতরে কৃষি উৎপাদনের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। অথচ কর্মসংস্থানের উৎস হিসেবে উৎপাদনের উপায় ওই ভূমি মালিকানার উপরে তাদের কোনো দখলিস্বত্ব নেই। উৎপাদনের কোনো উপায়ও তাদের হাতে নেই। অথচ দেশের ৪৫ শতাংশ জমির মালিকানা রয়েছে এমন ৬ শতাংশ মানুষের হাতে, যাদের সঙ্গে কৃষির কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা নেই, শুধুমাত্র কৃষি থেকে উদ্বৃত্ত লুঠ করা ছাড়া। কৃষি ব্যবস্থাপনায় যাদেরকে বলা হয়ে থাকে অনুৎপাদক শ্রেণী। দেশের মোট সরকারি খাস জমি রয়েছে ১ কোটি বিঘা। তার মধ্যে ৯০ শতাংশ জমি আবার ওই অনুৎপাদক গোষ্ঠিরই ভোগ দখলে।

পাশাপাশি আমাদের দেশে মোট মামলার ৭৬ শতাংশ বা ২৫ লাখ মামলাই হলো ভূমি সংক্রান্ত। এবং এই ভূমি সংক্রান্ত মামলায় বাদী-বিবাদী উভয়ে প্রতি বছর ব্যয় করে থাকেন ২৪ হাজার কোটি টাকা। পরিমাণ হিসেবে টাকার এই অংকটা হলো আমাদের দেশের প্রতি বছরের উন্নয়ন বাজেটের সমপরিমাণ। আবার ওই ২৪ হাজার কোটি টাকার মধ্যে প্রায় অর্ধেক টাকা লেনদেন হয় ঘুষ হিসেবে। যা ভূমিকর্মকর্তা, পুলিশ, আমলা, উকিল ও বিচারকদের পকেটস্থ হয় বলে সমাজ বিশ্লেষকদের দাবি।

উপরোক্ত পরিস্থিতির সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে সেই আইয়ুব খানের আমল থেকে সবুজ বিপ্লব, স্বনির্ভর কৃষি, উচ্চ ফলনশীল কৃষির গল্প শুনতে শুনতে আজ এমন একটি পর্যায়ে উপস্থিত হয়েছি যে, মোটা চালের দাম ৩৫ টাকাতে ঠেকেছে। উন্নয়ন জগতের দিকপালরাই বলছেন আমাদের কৃষি ও তার ব্যবস্থাপনা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। চালের বদলে আলু খাওয়ার পারামর্শ দেওয়া হচ্ছে। আন্তর্জাতিক পরামর্শদাতারা বলছেন খাদ্য সংকট আজ বিশ্বব্যাপী। পৃথিবীর অনেক দেশে খাদ্য নিয়ে দাঙ্গা হচ্ছে। সেটা নাকি আগামীতে আরো বেড়ে যাবে। খাদ্য সংকটে অসংখ্য মানুষ মারা যাবে। আমাদের দেশে ইতিমধ্যে খাদ্য ও অর্থনৈতিক সংকটের কারণে শিশুদের কেনাবেচা শুরু হয়ে গেছে। ক্ষুধার কারণে বাবা তার ঔরসজাত শিশুকেও খুন করছে । মূলত এটাই হলো তথাকথিত সবুজ বিপ্লব বা উচ্চ ফলনশীল কৃষির ফলাফল।

এর সঙ্গে আরো তথ্য রয়েছে। আমাদের দেশে প্রাপ্ত শ্রম সময়ের মধ্যে ৪০ শতাংশেরই বেকারের সংবাদ। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারের উঠতি যুবকদের বেকারত্বের সংবাদ। রয়েছে শিল্প কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার সংবাদ। সমাজ বিশ্লেষকরা বলছেন উন্নয়নে স্থবিরতা চলছে। কেউ বলছেন মানুষের ক্রয়ক্ষমতা স্বল্পতার কথা। বাজার দর্শনওয়ালারা বলছেন বাজারের আরো স্বাধীনতা বাড়াবার কথা। অর্থাৎ ’৭১ পরবর্তী বাংলাদেশে বাজার দর্শন গ্রহণ করার ফলাফল হিসেবে আজ যেখানে এসে ঠেকেছি, তাতেও অনেকে সন্তুষ্ট নন। আবার অনেকে বলছেন-বাজার নয়, বরং আমরা যদি রেশনখোর জাতি হয়ে উঠতে পারি একমাত্র তাহলেই সমস্যা থেকে উত্তরণ ঘটানো যাবে ইত্যাদি। আসলে প্রশ্ন হিসেবে আলোচিত বিষয়বস্তু ঘুরে ফিরে প্রায়ই আমাদের জীবন যাপনের মধ্যে মাঝে মধ্যে এসে পড়ছে। তবে পাঠকদের স্মরণ রাখা দরকার উপরে উল্লিখিত বিষয়বস্তু নিয়েই বা কৃষি প্রসঙ্গ নিয়ে আমাদের দেশে রাজনৈতিক বিভাজন ঘটেগিয়েছিল সেই ৬০ দশকে। সেই আলোকেই বা বাজার দর্শনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই আমাদের শাসক রাজনৈতিক দলগুলো দেশ পরিচালনা করছে। এর বিপরীতে যারা আজ রাজনৈতিকভাবে ক্রসফায়ার হত্যাকাণ্ডের শিকার, তারা বলছেন কৃষি বিপ্লবের কথা। এই মৌলিক বিষয়টি আলোচনার শুরুতেই আমাদের স্পষ্ট থাকা দরকার।

