somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কাঠ কয়লা ছাই ২

৩০ শে জুলাই, ২০২০ বিকাল ৫:১৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আকলিমা থানা থেকে ফিরে এসেছে। তখন বেশ রাত। শহরের জেগে থাকা ব্যস্ততায় কিছু নয়। হোটেল মহাজনের সঙ্গে দেখা করে যাওয়ার পথে। তিন-চার হাজার টাকার আবদার। থানা টাকা খায়। দিলশাদ খান মানুষ ভালো। আকলিমা সংক্ষেপে কারণ তুলে ধরে। অবশেষে তিনখানা সবুজ নোট। সেই শক্তি আর সাহসে লালঘরে উঁকি দেয়। পুবমুখী গেটের পেছনে ঝাঁকড়া বকুল গাছ। এখনো ফলের ফাঁকে ফাঁকে কিছু ফুল রয়ে গেছে। তারই শেষ কিছু সুবাস বাতাসে ভেসে ভেসে থানা চত্বরের আশপাশে মাতাল ঢেউ তোলে। আকলিমার মন পোড়ে। আশা-নিরাশার দোলাচল। সে টেবিল থেকে টেবিলে ঘোরে। তার অনুনয়-বিনয় কারও এড়িয়ে যাওয়া উৎসুক চোখে হোঁচট খায়। কোনো হুশ থাকে না। ছোট ছোট লুকোচাপা দীর্ঘশ্বাস বুকের গহিনে ছটফট করে হেরে যায়। হায় আজ যদি মানুষটা বেঁচে থাকত! একা একা একলা লড়াইয়ের শেষধাপে মন উন্মন। মুনা আসতে চেয়েছিল। আকলিমা সঙ্গে নেয়নি। কোনো মিনতি শোনেনি। এখন মনে হয় সঙ্গে থাকলে বুকে বল পেত। অবশেষে কারও দৃষ্টি পড়ে। পাথরের চোখ হোক সে, তবু সেখানে কিছু নির্বিকার মনোযোগ, কিছু কৌতূহল, জিজ্ঞাসা খেলা করে; আকলিমার বুকে সাহস আসে। অনেক আশা নিয়ে এসেছে। নৌকোডুবি মানুষ যেমন খড়কুটো আঁকড়ে তীরে উঠতে চায়, যদি এই অন্ধকার গোলকধাঁধা গহ্বর থেকে একটু আলো খুঁজে পাওয়া যায়; তার মনজুড়ে স্বস্তি নামতে থাকে। কোতয়ালির উত্তরে যে টং দোকান, সেখান থেকে দুই প্যাকেট নাবিস্কো গ্লুকোজ বিস্কুট কিনেছে, মামুনকে দেবে; ছেলে যে ক্ষুধা সহ্য করতে পারে না। সেই প্যাকেট হাতের মধ্যে ঘেমে ওঠে। টেবিলের মানুষ কী ভেবে নেয়, কিছু লিখতে লিখতে থেমে গিয়ে চোখে চোখ প্রশ্ন করে।
‘কী দরকার?’
‘বাবা আমার পোলা। আপনেরা সন্ধ্যায় তুইল্যা আনছেন।’
‘পোলার নাম কী? কোন্ জায়গা?’
তারপর ব্যস্তত্রস্ত ফাইল ঠেলে উঠে দাঁড়ায় মানুষ। এদিক-ওদিক অস্থির দৃষ্টি ছুড়ে গরম স্বর তোলে। ওয়ারলেসে বেজে ওঠে পেট্রোলিং কথোপকথন। মানুষ সামনের কাউকে জিজ্ঞেস করে।
‘শফিক কই গেছে? মালদহপট্টি ফিরছে?’
‘না স্যার, আইসা পড়ব এখনি।’
‘দেখ তো এই মহিলা কী কয়?...এ্যাই এদিকে শোনো, কী নাম কইলা তোমার পোলার?’
‘মামুনুর রশিদ, মামুন বাবা, মামুন।’
আকলিমার কথা কে শোনে? আলোর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ সবটুকু আলো শুষে নিতে নিতে অন্ধকার করে তোলে দু-চোখ। সেই নিষ্প্রভ ছায়া ছায়া আলো-আঁধারিতে টেবিলে বসে থাকা অন্যজন মন্তব্য করে বসে।
‘মাদক কেস স্যার। ফেনসিডিল আর ইয়াবা।’