মূলত আমাদের দেশের কৃষি ও তার ব্যবস্থাপনার বেহাল দশা অনেকদিন থেকেই। ওই দশা যখন প্রকট হয়ে ওঠে, সমাজের মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তকে যখন স্পর্শ করে, তখন দেশজুড়ে হৈ চৈ শুরু হয়ে যায়। এবং নানান পদের পরামর্শ সভা ঘটতে দেখি আমরা। যা এখন হরহামেশাই হচ্ছে। অথচ আমাদের অনেক সমাজ গবেষকই দীর্ঘদিন থেকেই বলে আসছেন, দেশের ৭০ শতাংশ মানুষ আজো কৃষির উপরে নির্ভরশীল। এই মানুষগুলোকে যদি বাচাঁতে হয়, তাহলে, কৃষির উন্নতি প্রয়োজন। এবং উন্নতির প্রশ্নে তারা প্রচলিত মালিকানা ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রীয় আইন-কানুনকেই বাধা হিসেবে দেখেছেন। তাদেরও ভাষ্য মতে জমির প্রধানাংশের মালিকানা সমাজের এমন শ্রেণীর হাতে কেন্দ্রভূত হয়ে রয়েছে, যারা কশ্চিনকালেও জমি চাষ করে না। জমির উন্নতিতে পুঁজি বিনিয়োগ করে না। ফলে সমাজের প্রধানাংশে মানুষকে যদি বাচাঁতে হয়, রক্ষা করতে হয়, তাহলে দেশের প্রচলিত ভূমি আইন এবং ভূমি আইনের সংস্কারই যথেষ্ট নয়। তারা প্রতীকী অর্থে হলেও ভূমি মালিকানার সংস্কারের উপরে গুরুত্বারোপ করে আসছেন। এবং প্রতীকী অর্থে সংস্কার বলতে তারা প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে সরকারি ১ কোটি বিঘা খাস জমি ভূমিহীনদের মধ্যে বিতরণের উপরে জোর দিয়েছেন। পরবর্তীতে পরিবার প্রতি কৃষি জমির সিলিং নির্ধারণ। তার সঙ্গে ফলনশীল ফসলের চাষাবাদ। আমাদের স্মরণ রাখা দরকার এই ধারার সমাজ গবেষকরা কিন্তু কেউই কৃষি বিপ্লবের দাবি তোলনি। তার প্রচলিত মালিকানা কাঠামো ও আইনকানুনের মধ্যেই ফয়সালা চেয়েছেন। যেমনটি ঘটেছিল তাইওয়ান ও দক্ষিণ কোরিয়াতে। যে বিশ্ব ব্যাংককে আমরা আজ পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের উপর খবরদারী করতে দেখি। এবং যে রাষ্ট্রকে বর্তমান জামানায় পৃথিবীর অধিকাংশ জনগণ সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করে থাকেন। সেই আমেরিকা ও বিশ্বব্যাংকের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় তাইওয়ান ও দক্ষিণ কোরিয়াতে সিলিং নির্ভর ভূমিসংস্কার ঘটেছিল। আমাদের শাসক রাজনৈতিক দলগুলো এধরনের একটা পদক্ষেপও নিতে পারত। কিন্তু তারা সেটাও করেননি। করতে পারলে কৃষি থেকে উদ্বৃত্ত জনসংখ্যাকে শিল্পে স্থানান্তর করতে পারতেন তারা। তাতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ত। আভ্যন্তরিণ বাজারের আরো স¤প্রসারণ ঘটত। আমাদের শাসক রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আমেরিকান সরকারগুলোর হরহামেশাই আমরা বৈঠক করতে দেখি। বিশ্বব্যাংক, আই এম এফ ও এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে গভীর সখ্যতাও দেখি। তাদের ম্যানেজ করে এধরনের কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে আমরা আমাদের সরকারগুলোকে দেখিনি।

আর ম্যানেজ করার প্রশ্নটা আসছে প্রধানভাবে রাজনৈতিক কারণেই। কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়কালে চীন ও উত্তর কোরিয়ার স্বাধীনতা অর্জন ও রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার প্রভাব থেকে রক্ষা করতে তাইওয়ান ও দক্ষিণ কোরিয়াতে বিশ্বব্যাংক ও আমেরিকা সবুজ বিপ্লব নামের এক কর্মসূচির প্রয়োগ করে। যে কর্মসূচির মধ্যে সিলিং নির্ভর মালিকানা ও ইরিগ্রেশন সম্পর্কিত। ওই দুইটি দেশের যতটা উন্নয়ন ঘটেছে তার মূলেও রয়েছে ওই ভূমি মালিকানার রদবদল। সাধারণভাবে বা নীতিগতভাবে বিশ্বব্যাংক ও অ্যামেরিকা আমাদের মত রাষ্ট্রগুলোর ক্ষেত্রে ভূমি মালিকানার যে কোনো ধরনের সংস্কারের ঘোর বিরোধী। এককালীন গণপ্রজাতান্ত্রিক চীন ও উত্তর কোরিয়ার প্রভাব থেকে মুক্ত করতে তাইওয়ান ও দক্ষিণ কোরিয়াতে ওই পদক্ষেপ নেয় তারা। এবং তারা লাল বিপ্লবের বিপরীতে সবুজ বিপ্লব নামের এক তরিকাও দাঁড় করায়। ফলে চাইলেই বাংলাদেশের ক্ষেত্রে একই মডেলের সংস্কার হবে এটা সম্ভব নয়। বিশ্বব্যাংক ও আমেরিকা চায় কিনা সেটাই মূল প্রশ্ন। ফলে ম্যানেজ করার প্রশ্নটা এসেছে। কিন্তু আমাদের সরকারগুলো এবং আমলাতান্ত্রিকতাও ওই প্রকল্পের ঘোর বিরোধী। ফলে গত এবং ৩৭ বছরে যারাই এদেশের শাসন কার্য পরিচালনা করেছে, অর্থাৎ আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয়পার্টি, জামায়াত ফকরুদ্দিনের সরকার, তারা সবাই বিশ্বব্যাংক, আই এম এফ, এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংক ও বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের পরিকল্পনা অনুযায়ী আমাদের কৃষিকে স্থবির রেখে বিদেশী ঋণ সাহায্য নির্ভর শহর ভিত্তিক শিল্পায়ন গড়ে চলেছেন। এতে করে আমাদের বর্তমান আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার মধ্যে ধনিক শ্রেণীর অভিমুখিতা, বিদেশী সাহায্য নির্ভরতা এবং শহর অভিমুখিতা আজ প্রকট আকার ধারণ করেছে। একই সঙ্গে এই ৩৭ বছর ধরে সেই উন্নয়ন ঘটানো হয়েছে একদম চিহ্নিত লুটেরাগোষ্ঠির স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে। মূলত আমাদের দেশের সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্র এবং ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলোর লুটেরা মনোবৃত্তির সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদীদের পরিকল্পনা ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর বাধার কারণেই, যেসব সমাজ বিশ্লেষকরা দীর্ঘদিন থেকে রাষ্ট্রের আইনগত কাঠামোর মধ্যে প্রচলিত মালিকানা ব্যবস্থা বহাল রেখেই ন্যূনতম অর্থে হলেও একটা ভূমি সংস্কারের দাবি তুলেছিলেন, সরকারি ১ কোটি খাস জমিটুকু বিতরণের কথা বলে আসছেন, সেটাও নীতি নির্ধারকদের কাছে বর্জিত হয়েছে। নীতি নির্ধারকরা মনে করে, যে কোনো ধরনের সিলিং আরোপ বা ভূমিবন্টনের অর্থ হলো ব্যক্তি উদ্যোগের উপরে হস্তক্ষেপ। অর্থাৎ শাসক রাজনৈতিক দলগুলো এবং সামরিক বেসামরিক আমলাতন্ত্র নীতিগতভাবেই আমাদের দেশের লুটেরা অনুৎপাদক শ্রেণী এবং পরাশক্তি হিসেবে সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের সংস্থার সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদে আগ্রহী নয়। এসব রাজনৈতিক দল ও দেশের আমলাতন্ত্র সমাজের নিয়ামক শক্তি হিসেবে আজ লুটেরা অনুৎপাদক শ্রেণী ও সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে মৈত্রীর মধ্য দিয়েই আরো ক্ষমতাবান ও সম্পদশালী হয়ে উঠছে। আর এই মনোবৃত্তির কারণেই আলোচিত দল হিসেবে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয়পার্টি, জামায়াত যেমন গণতান্ত্রিক চরিত্রসম্পন্ন রাজনৈতিক দল হয়ে উঠতে পারেনি, তেমন এসব ক্ষমতাসীন দলের শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা হওয়ার কারণেই রাষ্ট্র ও সমাজের ন্যূনতম অর্থে হলেও গণতান্ত্রিক রূপান্তর সংগঠিত হয়নি। মূলত গণতান্ত্রিক সংগ্রামের মৌল কর্মসূচি হিসেবে কৃষি প্রশ্ন, প্রচলিত সম্পত্তি সম্পর্কের প্রশ্ন এবং ভোগদখলের প্রশ্নটি পাশকাটিয়ে বা উহ্য রেখে কোনো রাজনৈতিক শক্তির পক্ষে যেমন গণতান্ত্রিক হয়ে ওঠা সম্ভব নয়, তেমনি সমাজ ও রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তর সম্ভব নয়। আমাদের দেশের আমলাতন্ত্র ও রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে ক্ষমতাসীন দলগুলো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ সৃষ্ট সম্পত্তি-সম্পর্ক বহাল রেখেই দারিদ্র্য দূরীকরণ, দক্ষতা বৃদ্ধি ও প্রবৃত্তি অর্জনের কেরামতি দেখাতে দেখাতে অবশেষে কৃষি ব্যবস্থাপনাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। এবং এই মহলের সঙ্গে সম্পর্কিত ইসলামিক পণ্ডিত বা আলেম সম্প্রদায়ের একাংশ ওই ব্রিটিশ সৃষ্ট মালিকানাকেই ন্যায্যতা দিয়ে তারা আরো ইসলামীকরণ চাইছে।