‘না বাবা, আমার পোলা এসব করে না। কলেজে পড়ে। আপনেরা ভুল সন্দেহে লইয়াইছেন বাবা।’
‘তুমি চুপ করো। এত কথা কও কেন হাঁ? কথার মইদ্যে কথা।’
‘স্যার পোলাডা না খাওয়া...ওরে এই বিস্কুটডা দিই?’
আকলিমা অবশেষে এক প্যাকেট বিস্কুট আর ঘি রং একটি চাদর দিতে পারে। ফাল্গুনের রাতে হিম হিম কুয়াশা। শীত ভেজা রাত। ঠান্ডা সহ্য হয় না। বিস্কুটের অন্য প্যাকেট খুলে লাল চায়ের আসর বসে। আকলিমার বুকে নিভে যাওয়া আগুন ফুরফুর করে জেগে উঠতে চায়, চোখ উঁচু দেখতে দেখতে ভেবে নেয়; উপায় কী? এসব তো হয়ই। তার অসহায়-কাতর দৃষ্টি। সে কোনো আইন জানে না। বোঝে না কিছু। পুলিশ দেখলে অচেনা কাঁপন জাগে। সেই ভয়...সেই আতঙ্ক বোবা করে রাখে চোখ-মুখ। বুকের ধুকপুক। ছেলেকে ফেরত নিয়ে যেতে পারবে তো? এই প্রশ্ন মনের অলিগলিতে দমবন্ধ নিশ্বাস ফেলতে ফেলতে আশপাশ ঘুরে আসে। গেটের ওখানে লাইটপোস্ট। শিখরে বিশাল এক বাল্ব জ্বলছে। সেখানে জমায়েত হয়েছে হাজার পোকা। সেগুলো উড়তে থাকে, আছড়ে পড়ে, মরে যায়। তারই ছায়ায় ঘোড়ানিম গাছে হালকা বেগুনি ফুল আশার আলো জাগিয়ে রাখে। আকলিমা এখন পোকা। সে আছড়ে পড়ে মেঝেয়। এখন শুধু পা ধরা বাকি।
মামুনের শুকনো চোখ-মুখ। এই আধ-এক ঘণ্টায় জমে উঠেছে হাজার দুশ্চিন্তা-অসহায় দৃষ্টি। একটু কি অলীক বিশ্বাস আর ক্ষোভ? সে বিস্কুট হাতে নিতে নিতে বলে, -
‘মা তুমরা চিন্তা করবা না। আমি কিছু করছি না কি?’
‘চুপ যা বাপ। আল্লা আল্লা কর। আল্লা রে ডাক। আল্লা সব মাফ কইরা দিব।’
‘মা মুনা আহে নাই?’
‘না বাপ। তর হেদিন সজল রে মাইর দেওন ঠিক হয় নাই। সরকারি দল করে। ওগো ম্যালা ক্ষ্যামতা।’
‘আমার হুশ আছিল না মা। আমারে মাফ কইরা দাও।’
‘আহা রে আমার জাদু!’
শেষমেশ কিছু হলো না। আকলিমা যখন কোতয়ালি থেকে রাস্তায় নেমে আসে, বেশি দূরের পথ নয়, অথচ মনে হয় যোজন যোজন দূর বিস্তৃত তেপান্তর, পুলসিরাতের সূক্ষ্ম সেতু পেরিয়ে যাচ্ছে। চোদ্দো শিকের অন্ধকার খাঁচায় কলিজার টুকরো থেকে গেল। তার প্রাণবায়ু নিশ্বাস। তখন আরও একবার, কতদিন পর সেই অস্থির মুখছবি ভেসে ওঠে। রাতের আকাশে তারাদের মেলায় কোন্ কোনায় সেই মানুষ? কোন্ অচিন অন্ধকারে লুকিয়ে বেসুরো জীবনের পরতে পরতে সপ্তসুর তুলতে মরিয়া? বেচারা! হতভাগা মানুষ। তাদেরও অন্ধকারে রেখে চলে গেল। আকলিমা কি গভীর আনমনা অস্ফুটে সেই নাম উচ্চারণ করে বসে? ‘মামুনের বাপ, আমাগো ফেলাইয়া কই গেলা তুমি?’ কোনো উত্তর নেই। বাতাসে ভেসে আসে শুধু উদাস হিম ঢেউ।
(চলমান)

আগের পর্ব: কাঠ কয়লা ছাই
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জুলাই, ২০২০ বিকাল ৫:১৪
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

×