আমরা আলাপচারিতার এই পর্বেই বলেছি যে, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে তারা শাসক হিসেবে আমাদের সম্পত্তি-সম্পর্ক বদলে দিয়ে সম্পদ শোষনের ক্ষেত্র হিসেবে কৃষিখাতকে গড়ে তুলেছিল। এবং সেই থেকে আমাদের কৃষি আর স্থানীয় জনগোষ্ঠির খ্যাদ্যের উৎস কিংবা জীবনধারণের উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে না। বিশ্ববাজারে অধিনস্ত এই কৃষির লক্ষ্য হলো উন্নত ধনতান্ত্রিক এবং সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলোর জন্য খাদ্যশস্য, কপি, চা, মাছ-মাংস, ফলমূল, তরিতরকারিসহ আরো হাজারো পদের কৃষি পণ্যের যোগান দিয়ে যাওয়া। আমাদের মত দেশগুলোর উৎপাদক কৃষকরা নিজেরা অভুক্ত থেকে, সন্তানদের অভুক্ত রেখে, জীবন ধারণের সমস্ত মৌলিক চাহিদা থেকে নিজেদের বঞ্চিত করে সেই কর্মটি করে চলতে বাধ্য হচ্ছে। সরকারি পরিভাষায় এর নামকরণ করা হয়েছে উন্নয়নশীল কৃষি। যা আমাদের বিদেশী মুদ্রা অর্জনের অন্যতম খাত হিসেবেও বিবেচিত। সরকারি এই পরিভাষা যদি আমরা উল্টে দেই, তাহলে তার অর্থ দাঁড়াবে এমন--আমাদের দেশের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা--কর্মী, সামরিক-বেসামরিক আমলা, পুঁজিপতি শ্রেণী, নগরকেন্দ্রিক ফটক বাজ ও চোরাকারবারীদের ক্ষমতা সংহত ও ভোগ বিলাসীতার জন্য বিদেশী উন্নতমানের অবৈধ অস্ত্র আমদানি, সন্তানদের বিদেশে শিক্ষাগ্রহণ, বিদেশে আবাসিক স্থল ক্রয়, তাদের প্রমদ ভ্রমণ, বিদেশে চিকিৎসা ক্রয়, ডলার পাচার, চোরাকারবারীসহ আরো হাজার পদের যে কায়কারবার এবং তার প্রয়োজনে যে বিদেশী মুদ্রার দরকার পড়ে, সেই বিদেশী মুদ্রা অর্জনের লক্ষ্য চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে উৎপাদক কৃষকের ঘাড়ে। এবং সেটাকেই বলা হচ্ছে উন্নয়নশীল কৃষি।

একই সঙ্গে এদেশের আমলাতন্ত্র ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলো কৃষিকে স্থবির রেখে বৈদেশিক সাহায্য নির্ভর শিল্পকারখানা গড়তে দিয়ে আরো নানা রকমের সংকট তৈরি করেছে। যেমন গত ৩৪ বছরে বাংলাদেশে বৈদেশিক ঋণ ও সাহায্য পেয়েছে প্রায় ২ লাখ কোটি টাকা। যার শতকরা ৭৫ ভাগই নানান প্রক্রিয়াতে লুঠ করেছে আলোচিত গোষ্ঠিগুলো। টাকার অংকে ওই লুঠ হওয়া টাকার পরিমাণ হলো ১ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা। এই অবৈধ টাকাঅলারাই আজ আমাদের দেশ-রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে কর্তৃত্বকারী শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এবং ওই বিদেশী ঋণ নির্ভরতার কারণে বাংলাদেশের জনগণ আজ মাথা পিছু ১২ হাজার টাকা করে প্রত্যেকেই বিদেশীদের কাছে ঋণি। আবার ওই ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থা করা হয়েছে পরোক্ষ করারোপ করে। অর্থাৎ প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের উপরে অধিক হারে কর ও ভ্যাট বসিয়ে। দেশের রাষ্ট্র প্রধান, অর্থমন্ত্রীসহ এদেশের সমস্ত পদের বড় লোক ধরা না পড়লে যে কর দেন না তা আজ আমরা হরহামেশাই দেখছি। তাদের পাপের বোঝা পরোক্ষ করের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের ঘাড়ে চাপানো হয়েছে।

অন্যদিকে বিশ্বব্যাংক, আই এম এফ, এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকসহ সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র নির্ভর প্রকল্পভিত্তিক ঋণ সাহায্য ও শিল্পায়ন ঘটানোর কারিশমা আজ আমাদের সামনে আরো খোলামেলা হয়ে পড়েছে। মূলত ওই সব সংস্থা বা রাষ্ট্রের কাছ থেকে ঋণ-সাহায্য গ্রহণ করতে গিয়ে তাদের শর্ত অনুযায়ী আমাদের কর্তাব্যক্তিরা রাষ্ট্র হিসেবে এদেশের নীতি নির্ধারণী ক্ষমতা তাদের হাতেই সম্পূণরূপে সপে দিয়েছে। ফলে ’৭১ পরবর্তী বাংলাদেশ জাতিসংঘ স্বীকৃত একটি দেশ হলেও এদেশের বিডিআর-এর নওজোয়ানদের সঙ্গে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষিদের প্রায় প্রতিদিন সীমান্ত সংঘর্ষ হলেও, রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব বলতে যা বোঝায় সেটা আজ আর বাংলাদেশের নেই। রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রশ্নে, আমাদের জাতীয় প্রশ্নে ওই সব সংস্থা ও রাষ্ট্রের সাধারণ কর্মচারীরা যেভাবে ওয়াজ- নসিহত করে চলেছে তাতে সেটাই প্রমাণিত হয়। তাছাড়া মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর নায়কদের, তাদের সন্তানদের, তাদের বৌ-ঝিদের ধরে ধরে যেভাবে উঙ্গল কায়দায় শায়েস্তা করা হচ্ছে, তাতে এ রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নটি আদতেই কোনোকালে ছিলো কিনা সেটাও আজ জরুরি প্রশ্ন। বিদেশী রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বিভিন্ন চুক্তির শর্ত ধরে ও পরিকল্পনামাফিক আরো জাঁকিয়ে বসছে। তারা আরো সুযোগ সুবিধা চাচ্ছে আর ক্ষমতাসীন দলগুলোর গ্রেফতার এড়াতে সক্ষম অবশিষ্ট নেতা-নেত্রীর তাদের সঙ্গে ফটোসেশন করে চলছে। মূলত এটাই হচ্ছে আজকের বাংলাদেশের বাস্তবতা। এবং আমাদের জন্য প্রশ্ন হলো দেশ ও রাষ্ট্রের এই পরিণতির জন্য কারা প্রকৃত অর্থে দায়ী তাদেরকে চিহ্নিত করা।

আমরা কমবেশি যে, ৬০- এর দশকের শেষ লগ্নে এসে যখন আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল, পূর্ববাংলার স্বায়ত্ত্বশাসনের আন্দোলন শেষ নাগাদ স্বাধীনতার আন্দোলনে গড়াবে, তারই প্রতিক্রিয়াতে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব, গণতান্ত্রিক বিপ্লব প্রশ্নে, কৃষি প্রশ্নে আমাদের নীতি নির্ধারক, রাজনীতি ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব¡রা দল হিসেবে আলাদা হয়ে যান। এর মধ্যে যে সব রাজনৈতিক দল গণতন্ত্র বলতে শুধুমাত্র পাঁচ বছর অন্তর অন্তর সংসদ নির্বাচন বোঝে এবং সেটাকেই মূল ধারার রাজনীতি হিসেবে দাবি করে থাকে, তার একটা খুবই সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা সারলাম আমরা। এবার আমরা আলোচিত কমিউনিস্ট পার্টির কৃষি বিপ্লবের পর্যালোচনার একটা সংক্ষিপ্ত সার তুলে ধরার চেষ্টা করবো।

আমাদের দেশে যে সব কমিউনিস্ট পার্টি আজ নিজেদেরকে মাওবাদী হিসেবে দাবি করছেন; যাদের নেতা-কর্মীরা আজ প্রধানভাবে ক্রসফায়ারের শিকার। ওইসব রাজনৈতিক দল এক সময় নকশাল নামে পরিচিত ছিলো। এবং আমরা সবাই কমবেশি এটাও জানি যে, ভারতের নকশালবাড়ির নাম অনুসারে ওই নামকরণটি ঘটে সেদিন।

মূলত আমাদের উপমহাদেশের রাজনীতিতে নকশালবাড়ির তরাই অঞ্চলের কৃষকরা যে সশস্ত্র কৃষি সংগ্রাম শুরু করেন সেটাকেই অনেক সমাজ বিশ্লেষক ‘কৃষি বিপ্লবের’ সূত্রপাত হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। উপমহাদেশ জুড়ে তার প্রভাব ছিলো আলোড়ন সৃষ্টিকারী ও যুগান্তকারী। কারণ তাকে কেন্দ্র করেই উপমহাদেশের রাজনীতি ও সংস্কৃতি বিভক্ত হয়ে পড়ে। বিভক্ত হয়ে যায় কমিউনিস্ট পার্টির আন্দোলনও। তার মধ্যে যারা তরাইয়ের পথ গ্রহণ করেন তারাই নকশাল নামে চিহ্নিত। বিশেষত ভারত ও বাংলাদেশ। আর নেপালে সেটা স্থানিকভাষায় নামকরণ হয় ঝাপা আন্দোলন। এই ঝাপা আন্দোলনের উত্তরাধীকারীরাই আজ নেপালের মাওবাদী পার্টি হিসেবে পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত এবং এখন তারা ক্ষমতাসীনও।

আজ আমাদের দেশ একটা সংকটময় পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। যার মধ্যে খাদ্যসংকট অন্যতম। আমরা পকেট ভর্তি পয়সা নিয়ে বাজারে গেলে চাল পাচ্ছি না, বিষয়টি এমন নয়। অর্থাৎ চাল বাজারে রয়েছে কিন্তু সেটা সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। ফলে সাধারণ মানুষ যা আয় করেন তার প্রধানাংশ ব্যয় হয়ে যাচ্ছে চাল কিনতেই। এর অন্যতম কারণ হলো চাল ব্যবসায়ীদের একটা শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। এই সিন্ডিকেটকে আবার নীতিগতভাবেই সহযোগিতা দিয়ে চলেছে নীতি নির্ধারকদের সিন্ডিকেট। দেশের কর্তৃত্বশালীরা, ক্ষমতাশালীরা, রাজনীতিবীদরা এসব সিন্ডিকেট বজায় রেখেই বিদেশ থেকে চাল আমদানি করার নীতি গ্রহণ করেছেন। ফলে আমাদের অর্জিত বিদেশী মুদ্রার একটি অংশ চাল কেনা বাবদ বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। ঠিক একই ধরনের পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছিল ভারত। ১৯৬৪ সালের খাদ্য সংকট ভারতের পশ্চিমবঙ্গসহ অনেক রাজ্যকে গ্রাস করে সেদিন। কৃষকরা খাদ্য নিয়ে দাঙ্গা করেন। অনেকে জীবন দেন। এবং ওই পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসতে তরাই-এর কৃষক আন্দোলন একটা পথ বাতলায়। সেটাই নকশালবাড়ির পথ নামে খ্যাত। তরাই-এর কৃষকরা সেদিন একটা মৌলিক দাবি সামনে এনে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করেছিলেন। শ্লোগানাকারে স্থানিকভাষায় তারা দাবি করেন ‘পহেলা সব খেত রাষ্ট্রকে হাত মে হয়েক পড়ি’। তাদের দশ দফা কর্মসূচির মধ্যে এটাই ছিলো অন্যতম বা প্রধান দাবি। যাকে সমাজ বিশ্লেষকরা কৃষি বিপ্লবে সূচনা আকারে দেখে থাকেন। একই সঙ্গে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের সঙ্গে বিষয়টি সংশ্লিষ্ট বলে মনে করেন।

মূলত এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো, ''পহেলা সব খেত রাষ্ট্রকে হাত মে হয়েক পড়ি'' এই শ্লোগানের মধ্য দিয়ে তরাই-এর কৃষকরা জমি জাতীয়করণ করে তাকে জাতীয় সম্পদে পরিণত করার কথা বলেছিলেন। অথচ আমাদের দেশের নীতিহীন ও নামধারী কমিউনিস্টরা তরাই এর রাজনীতির নামকরন করেছেন, চারু মজুমদারের ব্যক্তি হত্যা, সন্ত্রাস ও গলাকাটার রাজনীতি নামে। এখন আমরা খুবই সংক্ষেপে পর্যালোচনা সেরে নিতে পারি জমি জাতীয়করণ করে জাতীয় সম্পদে পরিণত করতে পারলে মোটা দাগে সমাজের সবাই ঠিক কোন ধরনের ফলাফল ভোগ করতে পারবেন।

এই দাবি যদি বাস্তবায়িত হয়, তাহলে প্রচলিত সম্পত্তি সম্পর্ক ঘিরে যে ব্যক্তি মালিকানা ভিত্তিক কর্তাস্বত্ত্ব গড়ে উঠেছে, প্রথমেই তার উচ্ছেদ ঘটে যাবে। অর্থাৎ এ পর্বের আলোচনায় যে কথাটি পরিষ্কার করার চেষ্টা করা হয়েছে যে, বর্তমানেও সাম্রাজ্যবাদী দেশ ও নিপীড়িত জাতিসমূহের মধ্যকার সম্পর্কের কাঠামো স্রেফ বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অংশ মাত্র নয়। বরং সাম্রাজ্যবাদ আজো নির্ধারক অংশ। একই সঙ্গে আজো নিপীড়িত জাতিগুলোর অভ্যন্তরীণ শ্রেণী ও সামাজিক সম্পর্কসমূহ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদ হচ্ছে প্রধান শক্তি। নিপীড়িত সমস্ত জাতির মধ্যে গড়ে ওঠা প্রতিক্রিয়াশীল শ্রেণীসমূহ অর্থাৎ ভূস্বামী, মুৎসুদ্দি ও আমলা, বণিক ও ব্যাংক মালিকরা সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার শ্রেণীগত মিত্র হিসেবে যে সম্পত্তি সম্পর্কের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠছে। তাদের শ্রেণীগত ক্ষমতা ধরে রাখছে। আরো সংহত করছে। ব্রিটিশরা উপমহাদেশ থেকে চলে গেলেও কাঠামোগতভাবে যে ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার আজো অবসান ঘটানো হয়নি। জমি জাতীয়করণ করে জাতীয় সম্পদে পরিণত হলে প্রথমেই এই ব্যবস্থার উচ্ছেদ ঘটতে বাধ্য। আবার ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির রোপিত আধা সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্ক থেকে যেমন উৎপাদক কৃষকরা মুক্ত হতে পারে, তেমনি ঔপনিবেশিক সম্পত্তি সম্পর্কের কারণে যে আধুনিক অনুৎপাদক মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণীর হাতে জমি কেন্দ্রিভূত হচ্ছে, হয়ে আসছে। ওই মালিকানা কর্তাস্বত্ত্বার উচ্ছেদ ঘটবে। একই সঙ্গে আমাদের ভূপ্রকৃতি যেভাবে পণ্য আকারে কেনা বেচা হচ্ছে সেই প্রক্রিয়ার উচ্ছেদ ঘটবে। মহাজনী প্রথা, এনজিওদের সুদ কারবার, প্রাকৃতিক দূর্যোগ বা শস্যহানীর কারণে উৎপাদক কৃষকের উচ্ছেদ হওয়া, গায়ের জোরে অপরের সম্পত্তি দখল ইত্যাদিসহ আরো নানাবিধ কারণে উৎপাদনের উপায় থেকে যেভাবে উৎপাদক কৃষকরা উচ্ছেদ হয়ে থাকে সেই সম্পর্কের আমূল রুপান্তর ঘটবে। একইভাবে ঔপনিবেশিক সম্পত্তি সম্পর্ক ও তার আইনগত ন্যায্যতার জোরে ভূমি মালিক অনুৎপাদক শ্রেণী হিসেবে উৎপাদক কৃষকের কাছ থেকে খাজনা আকারে যে উদ্বৃত্ত লুট করে নিয়ে থাকে সেই প্রক্রিয়ারও অবসান ঘটবে। সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদের উপরে গণমালিকানা সৃষ্টির শর্ত তৈরি করবে। ব্যাপক গণমানুষের মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পত্তি ভোগের আকাক্সক্ষার বিপরীতে যৌথ মালিকানা সৃষ্টির দায়িত্ববোধ গড়ে উঠবে।

একইসঙ্গে প্রচলিত ভূমি মালিকানার সূত্র ধরে যে লাখ লাখ মামলা চলছে। তারও অবসান ঘটবে। মামলার কারণে কৃষি উদ্বৃত্ত থেকে বছরওয়ারী যে ২৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে তারও নিরসন হবে।

আবার ব্যক্তিগত সম্পত্তির সর্বশেষ রূপ হিসেবে ব্যক্তি মালিকানা ভিত্তিক যে একগামী পারিবারিক ব্যবস্থা নারীর উপরে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোর মধ্যে সেই ব্যবস্থা উচ্ছেদের সম্ভাবনা তৈরি হবে। এই ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে সন্তানের যে উত্তারধীকার প্রথা গড়ে উঠেছে, উত্তরাধীকার প্রথার সঙ্গে নারীর সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র হয়ে থাকার দশা থেকে মুক্ত হওয়ার শর্ত সৃষ্টি করে। সন্তানের বৈধ-অবৈধকরণ ভেদনীতি উচ্ছেদ হয়ে যাবে। পরিবার ভিত্তিক যে লিঙ্গ বিভাজন ও ধর্মীয় শিক্ষা দান সেটা থেকে মুক্তির শর্ত সৃষ্টি হয়। পারিবারিক শিক্ষাও অনুশাসনের বিপরীতে গণ শিক্ষার প্রসার ঘটা সহজ হবে। সবকিছু মিলিয়ে প্রচলিত একগামী পারিবারিক কাঠামোর উপরে আঘাত পড়বে। সম্পত্তিতে গণমালিকানা সৃষ্টি হওয়াতে সেটা নারীরও মালিকানায় রূপান্তর হবে। নারীর দিক থেকে বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার আরো সুনিশ্চিত হবে।

একই সঙ্গে জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানা বহাল থাকায় ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিসেবে হিন্দু সম্প্রদায় ও আদিবাসী জাতি সত্ত্বাদের সম্পদ রাষ্ট্রীয়ভাবে বা ব্যক্তিগতভাবে যেভাবে লুট হচ্ছে। সেটা রোধ হবে। পাহাড়ি জাতিসত্ত্বাদের সম্পদ দখল রোধ হবে। পাহাড় ও প্রকৃতি রক্ষা পাবে।

আবার জমি জাতীয় সম্পদে পরিণত হলে যেমন উৎপাদিত ফসল জাতীয় সম্পদে পরিণত হবে, তেমনি উৎপাদিত ফসলের উপরে গণমালিকানা প্রতিষ্ঠিত হবে। এবং এটাই হলো খাদ্যে সার্বভৌমত্ব অর্জনের একমাত্র পন্থা। যা আবার সাম্রাজ্যবাদী খাদ্য রাজনীতির ফাঁদ থেকে বের হয়ে আসার গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। অর্থাৎ এই একটি কর্মসূচি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে সাম্রাজ্যবাদ ও নয়া উপনিবেশিক ব্যবস্থার যেমন উচ্ছেদ ঘটান সম্ভব, তেমনি সমাজের প্রচলিত লিঙ্গ ভেদ, বর্ণভেদ, ধর্মীয়ভেদ, মর্যাদাভেদ ইত্যাদির কারণে সমাজের প্রধানাংশ মানুষের উপরে যে নিপীড়ন ও আধিপত্যমূলক দশা বহাল বা জারী রয়েছে। সেটা থেকে সমাজের প্রধানাংশ মানুষের মুক্তি ঘটার সমস্ত শর্ত সৃষ্টি করে। এবং সমাজ ব্যবস্থা ও ব্যক্তি মানুষ, গণতান্ত্রিক চরিত্রসম্পন্ন ও মর্যাদাবান হয়ে ওঠে।

একই ভাবে কৃষির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে কৃষির উদ্বৃত্ত দিয়ে নতুন নতুন কর্মসংস্থা সৃষ্টি করা সম্ভবপর হয়। কৃষি থেকে বাড়তি জনসংখ্যা অন্য শ্রমক্ষেত্রে স্থানান্তর ঘটে তখন। মূলত এটাই হলো মূল ধারার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গে তরাই এর কৃষক আন্দোলনের পার্থক্য। তরাইয়ের পথটাই উপমহাদেশের নকশালপন্থীরা ৬০ দশকে গণতান্ত্রিক বিপ্লবের লাইন আকারে গ্রহণ করেছিল। অদ্যবধী তারা সেটাই বাস্তবায়নে লড়ছে। তবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পূর্ব পর্যন্ত যেহেতু কৃষি বিপ্লবের পূর্নাঙ্গ কর্মসূচি বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। ফলে আলোচিত দলগুলো মূলনীতি বাস্তবায়নের সম্পূরক কর্মসূচি হিসেবে প্রথমে ‘যে জমি চাষ করে, জমি তার’ এই কর্মসূচি বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে। এতে করে প্রচলিত রাষ্ট্রের যে জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানার ধরন এবং তার আইন, তাকেই আলোচিত কমিউনিস্ট পার্টিগুলো অস্বীকার করছে। নতুন ধরনের সম্পত্তি সম্পর্ক গড়ে তোলার লড়াই করছে। অর্থাৎ প্রচলিত ব্যবস্থায় যে অসংখ্য মানুষ জমির মালিকানা নিয়ে বসে রয়েছে। উৎপাদিত ফসলে ভাগ বসানো ছাড়া জমির সঙ্গে যাদের আর কোনো সম্পর্ক নেই। এই অনুৎপাদক ভূমি মালিকদের মধ্যে যারা আবার গ্রামীণ সমাজ কাঠামোয় রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ও ক্ষমতাধর, একই সঙ্গে স্থানীয় জনগণের কাছে উৎপীড়ক বা নিপীড়ক-এমন ব্যক্তিদের জমি কোনো রকম ক্ষতিপূরন ছাড়া প্রথমেই তারা দখলের কথা বলছে। আবার কোথাও বা সরাসরি রাষ্ট্রীয় খাস জমি দখল করে বন্টন করছে। এসব জমি বন্টন করছে তারা ভূমিহীন উৎপাদক কৃষকদের মধ্যে। এভাবে জমি দখলের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিপীড়িত কৃষক যাতে নিপীড়ক শ্রেণী ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়তে শেখে, রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলে সাহসী হয়ে ওঠে, খোদ কৃষক বা উৎপাদক জনগোষ্ঠী যাতে ভূ-প্রকৃতির কর্তা স্বত্বা হয়ে ওঠে, তাদের শ্রমের ফসল যাতে তাদের কর্তৃত্বেই থাকে, উৎপাদক হিসেবে উৎপাদিত দ্রব্য যেন তার দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়, উৎপাদক হিসেবে তার ঘরেই যাতে ভাতÑকাপড়ের ব্যবস্থা থাকে, এরকমের অসংখ্য প্রশ্ন তাদের এই সম্পূরক কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত। এবং তাদের এই কর্মসূচি প্রাথমিক স্তরের কর্মসূচি হলেও একটা ভিন্ন সম্পত্তি সম্পর্ক ও বণ্টননীতিকেই তা তুলে ধরে। মোটামুটি এটাই হলো আলোচিত দলগুলোর কৃষি বিপ্লবের সংক্ষিপ্ত সার। এবং এটাও মৌল সত্য যে, তাদের এই কৃষি বিপ্লবের সঙ্গে প্রচলিত রাষ্ট্রব্যবস্থা ও তার গণতান্ত্রিক চরিত্রের মধ্যে পার্থক্যটা অত্যন্ত প্রকট। অনেক সমাজ বিশ্লেষকরা বলেছেন এটা একদম নীতিগত পার্থক্য এবং বৈরী দ্বন্দ্ব হিসেবেই উপস্থিত। কারণ সমাজের কতিপয় সংখ্যালঘু মানুষ প্রচলিত ব্যবস্থা ও মালিকানার জোরে সম্পদের চরম স্থিতিতে ভোগ-বিলাসে গা ভাসাবে এবং সেই অবস্থানকে স্থিত করতে চাইবে, সেই স্থিতি ব্যবস্থাকে বজায় রাখার একমাত্র উপায় হিসেবে সমাজের সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষের উপরে অবদমন চাপিয়ে দিবে; তাদের সামাজিক চেতনাকে বিক্ষিপ্ত করতে চাইবে আর সমাজের সংখ্যগরিষ্ঠ মানুষ যখন শ্রেণী সচেতনতায় ক্লাশ ইন ইটসেলফ হয়ে উঠতে চাইবে; তখনই ওই সমাজে দ্বন্দ্বের ধরন বৈরী আকারে প্রকাশ পায়। রাষ্ট্র তখন আরো নিপীড়ক হয়ে ওঠে। খুনের রাস্তা ধরে। এটাই সমাজ বিশ্লেষকদের মতামত।
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

রূপকথা নয়, জীবনের গল্প বলো

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২


রূপকথার কাহিনী শুনেছি অনেক,
সেসবে এখন আর কৌতূহল নাই;
জীবন কণ্টকশয্যা- কেড়েছে আবেগ;
ভাই শত্রু, শত্রু এখন আপন ভাই।
ফুলবন জ্বলেপুড়ে হয়ে গেছে ছাই,
সুনীল আকাশে সহসা জমেছে মেঘ-
বৃষ্টি হয়ে নামবে সে; এও টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে ভ্রমণটি ইতিহাস হয়ে আছে

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১:০৮

ঘটনাটি বেশ পুরনো। কোরিয়া থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছি খুব বেশী দিন হয়নি! আমি অবিবাহিত থেকে উজ্জীবিত (বিবাহিত) হয়েছি সবে, দেশে থিতু হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেশ কিছুক্ষণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×